যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর অনেকটা নাটকীয় প্রত্যাবর্তন ঘটেছে তার। প্রায় সব সুইং স্টেটে তিনি জয়ী হয়েছেন। কিন্তু কী কারণে তিনি এত সহজে জয় পেলেন, তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। বেশির ভাগ মার্কিন ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী তার জয়ের বড় কারণ হলো—মার্কিন অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা। এই ইস্যুতে ট্রাম্প সবচেয়ে বেশি ভোটারকে আকৃষ্ট করতে পেরেছেন।
বিবিসির এক খবর অনুযায়ী এবারের নির্বাচনে অর্থনীতিই ছিল ভোটারদের কাছে এক নম্বর ইস্যু। বেশির ভাগ আমেরিকান বলছিলেন, তারা নিত্যদিন উচ্চ দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে লড়ছেন। ১৯৭০-এর দশকের পর এখনকার মতো মূল্যস্ফীতি তারা দেখেননি। উচ্চ দ্রব্যমূল্যের কারণে ২০২৪ সালে অনেক দেশে ভোটাররা ক্ষমতাসীন দলকে ছুড়ে ফেলেছে। মার্কিন ভোটাররাও পরিবর্তনের জন্য মুখিয়ে ছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এবার ভোট দিয়ে তারা জো বাইডেন প্রশাসনের নীতি প্রত্যাখ্যান করেছেন। আর ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস নিজেকে বাইডেন প্রশাসন থেকে আলাদা করতে পারেননি।
কমলা হ্যারিস অবশ্যই এই নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চেয়ে অনেক ভালো পারফরম করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো যে, অর্থনৈতিক যন্ত্রণা মার্কিনীদের নজর তার থেকে সরিয়ে দিয়েছে। বেশির ভাগ মার্কিনী মনে করেন, তারা চার বছর আগে ট্রাম্পের আমলেই ভালো ছিলেন। এই উপলব্ধি তাদেরকে ট্রাম্পমুখী করেছে।
নারী হওয়াটা সম্ভবত কমলার জন্য একটি বড় প্রতিকূলতা ছিল। তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনীত প্রার্থী হওয়ার পর থেকে একটি অসামাজিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। ট্রাম্পের প্রচারণাশিবির থেকে প্রতিনিয়ত তাকে অবমাননা করা হয়েছে। হ্যারিস তার প্রচারণার শুরু থেকেই গর্ভপাত ইস্যুকে সামনে এনেছেন। কিন্তু ট্রাম্পের অর্থনীতির ইস্যু কমলার গর্ভপাত ইস্যুকে ছাপিয়ে গেছে। কারণ অর্থনীতি এমন একটি বিষয়, যা মানুষ প্রতিদিন মোকাবিলা করছে। অভিবাসনের ক্ষেত্রেও একই কথা চলে। এটি ভোটে তেমন বড় ভূমিকা পালন করেনি, যতটা ট্রাম্প শিবির প্রত্যাশা করেছিল। এসব ইস্যুর পরিবর্তে শেষ পর্যন্ত অর্থনীতিই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।
এবারের নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে লাতিনরা। লাতিনদের মধ্যে ট্রাম্পের ভোট বেড়েছে। বুথফেরত জরিপগুলো বলছে, পুয়ের্তো রিকোকে নিয়ে বর্ণবাদী কৌতুকের পরও লাতিন ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা কমেনি। এর কারণ সামাজিকভাবে প্রান্তিক পর্যায়ে থাকা লাতিনরা মূল্যস্থিতি ও অর্থনৈতিক সংকোচনে বড় ধাক্কা খেয়েছে।
আরেকটি বুথফেরত জরিপ বলছে, বড় সংখ্যায় আফ্রিকান-আমেরিকানের ভোট পেয়েছেন ট্রাম্প। অথচ এসব ভোটারের প্রায় সব ভোটই অতীতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের ঝুলিতে গেছে। ট্রাম্প এবার লাতিন এবং আফ্রিকান-আমেরিকানদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, রিপাবলিকান পার্টিতে তাদের জন্য একটি জায়গা রয়েছে, এটি কেবল শ্বেতাঙ্গদের দল নয়। কমলা হ্যারিস তরুণদের মধ্যে জিতেছেন, কিন্তু এক্ষেত্রে তার জয়ের ব্যবধান ২০২০ সালে জো বাইডেনের মতো বড় ছিল না।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের এক নিবন্ধ অনুযায়ী, কমলা হ্যারিসের পরাজয়ের একটি কারণ হচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেনকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেওয়াটা অনেক মার্কিনির কাছে পছন্দের নয়। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনির গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন চললেও তা বন্ধে জো বাইডেন প্রশাসনের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ অনেক মার্কিনী, বিশেষ করে আরব-আমেরিকানরা। ট্রাম্প শেষ মুহূর্তে সুইং স্টেটগুলোতে প্রচারণায় ক্ষুব্ধ আরব-আমেরিকানদের কাছে টানার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। এছাড়া আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সময় সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার জন্যও রিপাবলিকানদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে বাইডেন প্রশাসন তথা কমলা হ্যারিসকে।
অনেক ইতিহাসবিদ হয়তো বলবেন—ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন অলৌকিক ঘটনা। কিন্তু ভোটাররা মনে করেছেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পই ভালো ছিলেন, আর বাইডেন তাদের জন্য বিষণ্ণতা, আর্থিক যন্ত্রণা বাড়িয়েছেন। তাতে সহায়তা করেছেন কমলা হ্যারিস। তাই মার্কিন ভোটাররা আবারও ট্রাম্পকেই ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
Publisher & Editor