বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪

শামসুর রাহমানের কবিতাভুবন

প্রকাশিত: ২৩:৫৭, ০১ নভেম্বর ২০২৪ | ১৫

আমাদের কালকে যাঁরা শব্দে ধারণ করেছেন, যাঁদের ছন্দোবদ্ধ শব্দগুচ্ছে বন্দি হয়ে আছে বাঙালির উত্থানের ইতিকথা—শামসুর রাহমান তাঁদের অন্যতম। তিরিশি বাংলা কবিতা পঞ্চাশে এসে যে নতুন চারিত্র্য অর্জন করল, তার শ্রেষ্ঠতম শিল্পী শামসুর রাহমান। অর্ধশতাব্দীরও অধিককাল ধরে তিনি হেঁটেছেন কবিতা-কক্ষপথে, নির্মাণ করেছেন নিজস্ব এক কবিতাভুবন।

চল্লিশের পাকিস্তান আন্দোলন পূর্ববাংলাকেন্দ্রিক বহু কবিকে উদ্বুদ্ধ করেছে—পাকিস্তান আন্দোলনের আন্তঃপ্রেরণায় তাঁরা রচনা করেছেন একের পর এক কবিতা।

স্বপ্নভঙ্গের বেদনায়ও তাঁরা পীড়িত হননি তাঁদের কবিতায় শিল্পিত হতে থাকল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রান্ত সমাজদর্শন। ফলে তাঁদের কবিতায় স্বদেশের রূপটা দেখা দিয়েছে বিকৃত ও সংকীর্ণ সত্তায়। আটচল্লিশে আরম্ভ হওয়া রাষ্ট্র্রভাষা আন্দোলন, যা উত্তুঙ্গ রূপ পরিগ্রহ করে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে, আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির জগতে তোলে প্রবল অভিঘাত। পূর্ববাংলার সৃষ্টিশীল কবিচৈতন্য অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে শিল্প নির্মাণে আত্মনিমগ্ন হলেন—পূর্ববাংলার কবিতায় দেখা দিল নতুন রূপ, স্বদেশের মুখটা শিল্পিত হতে থাকল নতুন চেতনায়।

এভাবে বিভাগ-পরবর্তীকালে পাকপদ্যের জঞ্জাল থেকে পূর্ববাংলার কবিতাকে যাঁরা উদ্ধার করেছিলেন, শামসুর রাহমান তাঁদের অগ্রগণ্য। কালকে তিনি ধারণ করলেন, তাঁর হাতে শিল্পরূপ পেল কালের গতিধারা—তিনি হয়ে উঠলেন কালের কবিতা-কথক।
আমাদের সংস্কৃতির অন্তর্ভুবনে একুশের মতো প্রভাবসঞ্চারী কোনো অনুষঙ্গ নেই। একুশে বাঙালি কবিকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে, কবিতার পঙিক্তস্রোতে শিল্পিতা পেয়েছে একুশে-উত্তর ভিন্ন এক বাংলাদেশ।

এ প্রসঙ্গে শামসুর রাহমানের কথা বিশেষভাবে আমাদের স্মরণে আসে। একুশকে কেন্দ্র করে বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণ শব্দরূপ পেল রাহমানের কবিতায়। স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন ‘অসুস্থতা আমাকে একুশে ফেব্রুয়ারির মিটিং ও মিছিলের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করেছে সত্য, কিন্তু কেড়ে নিতে পারেনি বাংলা ভাষার প্রতি আমার প্রবল ভালোবাসাকে, কবিতার প্রতি অকুণ্ঠ নিবেদনকে। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস আমার কবিতা রচনায় একটি নতুন বাঁকের জন্ম দেয়’। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে কবি শামসুর রাহমান কবিতার মাধ্যমে গেঁথে দিয়েছেন বাঙালির গভীরতম প্রদেশে।
বাংলা ভাষা আর বর্ণমালা কবির কবিতায় বাঙালির সত্তার সঙ্গী হয়ে শিল্পিতা পেয়েছে :
আজন্ম আমার সাথি তুমি,

আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গড়ে পলে পলে,

তাই তো ত্রিলোক আজ সুনন্দ জাহাজ হয়ে ভেড়ে

আমারই বন্দরে। (বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা)

বায়ান্ন-উত্তর কালে বাঙালির সব দ্রোহ আর সংগ্রামের মাঝেও কবি খুঁজে পান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অবিনাশী চেতনা। কবি তাই নিসর্গলোকের কৃষ্ণচূড়ায় দেখেন একুশের রক্ত, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের দীপ্ত রাজপথে কবি দেখেন বরকত-সালামের স্মৃতি-জ্বলজ্বল মুখ :

আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরেথরে শহরের পথে

কেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলে কখনো-বা

একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়—ফুল নয়,

ওরা শহীদের ঝলসিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।

একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রঙ।

(ফেব্রুয়ারি, ১৯০৯)

বাংলার মুখকে আঁকতে গিয়ে শামসুর রাহমান পৌনঃপুনিক বিচরণ করেছেন বাংলাদেশের দ্রোহী আর রক্তমুখী জাতীয় সত্তায়। বাংলার এই মুখটা সমবেত বাঙালির সমুত্থিত অস্তিত্বের স্মারক। তাই বায়ান্নর উন্মত্থিত জাগরণ উনসত্তরে আমাদের প্রাণের পতাকা করে তোলে আসাদের শার্টকে শহীদ আসাদের শোণিতাক্ত শার্ট স্বাধিকারের পতাকা হয়ে ওড়ে বাঙালির চেতনায়। ইতিহাসের রক্তাক্ত বাঁককে অঙ্গীকার করে এবার কবি আঁকবেন বাঙালির চির-উজ্জ্বল যুদ্ধদিনের মুখ—রক্তে-বারুদে-পৌরুষে-পুরুষাকারে যে মুখ হাজার বছরের বাঙালি কখনো দেখেনি। স্বদেশের রক্তমুখী মুখটা কবিকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা দেয়, নির্জনতাপ্রিয় রোমান্টিক কবিকেও করে তোলে স্বপ্নমুখী যুদ্ধমুখী।

স্বদেশের মৃত্তিকায় সংলগ্ন হয়ে হতাশাকে অতিক্রম করে কবি পৌঁছতে চেয়েছেন সদর্থক জীবনতটে। কিন্তু জাতিক-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার বাংলাদেশ কবিকে কিছুতেই সুস্থির থাকতে দেয় না, তাঁর লেখায় ফুটে ওঠে স্বদেশের বিপন্ন মুখটাই ‘শহরের আনাচে-কানাচে ফেরেশতার ভাঙা/ডানা পড়ে থাকে: কত বিষণ্ন করোটি ফুটপাতে, ঝোপঝাড়ে/ কালোবাজারির বন্ধ গুদামের আশপাশে লুটায় কেবলি’ (এই নবান্নে)। তবু বুকের গভীরে আছে স্বদেশের জন্য কবির গভীরতম ভালোবাসা, আছে অন্তহীন মুগ্ধতা আর অতুল অনুরাগ, তাই শত ষড়যন্ত্র আর সহস্র মারি-মড়কের পরও স্বদেশের মুখটা তাঁর চোখে ধরা দেয় এমন প্রফুল্ল সত্তায় :

তোমার রূপের খ্যাতি পরাক্রান্ত প্রবাদের মতো

এখনও ছড়িয়ে আছে হাটে মাঠে ঘাটে; এখনও তোমার মুখ,

সর্ষে ক্ষেতের মতো মুখ,

সোনালি আঁশের মতো চুল

জেলের ডিঙির মতো ভুরু,

মেঘনার মতো কালো টলটলে চোখ...(বহু কিছু থেকে ছুটি)

শামসুর রাহমান বিশ্বাস করেন ‘সংকটে কবির সত্তা আরো বেশি চিন্তাশ্রয়ী হয়’ (সংকটে কবির সত্তা)। তাই স্বদেশের নানামাত্রিক সংকট, ষড়যন্ত্রের ঘূর্ণিচক্র কবিকে আচ্ছন্ন করলেও করতে পারে না বিপন্ন—তিনি বরং আরো গভীরভাবে স্বদেশকে আঁকড়ে ধরে হতে চান সংকটবিজয়ী। নির্জনতাপ্রিয় কবি এবার জনতার স্রোতে একাত্ম হয়ে মুছে দিতে চান স্বদেশের সংকট, যারা বস্ত্রহরণ করে স্বদেশের মুখটা কালিমালিপ্ত করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান কবি ‘যেদিন তোমার বস্ত্রহরণের পালা/শুরু হলো, তোমার চুলের মুঠি ধরে পৈশাচিক/উল্লাসে উঠল মেতে মদমত্ত বর্বরেরা, সেদিন যাদের/চোখ ক্রোধে রক্তজবা হয়ে উঠেছিল লহমায়,/তোমার গ্লানির কালি মুছে দিতে যারা/হলো শস্ত্রপাণি, আমি তাদের করেছি সমর্থন/সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে’ (দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে)। পৌরাণিক বস্ত্রহরণ পালার বিবরণ শেষে কবি যেন এখানে স্বদেশের মুক্তি হয়েই আত্মপ্রকাশ করেন।

শামসুর রাহমান স্বদেশের যে মুখ তাঁর কবিতায় পৌনঃপুনিক অঙ্কন করেছেন, তা মূলত বিদ্রোহী-বাংলার মুখ। বাঙালির দ্রোহ-চেতনাটাই তাঁকে দিয়ে নিরন্তর কবিতা লিখিয়ে নেয়—এমনই ভাবনা কবির নিজের। তাই যেখানেই আছে দ্রোহ-প্রতিবাদ ক্ষোভ আর যুদ্ধ—সেখানেই মুখর রাহমানের পঙক্তিমালা। এমনি এক দ্রোহী মুখ দেখা দিয়েছিল বাংলার পটে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে নূর হোসেনের অবয়বে সেদিন বাংলার মুখটা দ্রোহে হয়ে উঠেছিল স্বদেশের হৃদয়।

স্বদেশের একটা ইতিবাচক সদর্থক মুখ অঙ্কন কবি শামসুর রাহমানের কবি-প্রতিভার অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য। তিনি বিশ্বাস করেন তাঁর প্রিয় দেশমাতৃকার মুখটা থাকবে বাসন্তী গোলাপের মতো সদা প্রফুল্ল। তাই দেশকে নতুন করে সাজাবার বাসনায় মুখর হয়ে ওঠে তাঁর কবিতা :

কোটি কোটি চোখ

নতুনের স্বপ্নে খুব ডাগর উৎসব। আগামীর

নামে রংবেরঙের প্রজাপতি উড়ুক বাগানে,

কোকিল করুক আজ বসন্তের বিশদ আবাদ।

ফের সাজাব বাগান অপরূপ... (বাগানের গান)

শামসুর রাহমানের কবিতায় স্বদেশের নৈসর্গিক বিমুগ্ধ মুখটাও পৌনঃপুনিক শিল্পিতা পেয়েছে। তাঁর আয়ত প্রসারিত চোখে দেশটা কেবলই অপরূপ হয়ে ধরা দিয়েছে। নিসর্গকে তিনি অঙ্গীকার করেছেন নিবিড় অন্তরঙ্গতায়, শৈশব থেকেই প্রকৃতির লাবণ্যে মুগ্ধ কবি—তাই তিনি লেখেন এই নিসর্গ-বন্দনা ‘মন আমার দিনরাত্রি, বলা যেতে পারে, প্রকৃতির অন্তরঙ্গতায় ছিল ভরপুর। বাড়ির চৌহদ্দিতেই ঘুরে বেড়ানোর মতো যথেষ্ট জায়গা। কত সময় কাটিয়ে দিয়েছি লিচুগাছের ডালে বসে, নেবুতলায় শুয়ে রসালো নেবু পেড়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছের দিকে আস্তে-সুস্থে হেঁটে যেতে যেতে, কখনো কখনো প্রজাপতিদের ওড়াউড়ি দেখে মুগ্ধ হয়েছি।’

শামসুর রাহমান নাগরিক কবি হিসেবেই সমধিক পরিচিত। তাঁর কবিতায় শহর, বিশেষত ঢাকা শহর নানা রূপে বহুমাত্রিক পরিচয়ে শিল্পিত হয়েছে। এই নাগরিক কবিও কিন্তু মর্মে মর্মে বাংলার গ্রামীণ উত্তরাধিকারের সঙ্গে বিজড়িত-শহর আর গ্রামীণ বাস্তবতাতেই কবি শনাক্ত করেন নিজেকে। শাহরিক বাস্তবতায় বাস করলেও তিনি বিস্মৃত নন গ্রামীণ উত্তরাধিকার। তাই ‘আমার অন্তর জুড়ে শহুরে-গ্রামীণ সুরধারা’ কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেন সত্তার দ্বৈত-উৎস : ‘শেষরাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি চাঁদ/হাসছে কৌতুকে এই শহুরে লোককে দেখে, যার/সমস্ত শরীর ফুঁড়ে কি সহজে বেরুচ্ছে গ্রামীণ রূপ/আমার অন্তর জুড়ে শহুরে গ্রামীণ সুরধারা।’

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor