তৃণমূলের সঙ্গে ছিল দূরত্ব
বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আমির হোসেন আমু তৃণমূল থেকে জাতীয় রাজনীতির চূড়ায় পৌঁছান। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার পরে তাঁকে প্রভাবশালী নেতা হিসেবে গণ্য করা হয়। অথচ ভোটের রাজনীতিতে নিজ নির্বাচনী এলাকায় আমুর গ্রহণযোগ্যতা ছিল তলানিতে।
ঝালকাঠির বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাধীনতার পরপরই লবণ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে আমু পরিচিতি পান ‘লবণ চোর’ নামে। তাঁর নাক উঁচু স্বভাবের কারণে তৃণমূল মানুষের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলতেন। দল কুক্ষিগত করে রাখা, উন্নয়নকাজে কমিশন আদায়, মনোনয়ন বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগে নেতাকর্মীর বড় অংশ ভেতরে ভেতরে তাঁকে অপছন্দ করতেন। যে কারণে ঝালকাঠি-২ (সদর-নলছিটি) আসনে একাধিকবার জামানত হারানোর মতো লজ্জাজনক পরাজয়ের ইতিহাস রয়েছে এ জাতীয় নেতার।
আমু টুঙ্গিপাড়া শেখবাড়ির বঙ্গবন্ধুর নিকটাত্মীয়কে বিয়ে করেছেন। এ সুবাদে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফা হন। আমু নিঃসন্তান; স্ত্রী মারা গেছেন। ভাইবোনও নেই। সে হিসেবে তাঁর মৃত্যুর পর কোনো উত্তরসূরি থাকবে না। অথচ তাঁর অর্থ ও সম্পদের লোভ অবাক হওয়ার মতো।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন তাঁর বাসা লুটপাটের পর নগদ ৫ কোটি টাকা পাওয়া যায়। গতকাল বুধবার তাঁর গ্রেপ্তারের খবরে ঝালকাঠি শহরে মিষ্টি বিতরণ ও আনন্দ মিছিল করেছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা।
আমুর নির্বাচনী ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, স্বাধীনতা-উত্তর আওয়ামী লীগ এই পর্যন্ত যত নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, সবগুলোতে প্রার্থী হয়েছেন আমু। তবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়েছেন মাত্র একবার। সেটি ছিল ২০০৮ সালে। এর বিপরীতে ১৯৭৯ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত অংশগ্রহণমূলক পাঁচটি নির্বাচনে টানা হারেন তিনি। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে দুটি করে আসনে প্রার্থী হয়েও জয়ের নাগাল পাননি। ১৯৯৮ সালে ঝালকাঠি-২ আসনের তৎকালীন জাপা এমপির মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে আমু এমপি হয়েছিলেন। তখন তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ছিলেন।
যেভাবে ‘লবণ চোর’
বরিশালের প্রবীণ সাংবাদিক মানবেন্দ্র বটব্যাল বলেন, এক সময় দেশে লবণের চাহিদার বড় অংশ উৎপাদন হতো ঝালকাঠিতে। ১৯৭৪ সালের দিকে দেশে লবণের আকাল দেখা দিলে দাম মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। রান্নায় নারিকেল গাছের ডোগার রস দিয়ে লবণের চাহিদা মেটাত অভাবী মানুষ। তখন এই পরিস্থিতির জন্য আমুকে দায়ী করে সাধারণ মানুষ তাকে ‘লবণ চোর’ ডাকা শুরু করে, যা পরে তাঁর ভোটের রাজনীতিতেও প্রভাব পড়ে। ঝালকাঠির বাসিন্দারা জানান, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে আমুর নির্বাচনী জনসভায় প্রতিপক্ষের সমর্থকরা বাঁশের কঞ্চির মাথায় লবণের পোঁটলা বেঁধে তাঁকে ভর্ৎসনা জানাত।
অর্থবিত্তে ভরপুর আমু
১৯৯৬, ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচন-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারে আমু যথাক্রমে খাদ্য ও শিল্পমন্ত্রী ছিলেন। এ সময়ে দলের পাশাপাশি সব পর্যায়ে তিনি ছিলেন দোর্দণ্ড প্রভাবশালী। ঝালকাঠিতে আমুর কথা ছাড়া কিছুই হতো না। নিয়োগ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য, দরপত্র, চাঁদাবাজিসহ নানা খাতের অবৈধ আয়ে তিনি যেমন অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন, অনুসারী ঝালকাঠির ১২ নেতাও বনে গেছেন কোটিপতি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন– জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক রেজাউল করিম জাকির, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক নুরুল আমিন সুরুজ ও তরুণ কর্মকার, কোষাধ্যক্ষ মনিরুল ইসলাম তালুকদার, যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক কামাল শরীফ, সদর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাফিজ আল মাহমুদ। প্রয়াত স্ত্রী ও মায়ের নামে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের পর প্রতিষ্ঠানসংলগ্ন জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে আমুর বিরুদ্ধে।
ঝালকাঠি জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান মুবিন বলেন, আমু আইনজীবী সমিতি কবজায় রাখতে আব্দুল মন্নান রসুলকে টানা ১৫ বছর পিপি পদে রাখেন। ১২ বছর মন্নান রসুলকে জেলা বারের সভাপতি পদে বিনা ভোটে নির্বাচিত করে রাখা হয়। বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের নির্বাচন থেকে বিরত রাখতে বোমা ফাটিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন আমু।
সব উন্নয়নকাজে তাঁকে দিতে হতো ১০ শতাংশ কমিশন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, কাবিখা, কাবিটাসহ বিভিন্ন ছোট ছোট প্রকল্প এমনকি বিভিন্ন অফিসে সুইপার নিয়োগেও আমুর পকেটে যেত টাকা। ব্যাংকের সিলমোহরযুক্ত টাকার বান্ডিল ছাড়া তিনি কমিশনের টাকা নিতেন না। নলছিটি পৌর কাউন্সিলর ফিরোজ আলম খানের ছেলে শাওন খান আমুর ঢাকা ইস্কাটনের বাসায় কম্পিউটার অপারেটরের কাজ করতেন। নিয়োগের উৎকোচ ও প্রকল্প অনুমোদনের কমিশনের টাকা শাওনের মাধ্যমে নেওয়া হতো। সেই শাওন খান এখন কোটিপতি।
থাকতেন না ঝালকাঠিতে
আমুর আদিনিবাস ঝালকাঠির শেখেরহাট গ্রামে। তবে বাবার চাকরি সূত্রে তাঁর শৈশব ও কলেজ জীবন কেটেছে বরিশালে। নগরের বগুড়া সড়কে এখন যেখানে অপসো স্যালাইন কারখানা, সেটাই ছিল তাঁর পৈতৃক বাড়ি। ওষুধ প্রস্তুতকারী অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান অপসোনিন গ্রুপের বর্তমান মালিক সহোদররা আমুর আপন খালাতো ভাই। আশির দশকের পর অপসোনিন গ্রুপের দ্রুত উত্থানের নেপথ্যে আমু– এমন জনশ্রুতি আছে। ঝালকাঠি শহরে রোনালস রোডে আমুর একটি চার তলা ও একটি দোতলা বাড়ি রয়েছে। তবে এ বাড়িতে কোনোদিন রাত যাপন করেছেন কিনা, তা কারও জানা নেই। নির্বাচনী এলাকায় গেলে দিনে থাকতেন ঝালকাঠির বাসায়, রাত যাপন করতেন বরিশাল নগরের বগুড়া সড়কে অপসোনিন গ্রুপের বাসায়।
ডুবিয়েছেন ব্যারিস্টার ওমরকে
ঝালকাঠির সংসদীয় আসন দুটি। ছোট জেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী বড় দুটি দলের দুই শীর্ষ নেতা নির্বাচন করতেন। ঝালকাঠি-২ আমুর এবং ঝালকাঠি-১ বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের (বীরউত্তম) আসন হিসেবে পরিচিত ছিল। গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি ছেড়ে ওমরের আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার বিষয়টি ছিল রাজনীতির বড় চমক। হামলা-ভাঙচুর মামলায় গত ২৯ নভেম্বর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েই ঝালকাঠি-১ আসনের মনোনয়ন পেয়ে শোরগোল ফেলেন ওমর।
গত ২০ ডিসেম্বর রাতে নগরের বগুড়া সড়কে আমুর বাসায় তাঁকে পাশে বসিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ওমর। দলত্যাগের পেছনের ঘটনা বলতে গিয়ে ওমর বলেন, কারাগার থেকে বের হওয়ার পর আমু তাঁকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
নলছিটিতেও ভয়ংকর
নলছিটি (ঝালকাঠি) প্রতিনিধি জানান, নলছিটির কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসংলগ্ন এলাকায় মেডিকেল রোডের পাশে বিতর্কিত জমিতে আমুর রয়েছে তানিম ভবন নামে ৫ কাঠার ওপর একতলা ভবন। এই ভবনে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিনি অফিস হিসেবে ব্যবহার করতেন। নলছিটিতে অযোগ্য ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে আমুর বিরুদ্ধে। নলছিটিতে আমুর ছিল ক্যাডার বাহিনী। এদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেত না।
Publisher & Editor