মিসরের লোকেরা এখন দেশটির গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধান মেজর জেনারেল আব্বাস কামেলকে আবার কেন নিয়োগ দেওয়া হলো, তা নিয়ে বিতর্কে মেতেছেন। কামেল ছিলেন প্রেসিডেন্ট ফাত্তাহ আল-সিসির ডান হাত, তাঁর গোপনীয়তার রক্ষক এবং মৃত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গী ছিলেন।
১০ বছর ধরে কামেলের ডাকনাম ছিল ‘ছায়া প্রেসিডেন্ট’। সংবেদনশীল নথিগুলো তাঁর কাছেই পাঠানো হতো। হঠাৎ করেই সিসি তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ায় সবাইকে হতবাক করেছে।
কামেলকে এখন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ও বিশেষ দূত এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এটা পদোন্নতি নাকি পদাবনতি, সেটা নিয়ে বিভ্রান্তির জন্ম হয়েছে।
নতুন এই পদের দায়িত্ব কী হবে, কাজের পরিধি কী হবে, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। কামেল ২০১৮ সালে পর্যন্ত মিসরের জেনারেল ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস বা সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ছিলেন। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হিসেবে কাজ করার সময় তিনি আল-সিসির কার্যালয়ের পরিচালক হয়েছিলেন।
কামেলকে তাঁর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে নতুন দায়িত্বে দেওয়ার ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। ২০১৩ সালের সামরিক অভ্যুত্থানে সিসিকে যাঁরা সমর্থন দিয়েছিলেন, তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত এটি। সেই জেনারেলদের কেউই এখন আর গুরুত্বপূর্ণ পদে নেই।
আল-সিসি তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে সেদকি সোভি ও মোহামেদ জাকিকে সরিয়ে দিয়েছেন। সেনাপ্রধানের পদ থেকে মাহমুদ হেগাজি, মোহামেদ ফরিদ ও ওসামা আসকারকে সরিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান থেকে মোহামেদ এল-তোহামি ও খালেদ ফাওজিকে সরিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা সবাই-ই অভ্যুত্থানের সময় তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন।
এর মাধ্যমে আল-সিসি তাঁর শাসনকে যেমন কণ্টকহীন করতে চাইছেন, একই সঙ্গে সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে মাহমুদ আল-সিসির জন্য পথ তৈরি করতে। আল-সিসির উত্তরসূরি হিসেবে যে ব্যক্তিটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন, তিনি হলেন আব্বাস কামেল।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আল-সিসি আরেকটি হতবাক করা সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাঁর ১১ উপদেষ্টাকে সরিয়ে দেন।
আল-সিসি শুধু সামরিক ব্যক্তিদের দরজা দেখিয়ে দিচ্ছেন না। যেসব উদারপন্থী, বামপন্থী ব্যক্তি ও দল এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সিসির ক্ষমতা সংহত করতে সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁদের সবাইকেই তিনি উৎখাত করেছেন।
তাঁদের হয় কারাগারে পাঠিয়েছেন, না হয় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন অথবা কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে।
এসব লোক ২০১৩ সালের ৩০ জুন থেকে প্রতিবাদ সংগঠিত করতে এবং মুসলিম ব্রাদার হুডের শাসন উৎখাত করতে এবং ২০১৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্যন্ত আল-সিসিকে সহায়তা করেছিলেন।
আল-সিসি তাঁর তিন ছেলে মাহমুদ, হাসান ও মোস্তফাকে প্রভাবশালী সংস্থাগুলোর উচ্চপর্যায়ে বসিয়েছেন। এ কাজের পক্ষে থাকা তাঁর বিশ্বস্ত মিত্রের সংখ্যা খুবই কম। মাহমুদ আল-সিসি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার উপপরিচালক। প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় পুত্র হাসানও একই সংস্থায় কাজ করেন। মুস্তাফা বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কন্ট্রোল অথরিটিতে কাজ করেন।
এই সবকিছু প্রেসিডেন্ট করছেন তাঁর জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য।
গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা সংস্থার নির্দিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তির ক্রমাগত প্রভাব বেড়ে যাওয়া এবং একই পদে দীর্ঘদিন তাঁদের থাকাটাকে আল-সিসি হুমকি বলে মনে করেন। সিসি ভয় পান, এই লোকেরা শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে না আসে। গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আসা একজন ব্যক্তির সহজাত স্বভাব এমনটা হওয়াটা স্বাভাবিক। বিশেষ করে এমন একটি দেশ, যেখানে কিনা ১৯৫২ সালের জুলাই মাস থেকে সামরিক শাসন চলছে। যেখানে জেনারেলদের প্রেসিডেন্ট হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে।
সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে মিসরের প্রেসিডেন্ট তাঁর ‘গোপন মন্ত্রিসভা’ (কামেলের আরেকটি ডাকনাম) খালি করতে চাইতে পারেন। সরকারি কাজের সূত্রে তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে পড়া লোকদের থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইতে পারেন। এই ফাঁকে আল-সিসি একটি বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে তোলার কাজ করতে পারেন। যে নেতৃত্ব হবে তাঁর আরও অনুগত এবং প্রেসিডেন্টের সম্ভাব্য উত্তরসূরি মাহমুদ আল-সিসিরি আরও ঘনিষ্ঠ।
সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা মিসরের সবচেয়ে শক্তিশালী সংস্থা।
রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও গণমাধ্যম ও অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে সংস্থাটির অনেক বড় নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তাদের বড় বিনিয়োগ রয়েছে ও বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের অধিকারী তারা। পার্লামেন্ট অথবা বিচার বিভাগের তদারকি অথবা জবাবদিহির করতে হয় না। তাদের বাজেটে কোনো নিরীক্ষা হয় না।
কামেলকে দায়িত্ব থেকে অন্য পদে নিয়ে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। অনেকে মনে করেন, জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রে আদালতে সাবেক সিনেটর বব মেনেনদেজের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে কামেলকে সরিয়ে দেওয়ার যোগসূত্র আছে। মিসর সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা মেনেনদেজ ঘুষ কেলেঙ্কারিতে আমেরিকান একটি আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন।
অন্য পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কায়রো সফরের সঙ্গে এ ঘটনার সংযোগ আছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোহামেদ হুসেইন আমাকে বলেছেন, মিসরের সার্বভৌম সংস্থাগুলোর মধ্যে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি এমন নয় যে তাতে সংঘাত বেধে যাবে। এরপরও আল-সিসি নিরাপত্তা সংস্থাগুলো পুনর্গঠন ও রদবদল করেছেন, এবং সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন।
এর মাধ্যমে আল-সিসি তাঁর শাসনকে যেমন কণ্টকহীন করতে চাইছেন, একই সঙ্গে সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে মাহমুদ আল-সিসির জন্য পথ তৈরি করতে। আল-সিসির উত্তরসূরি হিসেবে যে ব্যক্তিটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন, তিনি হলেন আব্বাস কামেল।
যা–ই হোক কেন, কামেলকে তাঁর আগের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ায় সবচেয়ে বেশি লাভ হলো মাহমুদ আল-সিসির। যেভাবেই হোক, চূড়ান্তভাবে আল-সিসির ছেলের ভবিষ্যৎ নিরাপদ বলেই মনে হচ্ছে।
Publisher & Editor