জীবদ্দশায় কবি হিসেবেই তিনি পরিচিত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর, তুতেন খামেনের গুপ্তধনের মতো কালো ট্রাংকের ভেতর থেকে বেরিয়েছে অজস্র গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও লিটারারি নোটস। তাঁর কবি পরিচয় ঘোচেনি। এমনকি কবিতার আড়ালে তিনি গল্প-উপন্যাসও লেখেন এবং গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হিসেবে নিজের তুমুল প্রতিষ্ঠা দেখতে চেয়েছিলেন, কাছের ও দূরের কোনো বন্ধু বা আত্মীয় কেউ টের পাননি।
জীবনানন্দ দাশের কবিতার অসম্ভব গুণগ্রাহী ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। এমনকি ত্রিশের দশকের গোড়ায় জীবনানন্দকে তিনি একরকম আবিষ্কার করেছেন বলে মনে করা হয়। তাঁর সম্পাদিত ‘প্রগতি’ ও ‘কবিতা’ পত্রিকায় জীবনানন্দের অসংখ্য কবিতা প্রকাশ করেছেন।
জীবনানন্দের মৃত্যুর পর তিনিই প্রথম কবিতা পত্রিকার তরফে জীবনানন্দ স্মরণসংখ্যা বের করেছিলেন। সেই বুদ্ধদেবও জানতে পারেননি, উপলব্ধিও করতে পারেননি, কবিতার সমান্তরালে জীবনানন্দ কথাসাহিত্যচর্চা করেন। ১৯৪৩ সালে ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থ নিয়ে প্রবন্ধ লেখার সময় বুদ্ধদেব লিখছেন : ‘আমাদের আধুনিক কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ সবচেয়ে নির্জন, সবচেয়ে স্বতন্ত্র। তিনি কবিতা লেখেন এবং কবিতা ছাড়া আর কিছু লেখেন না।
বুদ্ধদেব প্রবন্ধটি যখন লিখছেন, তার আগেই ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত হিসাব করলেও জীবনানন্দ অন্তত শ খানেক গল্প এবং গোটা দশেক উপন্যাস লিখে উঠেছেন। কিন্তু এর একটাও প্রকাশ করেননি, কাউকে পড়তে দেননি, এমনকি আলাপও করেননি।
তাঁর গল্পকার বা ঔপন্যাসিক পরিচয় কেউ জানত না এবং তিনি নিজে থেকেও জানার সুযোগ দেননি। কেবল প্রিয়তম বন্ধু-কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে একটি চিঠিতে ছদ্মনামে ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় উপন্যাস প্রকাশের কথা বলেছিলেন।
সঞ্জয় তেমন আগ্রহ দেখাননি, জীবনানন্দও পরে ব্যাপারটা স্রেফ চেপে গিয়েছেন। আজ দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার বোঝা যায়, তিনি অন্য ধারার গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। নতুন ধরনের গল্প ও উপন্যাস লেখার জন্য তাঁর বিশেষ পরিকল্পনা ছিল।
১৯৫৩ সালে কিছুদিন কলকাতায় ছিলেন না বুদ্ধদেব বসু; বিশেষ কোনো কাজে আমেরিকায় গিয়েছিলেন। সেই সময় জীবনানন্দ দাশ এক দিন তাঁর ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি থেকে বেরিয়ে হেঁটে সটান বুদ্ধদেবের ২০২ রাসবিহারি এভিনিউর বাড়িতে হাজির হলেন। উদ্দেশ্য প্রতিভা বসুর সঙ্গে উপন্যাস নিয়ে কথা বলা। উপন্যাস লিখে কেমন টাকা পাওয়া যায়?
সেদিন ওই বাড়িতে খুব বেশি সময় তিনি থাকেননি। উপন্যাস নিয়ে প্রতিভা বসুর সঙ্গে কিছু কথা বিনিময় করে, চা খাওয়ার আমন্ত্রণ উপেক্ষা করে কেবল তথ্যগুলো জেনে তিনি বেরিয়ে এসেছিলেন।
ঔপন্যাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশের নানা পরিকল্পনা তাঁর ভেতরে কাজ করছিল। কিন্তু সময়, আত্মবিশ্বাস ও প্রকাশকের অভাব; যেকোনো কারণেই হোক, বেঁচে থাকতে তিনি গল্প-উপন্যাসের কিছুই প্রকাশ করেননি। ব্যক্তিগত চরিত্রের মতো লেখা নিয়েও তাঁর খুঁতখুঁতে মনোভাব ও চূড়ান্ত না হওয়া অবধি লেগে থাকা, ক্রমশ চলছিল। সেই প্রস্তুতিপর্ব আর ফুরোয়নি। এক ফাঁকে জীবনই ফুরিয়ে গেছে।
‘মাল্যবান’ জীবনানন্দ দাশের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস। প্রায় কুড়িটার মতো উপন্যাস তিনি লিখেছেন। এর মধ্যে ‘জলপাইহাটি’ ও ‘সুতীর্থ’ তাঁর সুবৃহৎ উপন্যাস। তবে ‘মাল্যবান’ নানা দিক থেকে সুন্দর, সুচারু এবং লক্ষ্যভেদী। বলা যায়, ‘মাল্যবান’ তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এক হিসেবে বাংলা সাহিত্যের সেরা উপন্যাসগুলোর একটি।
প্রচলিত ছকে তিনি উপন্যাস লেখেননি। কোনো উপন্যাসই প্রকাশ করেননি, তবু এ নিয়ে তাঁর পরিষ্কার ও অভিনব বিবেচনা ছিল। উপন্যাস নিয়ে ১৯৩২-এর ডায়েরিতে তিনি লিখছেন— ‘উপন্যাস, জীবনের কেন্দ্র থেকে যেসব উপন্যাসের জন্ম হয়, সেসব ভালো লাগে না আজকাল আর। বরং জীবনের কিনার ঘেঁষে মৃত্যুর অশরীরের অস্পষ্ট গন্ধের ভেতর যে সমস্ত গল্পের জন্ম হয়, সেগুলো নেড়েচেড়ে হেমন্তের সন্ধ্যা ও রাত্তির বেশ কেটে যায় আমার।’
তাঁর উপন্যাসে বারবার এমন একজন মানুষের দেখা পাই, যিনি ঘন ঘন বরিশাল-কলকাতা-বরিশাল করছেন। উপন্যাসের মূল চরিত্র কোনো না কোনো ভাবনা, কর্মসূত্র এবং যাপিত জীবনের লড়াইয়ে তাড়া খেয়ে ভাবুক এবং উদ্বাস্তু। কখনো তিনি একটা স্যুটকেস হাতে সপরিবার কলকাতায় যাচ্ছেন। দেশের বাড়িতে ফিরছেন। আবার একা কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন। প্রথম দিকের উপন্যাসের এই দৃশ্যপট বারবার ফিরে ফিরে দেখতে পাই।
বরিশাল থেকে কলকাতায় যেতে স্টিমার ও ট্রেনই ভরসা। তখন কলকাতা থেকে খুলনা বা বরিশাল থেকে খুলনা হয়ে কলকাতায় যেতে হয়। বাস্তবেও তিনি খুলনা থেকে প্রতিবার কলকাতার জন্য ট্রেন ধরতেন। স্টিমার থেকে নেমে ট্রেন ধরা। অথবা ট্রেন থেকে নেমে স্টিমার ধরা। ‘প্রেতিনীর রূপকথা’ উপন্যাসে এসব বর্ণনা বারবার এসেছে। তিনি লিখছেন :
‘ট্রেন বদলে স্টিমারে উঠল যখন সত্যেন, তখন সেই অন্ধকার আকাশ মাঠ ভরা নদী যেন মাধুরীর মতো, মায়ের মতো, উথলে উঠে তাকে বুকের ভিতর টেনে নিয়েছে।’
জীবনানন্দ তাঁর ৫৫ বছরের যে জীবন যাপন করেছেন, তাতে সুস্থির ও আরামের জীবন তাঁর ছিল না। চাকরি, লেখা ও দাম্পত্য; এই তিনটি অধ্যায়ে ঘুরপাক খেয়েছে তাঁর স্বপ্ন, সাধনা ও বাঁচামরা। সে কারণে লেখাটা তাঁর একরকম আশ্রয় ও মুক্তিরও জায়গা ছিল।
কী ধরনের জীবনপ্রবাহ ও ভাবনা তিনি বুকে বয়ে বেড়িয়েছেন, বিশেষ করে বিয়ের পর, মাথায় রাখলে উপন্যাস বুঝতে সহজ হয়। প্রায় বেকার জীবনানন্দ দাশ যখন চাকরির খোঁজে একবার বরিশাল তো কিছুদিন পরেই কলকাতায় যাতায়াত করছেন, তাঁর জীবন ও পরিপার্শ্ব কিভাবে তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে, সংসারে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়ে স্ত্রীর গালমন্দ, মা-বাবার শীতল ব্যবহার আর বাইরের পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা সহ্য করেছেন; তাঁর জীবনের পুরো কাঠামোটি আমাদের সামনে চলচ্ছবির মতো দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। কাজেই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ‘প্রেতিনীর রূপকথা’ উপন্যাসের সুকুমার বা ‘জলপাইহাটি’র নিশীথ লোকটি আসলে কার গল্প লিখছেন। নিজের জীবন ও পরিপার্শ্বের গল্পই তিনি অঙ্কন করেছেন। একসময় দেশভাগ হয়ে গেল। কলকাতায় আর একটা যুদ্ধের জীবন শুরু হয়ে গেল। পরের উপন্যাসে সেসব ধরা পড়েছে নানা গল্প ও চিত্রের ভেতর দিয়ে।
আবার তাঁর কেবলই প্রস্তুতি, কখনো ক্যারিয়ার লেখা নিয়েও। উপন্যাসের বিষয় হিসেবে সেসব আসছে। ‘নিরুপম যাত্রা’ উপন্যাস শুরু হচ্ছে এভাবে : বছর চারেক পরে কলকাতা থেকে প্রভাস দেশে ফিরছে। পাঠকের মনে হবে, দেশের সে পথে রওনা হয়ে গেছে। অথচ উপন্যাসের শেষে দেখা যায় : সারা রাত ছটফট করে সকালবেলায় যখন সে মারা গেল কলকাতাতেই।
জীবনানন্দ দাশের উপন্যাসে সময় একটা বড় ভরকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে ব্যর্থ ও ভিলেন চরিত্র আর সময়ের নানা রং ফিরে ফিরে এসেছে।
আর তাঁর জীবন। ব্যক্তিগত জীবনের টুকরো কথা, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা নানাভাবে তিনি উপন্যাসে ছড়িয়ে দিয়েছেন। ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ উপন্যাস পড়তে ধরলে মনে হয়, বরিশালের জীবনের কথা তিনি লিখছেন। একপর্যায়ে বলছেন, কারুবাসনা আমার সব সাফল্য নষ্ট করেছে।
‘সুতীর্থ’ সবচেয়ে দীর্ঘ উপন্যাস। এখানেও দাম্পত্যের শীতল ছবি ও অভাবের গল্প। একগ্লাস ঠাণ্ডা দুধ খাওয়ার ছবি দিয়ে উপন্যাস শুরু হয়। লম্বা সময় ধরে খাওয়া চলে। তিনি ঝরা ও গলিত সময়ের কথা বলছেন। যে সময়ও তার অভিঘাত আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না, কেবল অনুভব করতে পারি।
কলকাতা শহরের শীতের বর্ণনা দিয়ে যে ‘মাল্যবান’ শুরু হচ্ছে, শেষ হয় শীত ফুরোবে না উপমা দিয়ে; মাঝখানে বীভৎস এক জীবনের গল্প। পড়তে পড়তে হৃদয় কেঁপে কেঁপে থেঁতলে যায়। সামান্য একটি উপন্যাসের পরিসরে এত আলো ও অন্ধকার, এত গোলকধাঁধা, গলিঘুঁজি ও হাওয়া বয়ে চলে, থেমে থেমে এগোতে হয়। পাঠ থামিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে হয়।
মাল্যবান চরিত্রটি কী ভয়ানক ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে জীবনকে বয়ে নিয়ে চলে, তবু সে সংসার থেকে কেটে পড়ে না। কিভাবে পেরে ওঠে? এসব ভেবে শ্বাস ঘন হয়ে আসে। বুকের বাতাস থেমে যায়।
দেশভাগের পটভূমিতে লেখা দীর্ঘ উপন্যাস ‘জলপাইহাটি’। এখানেও চরিত্র একজন নাজুক মানুষ, যিনি অধ্যাপনা করেন। একদিন যিনি জলাপাইহাটি ছেড়ে কলকাতায় ফেরার স্বপ্ন দেখেন। জলাপাইহাটি নামে আদৌ কোনো শহর আছে? উপন্যাসে জীবনানন্দ কল্পিত যে মফস্বল শহরের জীবন-ছবি এঁকেছেন, মনে গাঢ় দাগ রেখে যায়।
নিশীথের স্ত্রী ‘পারনিসাস এনিমিয়ার রোগী। এদের সঙ্গে ঘর করে মজাও করতে পারা যায় না একটু।’ তিনি লিখছেন। সে কারণে নায়ক তার সহকর্মী অধ্যাপকের স্ত্রীর মধ্যে কামনাজড়িত ‘গাই-গরু’ খোঁজে। ‘জৈবলীলা’ উপন্যাসটির বড় জায়গাজুড়ে।
জীবনানন্দ সরল সোজা লোকটি নন, উপন্যাসের মার্জিনে ও ভেতরে তাঁর নানা উদাহরণ ছড়িয়ে আছে।
জীবনানন্দ দাশের অভ্যাস ছিল, কোনো একটি কবিতা লিখে শেষ করার পর ফেলে রাখা এবং ফিরে ফিরে পড়া ও সংশোধন করা। চূড়ান্ত রূপ তৈরি করে পত্রিকায় পাঠানো। এমনকি পত্রিকায় কবিতা পাঠিয়ে, ছাপা হওয়ার আগে বা পরেও তিনি সংশোধন করতেন। গল্প ও উপন্যাসের বেলায় তিনি এই কাজ করতে পারেননি। সময় ও অবকাশ মেলেনি। নিজের সৃজনকৌশল ও বৈশিষ্ট্য সমুন্নত রেখে তিনি যদি সেসব প্রকাশ করতেন, তাঁর সময়ের উল্লেখযোগ্য গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতি ও স্বীকৃতি লাভ করতেন, সন্দেহ নেই।
Publisher & Editor