বলা হচ্ছে, বিশ্ব আজ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মুখোমুখি হয়েছে, যা বিগত গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনগুলোর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফি বছর এই নির্বাচনের গুরুত্বকে এভাবে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরার প্রবণতা আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়।
যাঁরা মার্কিন ইতিহাসের সামান্যতমও বুঝতে পারেন, তাঁরা জানেন, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সব সময় দুটি বিপরীত ধারার মধ্যকার একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে তুলে ধরা হয়। যেমন অতীত বনাম ভবিষ্যৎ, সমৃদ্ধি বনাম অবক্ষয়, শান্তি বনাম যুদ্ধ। আর বর্তমানে এই নির্বাচন গণতন্ত্র বনাম কর্তৃত্ববাদের লড়াই হিসেবে চিত্রিত হচ্ছে।
আসলে এটি একটি মিথ বা ভুল ধারণা যে আমেরিকান ভোটারদের হাতে সত্যিকারের বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে। কারণ, দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানকে বাইরে থেকে আলাদা ধারার মনে হলেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিশেষ করে যুদ্ধ ও শান্তির বিষয়ে তাদের মধ্যে আদর্শগত পার্থক্য নেই। মূলত তারা একে অপরের সহচর এবং অভিন্ন নীতির অনুসারী।
যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে থাকা শতকোটিপতি অভিজাতরা জানেন যে ‘গণতন্ত্র’ আসলে একটি মধুর বিভ্রম। এই বিভ্রম সাধারণ মানুষকে এটি বিশ্বাস করানোর জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে যে পার্টি ১ ও পার্টি ১-এ (ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান) একে অপরের থেকে আলাদা। এই দ্বিধা, বিশেষ করে আরব ও মুসলিম আমেরিকান ভোটারদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, বর্তমান সময়ের প্রধান ইস্যু—গাজা ও দখলকৃত পশ্চিম তীরে সংঘটিত গণহত্যার ক্ষেত্রে পার্টি ১ ও পার্টি ১-এ-এর নেতারা একই অবস্থান নিয়েছেন এবং এ ঘটনার পক্ষে উভয় শিবিরই সমর্থন দিয়ে আসছে। তাই প্রশ্ন থেকে যায়, আসলেই কাকে ভোট দেবেন? নাকি আদৌ ভোট দেওয়া উচিত?
মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। উভয়ে একই অবস্থান নিয়েছেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাঁদের সমর্থিত নেতা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য তাঁরা সমানভাবে সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁরা দুজনই বোমাবর্ষণ, ইচ্ছাকৃতভাবে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করা, চিকিৎসার সুযোগ না দেওয়া, রোগের বিস্তার ঘটানো, জোরপূর্বক স্থানান্তর ইত্যাদিসহ সেই সব ভয়ংকর নীতির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, ফলে গাজায় ৪৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এসব নিহত মানুষের একটা বড় অংশই নারী ও শিশু।
শুধু কৌশলগতভাবে নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় গাজা ও পশ্চিম তীরে একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র দ্বারা সংঘটিত এসব অপরাধ বর্ণনা করতে ট্রাম্প ও হ্যারিস উভয়েই ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। উভয় রাজনৈতিক দল ইসরায়েলের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন দিচ্ছে এবং যাঁরা এ অবস্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন, তাঁদের সন্ত্রাসবাদের সমর্থক বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
মিডিয়া ও ডেমোক্র্যাটরা নিজেদের মধ্যে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেও, আরব ও মুসলিম ভোটারদের ক্ষোভ তাদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এতে আসন্ন নির্বাচনে ট্রাম্পের সমর্থন বাড়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এটি ডেমোক্র্যাটদের জন্য উদ্বেগের কারণ।
কিছু রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক দাবি করছেন, যদি আরব ও মুসলিম ভোটাররা ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থীর বিপক্ষে ‘প্রতিবাদী ভোট’ দেন, তাহলে তাঁরা এমন এক শাসককে ক্ষমতায় আনতে সহায়তা করবেন, যিনি মুসলিম নিষেধাজ্ঞার জন্য কুখ্যাত। এটি মুসলমান ভোটারদের একধরনের মানসিক চাপ প্রয়োগের কৌশল। আরব ও মুসলিম আমেরিকানদের দীর্ঘদিন ধরে সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। তাঁদের বিদেশি ও অবিশ্বাস্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই ভ্রান্ত ধারণা থেকেই তাঁদের আত্মনিয়ন্ত্রণের ওপর নির্ভর করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
এ কারণে এই নির্বাচনী প্রচারাভিযানকে মার্কিন রাজনীতির অন্ধকারময় দিক বলা যেতে পারে। এ অবস্থায় আরব ও মুসলিম আমেরিকানদের যদি মার্কিন রাজনীতিতে সত্যিকার অর্থে দৃশ্যমান হতে হয়, তাহলে এই মুহূর্তে তাঁদের সম্মানের সঙ্গে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। এটি হবে ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সহমর্মিতা ও সমর্থনের প্রতীক এবং একই সঙ্গে নিজেদের আত্মমর্যাদার প্রকাশ।
Publisher & Editor