কোনো কোনো মানুষকে জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে নিজেকে প্রমাণ দিতে হয়। নিজের সামর্থ্য ও সক্ষমতা প্রমাণে পাড়ি দিতে হয় কঠিন পথ। বাধাহীন কিংবা নিষ্কণ্টক জীবন বলে তাঁদের জন্য কিছু হয় না। সেই গোত্রের মানুষের তালিকায় অনায়াসে রাখা যেতে পারে ভিক্টর গয়োকেরেসকে।
পরশু রাতে চ্যাম্পিয়নস লিগ অনুসরণ করলে নামটির সঙ্গে এতক্ষণে পরিচয় হওয়ার কথা। লিসবনে ম্যানচেস্টার সিটিকে ৪–১ গোলে উড়িয়ে দেওয়ার পথে হ্যাটট্রিক করেছেন স্পোর্তিং লিসবনের এই সুইডিশ স্ট্রাইকার।
গয়োকেরেসকে অবশ্য এক ম্যাচ দিয়ে মূল্যায়ন করার সুযোগ নেই। এমন নয় যে গতকাল রাতেই লিসবনের জোসে আলাভাদো স্টেডিয়ামে ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটেছে তাঁর। বরং এটুকু পথ পাড়ি দিতে গয়োকেরেসকে অতিক্রম করতে হয়েছে কঠিন সব চ্যালেঞ্জ।
তবে এটাও ঠিক যে পরশুর পারফরম্যান্স দিয়ে যে অল্প কিছু সমালোচক বাকি ছিলেন, তাঁদের মুখও চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছেন এই স্ট্রাইকার। সিটির বিপক্ষে হ্যাটট্রিক তো আর প্রতিদিন হয় না। যতই নামের পাশে দুটি পেনাল্টি গোলের কথা লেখা থাকুক, তবু গয়োকেরেস ছিলেন অনন্য।
গয়োকেরেসের ক্যারিয়ার বিশেষভাবে মোড় নিতে শুরু করে ২০২৩ সালে লিসবনে আসার পর থেকে। সে মৌসুমে ৬৭ ম্যাচে তিনি করেছিলেন ৬৬ গোল। এরপর চলতি মৌসুমে গয়োকেরেস যেন আরও অপ্রতিরোধ্য। এরই মধ্যে ১৭ ম্যাচে করেছেন ২৩ গোল। এগুলো নিছক কোনো সংখ্যা নয়। এসব সংখ্যা একজন তথাকথিত ‘বাতিল’ ফুটবলারের দেওয়া জবাব, যা তাঁর সামর্থ্যের পক্ষে সাক্ষ্যও দেয়।
সিটির বিপক্ষে হ্যাটট্রিকের পর নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে উয়েফাকে গয়োকেরেস বলেছেন, ‘গোল করা সব সময় আনন্দের। তবে হ্যাটট্রিক করা আরও বেশি ভালো ব্যাপার। আপনি যখন ভালো প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলবেন, তখন আপনাকে নিজের মানটাও বাড়াতে হবে। আমি যা করছি, সেটা আমি সব সময় করার চেষ্টা করেছি।’
সাম্প্রতিক সময়ের দারুণ পারফরম্যান্সের জেরে এরই মধ্যে তাঁর দিকে হাত বাড়িয়েছে ইউরোপের শীর্ষ ক্লাবগুলো। যেখানে তাঁর সদ্য সাবেক কোচ রুবেন আমোরিমের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডও আছে। গুঞ্জন আছে, জানুয়ারির দলবদলে তাঁকে কিনে নেবে ইউনাইটেড। যদিও সে সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন আমোরিম নিজেই।
তবে জানুয়ারিতে না হলেও মৌসুম শেষে তাঁকে নিয়ে নিশ্চিতভাবে কাড়াকাড়ি হবে। তখনো অবশ্য গয়োকেরেসের মূল লক্ষ্য থাকবে ইউনাইটেডে গিয়ে আমোরিমের সঙ্গে যোগ দেওয়া, যেখানে দলের প্রধান স্ট্রাইকার হিসেবে বড় দায়িত্ব থাকবে তাঁর কাঁধে।
গয়োকেরেসের দলবদল নিয়ে সাবেক ইংলিশ উইঙ্গার আন্দ্রোস থাউজেন্ড বলেছেন, ‘তাঁর বর্তমান কোচের (আমোরিম) ক্লাবসহ এমন কিছু ক্লাব আছে যারা তাকে চায়। তারা ভাবছে ছেলেটি দারুণ কিছু করতে পারে। বড় দলগুলোতে তার নাম লেখানো এখন শুধুই সময়ের ব্যাপার।’
এত দূর আসার পথটা অবশ্য গয়োকেরেসের জন্য কখনোই এত সহজ ছিল না। এমন নয় যে ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তাঁর প্রতি এতটা মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল। ২০২১ সালে কভেন্ট্রি সিটিতে আসার আগপর্যন্ত অখ্যাত এক নামই ছিলেন গয়োকেরেস। ইংলিশ ক্লাবটিতে আসার পরই মূলত বদলে যায় চিত্র। ক্লাবটির চ্যাম্পিয়নশিপের প্লে–অফ ফাইনালে খেলার পথেও বেশ সহায়তা করেছিলেন এই স্ট্রাইকার।
এর আগে গয়োকেরেস তাঁর পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করেন আইএফ ব্রোমাপোইকারনাতে। দুই বছর এই ক্লাবে থাকার পর চলে যান ইংলিশ ক্লাব ব্রাইটনে। ক্লাবটির হয়ে মাত্র চারটি ম্যাচে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। এ ছাড়া বেশির ভাগ সময় ধারে খেলেই সময় কাটতে থাকে তাঁর। সে সময় তিনটি ক্লাবে ধারে খেলেছেন গয়োকেরেস, সোয়ানসি সিটি, সেন্ট পাউলি ও কভেন্ট্রি। পরে কভেন্ট্রিই পাকাপাকিভাবে কিনে নেয় তাঁকে। বারবার ক্লাব বদলানোর এই ধারা বলে দিচ্ছে তাঁর ওপর সে সময় আস্থা রাখতে পারেনি কেউই। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কভেন্ট্রির দেওয়া সুযোগকে দারুণভাবে কাজে লাগান গয়োকেরেস।
শুরু থেকেই গয়োকেরেসের পথচলা কতটা কঠিন ছিল সেটা বোঝা যায় তাঁর কৈশোরের ক্লাব ব্রোমাপোইকারনাতে স্কাউট ডেভিড একলুন্দের কথায়, ‘যখন আমি তাকে ব্রোমাতে নিয়ে যাই তখন তাঁর বয়স ১৪।
কিন্তু একাডেমি প্রধান বললেন, সে যথেষ্ট ভালো নয়। আমি তাঁকে বললাম, সে গোল করতে পারবে। আমি তখন প্রথম দেখেছিলাম ১১ বছর বয়সে এবং সে একজন ভালো স্ট্রাইকার। সে কখনোই দেজান কুলুসেভেস্কির (ব্রোম থেকে বেরিয়ে আসা আরেক তারকা) মতো সুপারস্টার না। তবে সে গোল করতে পারে। এটাই জরুরি।’
সেই দ্বিধা–দ্বন্দ্বের দোলাচল থেকেই প্রবল আত্মবিশ্বাস, ক্ষুধা এবং পারিবারিক সমর্থন গয়োকেরেসকে ধীরে ধীরে তৈরি করে নিয়ে এসেছে আজকের দিনে। তবে আমোরিমের অধীনে খেলে এই ফুটবলার যে আরও ক্ষুরধার তাও স্বীকার করতে হবে। আর এখন তো তাঁকে নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হওয়ার অপেক্ষা।
তবে এটা তো কেবল শুরুও। সামনের দিনগুলোয় আরও কঠিন পথ অতিক্রম করতে হবে এই তরুণকে। অতীত অবশ্য বলছে, চাপ সামলানো তাঁর জন্য তেমন কোনো ব্যাপার না। এখন অপেক্ষা শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়ার।
Publisher & Editor