প্লেনে উঠলে নূপুরের পঙ্খিরাজ সাপ হওয়ার বাসনা জাগে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটা সিটে ঠায় বসে থাকা যে কী বিরক্তিকর! পঙ্খিরাজ সাপ হলে নিমেষে উড়াল দিয়ে চলে যেতে পারত ও এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়।
নিউ জার্সি থেকে ঢাকায় যাওয়ার আগে মদিনা ট্রাভেলের ম্যানেজার বলেছিল, নূপুরের আগে আর কেউ এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিট কাটেনি তার এজেন্সি থেকে। এ জন্য এই এয়ারলাইনসের ভালো-মন্দ বলা তার পক্ষে সমীচীন হবে না।
এয়ারক্রাফটে উঠে চারদিক দেশি ভাইদের কথার কলকল শুনতে পেল। পাশের সিটে একজন সুদর্শন ভদ্রলোককে বসে থাকতে দেখে সংকুচিতভাবে নূপুর ওর নির্ধারিত সিটে বসল।
‘হ্যালো, আমি শারমিন নূপুর।’ মাথার স্কার্ফ ঠিকঠাক করতে করতে বলল ও।
‘হাই। আমি পাওয়ান গুপ্তা। পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।’
নূপুর জানে, পাওয়ান মানে পবন অর্থাৎ বাতাস।
ইংরেজিতে নিজের পরিচয় দিলে হিন্দিতে বেশি চোস্ত ও।
প্লেন টেকঅফের পরে মনিটর কাজ করছে না দেখে নূপুর সিদ্ধান্ত নিল বই পড়ে সময় কাটানোর। কিন্তু সারা বছর যে বই পড়ে না, হঠাৎ করে তার পড়ার মনোযোগ চলে আসবে, তাই কি হয়! দীর্ঘক্ষণ বই পড়ার পরে নূপুরের অনুভব হলো, সামনে শুধু সাদা অক্ষর দেখছে।
ফিরে দেখল সহযাত্রী ভদ্রলোক গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। নূপুরের চোখে ঘুম এলো না।
এত সুদর্শন সহযাত্রী পাশে থাকলে কিভাবে ঘুমানো সম্ভব! ঘুমের মধ্যে ভদ্রলোকের হাত লেগে যাচ্ছিল নূপুরের হাতের সঙ্গে। ও অস্বস্তি কাটাতে সরে বসল। কিছুক্ষণ প্লেন খুব ওঠানামা করল। প্লেন বাম্পিং করার সময় সাপের ভাবনাটা এলো নূপুরের। পঙ্খিরাজ সাপ হলে এত কিছু ঝামেলা পোহাতে হতো না। নিমেষে যাওয়া যেত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে।
আজ যেন ওকে সাপে পেয়েছে। ঘুরেফিরে সাপের ভাবনা মনের মধ্যে এসে বাসা বাঁধছে। এই যে সুদর্শন সহযাত্রী ঘুমিয়ে পুরো সময় কাটিয়ে দিচ্ছেন, এত ঘুম তিনি পেলেন কোথায়? সাপে কাটার পরে কালঘুম নয়তো!
অনেক সময় নাগরাজ আর নাগরানি মানুষের রূপ ধারণ করে বনে-জঙ্গলে মিলিত হয়। নূপুর এক সিনেমায় দেখেছিল, ওদের সঙ্গমের সময়ে নায়ক ভুলে আঘাত করে নাগরাজকে। নাগরানি ক্রোধান্বিত হয়ে নায়ককে ছোবল দেয়। নাগরানির ছোবল যে খায় তার বাঁচার কোনো আশা থাকে না। নায়িকা কালবিন বাজায় নায়ককে বাঁচাতে। কালবিন বাজাতে গিয়ে নায়িকার মুখে রক্ত উঠে যায়। অবশেষে নায়কের কালঘুম ভাঙে।
নূপুরকে আর কালবিন বাজাতে হলো না, এয়ার হোস্টেস আলো জ্বালিয়ে ঘুম ভাঙায় সবার!
আলো জ্বালানোর পর আড়মোড়া ভাঙে সুদর্শন সহযাত্রীর। নূপুর তাকাতে ভুবন-ভোলানো একটা হাসি দেয়। নূপুর ভাবে, সুন্দর হাসি, মায়াবী চোখ—এসব হলো কিছু মানুষের জন্মগত সুবিধা। সৃষ্টিকর্তা তাদের সব কিছু দিয়ে দেয়, শুধু মনে কোনো প্রেমবোধ দেয় না।
‘আপনি বই পড়তে ভালোবাসেন?’
নূপুরের কোলে রাখা বই হাতে নেয় পাওয়ান গুপ্তা। এয়ারক্রাফটের মনিটর কাজ না করা যে ওকে পাঠক বানিয়েছে, সে কথা বলে না নূপুর।
‘আমি এক মেয়েকে চিনতাম, ওর নাম মুবারাকান। উজবেকিস্তানের সমরখন্দের মেয়ে!’ বইটি ফেরত দেওয়ার সময় পাওয়ান গুপ্তার হাত সামান্য লেগে যায় নূপুরের সঙ্গে। অবশ করা এক ভালো লাগার অনুভূতি হয় ওর। নূপুরের বোধ হয় চারদিকে কেমন একটা স্বপ্নবৎ অনুভব বিরাজমান।
নারী আর পুরুষের আকর্ষণ তো সহজাত আর তাতে যদি মিলের চেয়ে অমিল বেশি থাকে, তাহলে তো আকর্ষণ আরো বেড়ে যায়।
এয়ার হোস্টেসরা খাবার দিয়ে গেলে দুজনে খেতে শুরু করে। নূপুর বুঝতে পারে না মুবারাকান সম্পর্কে ওর আগ্রহ দেখানো ঠিক হবে কি না!
‘মুবারাকানের সঙ্গে পরিচয় হলো কিভাবে?’
‘সে আমার রোগী ছিল।’
‘আপনি কি ডাক্তার?’
‘আমি ডাক্তার না। ডেন্টিস্ট। কানেকটিকাটের ওয়াটারব্রিতে আমার চেম্বার আছে।’
নূপুর জানে, দাঁতের চিকিৎসাকালে রোগী-রোগিণীরা ডাক্তারের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসে। এমন সুদর্শন ডাক্তারের প্রেমের আগুনে উজবেকিস্তান থেকে উগান্ডার নারীরা পঙ্গপালের মতো ঝাঁপ দেবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
‘উনিও কি ওয়াটারব্রিতে থাকেন?’
‘মুবারাকান নিউ রোশেলে থাকে।’ একটু থেমে সহযাত্রী জানতে চাইল, ‘আপনি কোথায় থাকেন, কী করেন জানা হয়নি!’
‘নিউ জার্সির প্যাটারসনে থাকি। ওখানে একটা পপাইস চিকেনের দোকানের ম্যানেজার।’
‘বাহ, নাইস!’
চিকেন রাইস খাওয়া শেষ করে চকোলেট কেকটা খুলল সহযাত্রী। চামচ দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে খেতে লাগল।
‘মুবারাকান আমার কাছে একটা সাহায্য চাইল। ও একটা গাড়ি কিনবে আমার এলাকার এক লোকের কাছ থেকে। ২০১৮ মডেলের মিতসুবিশি। আমাকে অনুরোধ করল সঙ্গে যাওয়ার জন্য।’
‘ফেসবুক মার্কেটপ্লেস থেকে কিনেছে? আমার গাড়িও সেখান থেকে কেনা।’
‘আপনি ড্রাইভ করেন?’
‘ড্রাইভ করি মানে, গত মাসে কানাডায় ঘুরে এলাম।’
‘বাহ, নাইস!’
কথায় কথায় নাইস বলা সহযাত্রীর মুদ্রাদোষ, ভাবল নূপুর।
‘একটা উপকার করার বিনিময়ে মুবারাকান আমাকে একদিন ডিনার করাতে চাইল। ডিনারের পর মুবারাকানকে আমার চেম্বারে নিয়ে গেলাম। ওখানে আমরা খুব কাছাকাছি এলাম। এভাবে নিয়মিত মিলিত হতে লাগলাম আমরা।’
নূপুর কেমন যেন ঘামতে লাগল। এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট জমিয়ে দিল যেন মুবারাকান!
‘মুবারাকানের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর আমার বয়স যেন ১০ বছর কমে গেল। নিজেকে কলেজপড়ুয়া তরুণদের মতো উত্ফুল্ল মনে হতো। একটা আবেশ-প্রেমময় মুগ্ধতা মনকে দখল করে রাখত সব সময়। কঠিন পেশাগত জীবনে যেন দমকা বাতাস হয়ে এসেছিল মুবারাকান।’
‘এসেছিল বলছেন কেন, তার মানে সমরখন্দের ওই নারীর সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক নেই আপনার?’
নূপুর মনে মনে চাইল সহযাত্রী না বলুক, তার পরিবর্তে যেটা শুনল সে জন্যও প্রস্তুত ছিল না ও।
‘মুবারাকানের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক হওয়ার মতো অবস্থা আমার ছিল না। আগে বলা দরকার ছিল, আমি বিবাহিত ও দুই সন্তানের বাবা। বিবাহিতজীবনে আমাকে সুখী বলতে পারেন!’
খাওয়ার পর্ব শেষে দুজনে দুটি ড্রিংকস নিয়েছে। নূপুর নিয়েছে কমলার জুস আর সুদর্শন সহযাত্রীর হাতে বিয়ারের ক্যান।
‘মুবারাকানের সঙ্গে কী হলো তারপর?’
‘আমাদের দুজনের উদ্দাম প্রেম ছিল বছর দেড়েকের মতো। শেষের দিকে মনে হতো মুবারাকান আগের মতো নেই। একদিন বলে ফেলল, ও একজনকে পছন্দ করা শুরু করেছে। আরো বলল, সামাজিকভাবে পরিচয় দিতে পারে এমন কাউকে দরকার ওর। উৎসব আর ছুটির দিনগুলোতে পরিবারের কারণে আমি মুবারাকানকে সময় দিতে পারতাম না। ও খুব নিঃসঙ্গ বোধ করত। আমাদের দুজনের ষোলো আনা কেমিস্ট্রি থাকলেও সম্পর্কের এই গোপনীয়তা ওর আর ভালো লাগছিল না।’
শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে বেদনারহিত হয়ে ওঠে পাওয়ান গুপ্তার কণ্ঠস্বর।
এয়ার হোস্টেসরা আবার আলো নিভিয়ে দেয়। অন্ধকার আকাশের দিকে সহযাত্রীকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নূপুর। ওর মধ্যে কেমন যেন অস্থিরতা কাজ করে। সামান্য পরিচয়ে কেন ওকে নিজের জীবনের এমন গোপন অধ্যায় বলল সহযাত্রী, বুঝতে পারল না ও। অস্বস্তি কাটাতে উঠে দাঁড়ানোর সময় নূপুর খেয়াল করে ভদ্রলোক ওর দিকে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে আছেন। ওর মধ্যে কি মুবারাকানকে খুঁজছেন তিনি!
এয়ার হোস্টেসদের ক্রু স্টেশনে গিয়ে নূপুর আবার জোরজবরদস্তি করে বই পড়া শুরু করে। বেশ কিছুক্ষণ পর সেই আগের মতো টের পায়, ওর আসলে কিছুই পড়া হচ্ছে না।
নূপুর সিটে ফিরে এসে সহযাত্রীকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দেখতে পায়। ওর কেন যেন মুবারাকানের কাহিনি অবাস্তব লাগতে থাকে। একটু আগে পড়া বইয়ে হয়তো জেনেছে মুবারাকানের কথা। নিজেকে এমন একটা সান্ত্বনা দিয়ে সহযাত্রীর দিকে ঘুরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয় নূপুর। ঠিক ঘুমিয়ে অথবা ঘুমিয়ে নয়, একটা স্বপ্নের সৃষ্টি হয়।
নাগরাজ আর নাগরানির মতো জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে আছে ওরা!
Publisher & Editor