হেমন্তিকা এক অপূর্ব, অথচ বিষাদময় মানবী। তার হৃদয়ে জমে আছে অবহেলার মেঘের পাহাড়। হেমন্তিকার নীরবতা নদীপারের শীতল বাতাসের মতো তাকে একা করে তোলে। শত শত বছর ধরে চর্যাপদ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলী, মঙ্গলকাব্য, মেঘদূত, গীতাঞ্জলি, অগ্নিবীণার শত শত পাতায় সে তার নিজস্ব অস্তিত্ব খুঁজে বেড়িয়েছে, কিন্তু কোথাও সে তার নিজেকে গভীরভাবে দেখতে পায়নি।
চার্যাগীতি, বৈষ্ণব কবিদের কীর্তন, পূজা-পার্বণের উৎসকথা—এসব যেন হেমন্তিকার শূন্যতা আরো বাড়িয়ে তুলেছে। একদিন আনমনে হাঁটতে হাঁটতে হেমন্তিকা চলে যায় শিলাইদহে, পদ্মার পারে, যেখানে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর জমিদারি কাজ নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু বকুলতলার ফুলের গন্ধে মন ডুবে ছিল প্রকৃতির সৌন্দর্য আর সাহিত্য সৃষ্টির গভীরে। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ কুঠিবাড়ির বারান্দায় বসে পদ্মার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
তিনি পদ্মার ধূসর জলে বয়ে যাওয়া নৌকার পাল আর নদীর স্রোতের মৃদু শব্দ নিবিড় হয়ে শুনছিলেন। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি পড়ল এক অপরূপা নারীর দিকে, যার চোখে ছিল এক অদ্ভুত বিষাদ, আর তার পদক্ষেপে ছিল এক নিঃশব্দ অভিমান। রবীন্দ্রনাথ এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘তুমি কে? পদ্মার ঢেউয়ের মতো নীরবতা নিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছ, আমি কি তোমায় চিনি?’
হেমন্তিকা বলে, ‘প্রকৃতি যখন মুগ্ধতা ছড়ায়, আকাশের রং বদলে ফেলে এবং পৃথিবীকে স্নিগ্ধতার এক মোহনায় নিয়ে আসে, তখন আমি আসি। আমার গায়ে ঝরে পড়া শুকনো পাতার মৃদু মর্মর, আমার চুলের ভেতরে লুকিয়ে থাকে শিউলি ফুলের গন্ধ।
আমি হেমন্তিকা, প্রকৃতির গভীর বেদনা আর আনন্দের মিশ্রণে আমার জন্ম।’ হেমন্তিকা পদ্মার দিকে তাকিয়ে থাকে জল-থইথই চোখে। তার কণ্ঠে এক ধরনের নীরব অভিমান ভেসে উঠল রবীন্দ্রর প্রতি : ‘তুমি শরতের উচ্ছ্বাসে ভেসেছ, বসন্তের আনন্দে গান গেয়েছ রবি। কিন্তু আমি—আমি তো সেই ঋতু, যাকে সবাই ভুলে যায়। আমার আকাশে নেই রঙের ছটা, আমার মাঠে নেই ফুলের সমারোহ।
তোমার সৃষ্টিতে আমি কমই স্থান পেয়েছি। অন্য ঋতুদের নিয়ে তুমি অনেক গেয়েছ, কিন্তু আমার বিষাদমাখা দিনের কথা কি তোমার হৃদয় স্পর্শ করেনি?’
রবীন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর বলেন, ‘তোমার মধ্যে যে নীরবতা, তা তো আমার মনের সুরের সঙ্গে মিলে যায়। হেমন্তিকা, তোমার নীরব সৌন্দর্য, মিষ্টি হিমেল হাওয়া, আর ফসলের ঝলমলে মাঠের মধ্যে আমি এক ধরনের শুদ্ধতা খুঁজে পাই। তোমাকে আমি লক্ষ্মী বলেছি, কারণ তুমি পৃথিবীর কোলে সমৃদ্ধি এনে দাও। কিন্তু সেই সমৃদ্ধি যেমন অন্তর্মুখী, তেমনি তোমার নীরবতাও গভীর। তোমার স্পর্শে প্রকৃতি শান্ত হয়ে যায়।’
হেমন্তিকার কণ্ঠে বিষাদ নীল, ‘তুমি আমাকে পছন্দ করো না, তাই না?’
সাদা ধূতি-পাঞ্জাবির অপাট রবীন্দ্রনাথ অলোকগুচ্ছে হাত বুলিয়ে বলেন, ‘তোমার নীরবতা আমি অনুভব করেছি, আর তাই তোমার সৌন্দর্যও আমি গেয়েছি। তোমাকে শোনাব? বলেই গান ধরলেন—‘হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে/হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে...’
গান শেষ করে রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে হেমন্তিকার দিকে তাকালেন। প্রকৃতির সঙ্গে রবির এই গভীর সংযোগ, সেই বোধে হেমন্তিকা বিষাদমাখা চোখ তৃপ্তি খোঁজে। এরপর হেমন্তিকা রবির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আরেক শূন্যতার পথে যাত্রা করে।
রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে ফিরে এসেই হেমন্তিকা ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার একান্ত কাজে, কারণ প্রকৃতিজুড়ে চলছে পূজা-পার্বণের উৎসব। কার্তিক পূজা—সব কিছু যেন তার আশপাশে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। নদীর তীর ধরে বণিকদের কোলাহল, বন্দরে ভিড় করে থাকা নৌকা আর বারাঙ্গনাদের হাসির আড়ালে লুকানো বিষাদ—এসব দৃশ্য তাকে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত রাখে। আকাশপ্রদীপের আলোয় পূর্বপুরুষদের স্মরণ করা এবং সেই মৃদু হাওয়ার সঙ্গে মিশে থাকা হেমন্তের স্নিগ্ধতা—সব কিছুর মাঝেই সে যেন তার নিজের পরিচয় খুঁজে পায়। তবু, উৎসবের এই আনন্দমুখর সময়েও, হেমন্তিকার মনের গভীরে বয়ে যায় এক অনাবিল বিষাদ, যা কেউই পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারে না।
সে জন্যই হেমন্তিকা আর এসব পূজার সঙ্গে মিশে থাকে না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে দূরে, তার স্নিগ্ধ শিশিরভেজা বুকের ভেতর জমে থাকে এক অচিন্ত্য ব্যথা। তাকে ঘিরে থাকে আয়োজন, কিন্তু সেই আয়োজনের ভেতরে তার মনের গভীর একাকিত্ব। তার স্নিগ্ধতা, তার বেদনা যেন এক অনুচ্চারিত কাব্য। চুপচাপ দূরে গিয়ে বসে, সেখানে কোলের ওপর ঝরে পড়ছে মধুমঞ্জরি, দেবকাঞ্চন, রাজ অশোক।
কলকল করে যেন বয়ে চলছে গোমতীও ঝিকিমিকি রোদ-তারায়। হঠাৎ ঝড়ের মতো শব্দ : ‘শূন্য ছিল নিতল দীঘির শীতল কাল জল, কেন তুমি ফুটলে সেথা ব্যথার নীলোৎপল?’
হেমন্তিকা তাকিয়ে দেখে নজরুল। তাঁর চাহনিতে বিদ্রোহ, উত্তাল গোমতীর চরাচর। একটু সাহস নিয়ে বিষাদমাখা কণ্ঠে অনুযোগ করল, ‘তুমি তো বিদ্রোহী কবি, তোমার কলমে বিপ্লব, প্রেম, প্রকৃতি—সবই। কিন্তু আমি হেমন্তিকা, আমার বিষাদ, আমার নীরব সুর কই?’
নজরুল হেসে বললেন, ‘তুমি জানো, হেমন্তিকা, আমি বিদ্রোহের কবি, আমার সুরে বেজে ওঠে প্রতিরোধ আর বিপ্লবের ডাক। কলমের কালিতেও আগুন। কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে আমার আত্মার মিল আছে। হ্যাঁ, আমি নবান্নের কথা লিখেছি, অঘ্রানের ধানের গন্ধ তুলেছি আমার কবিতায়, কারণ সেই মুহূর্তগুলো বাংলার জীবন, শস্য, শ্রমিক আর তাদের আনন্দের প্রতীক।’
একটু থেমে বাবরি চুলের ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “‘সুরের দুলাল’ এবং বাঁকুড়া জেলার গঙ্গাজল ঘাটী জাতীয় বিদ্যালয়টির নদী পাহাড়, বন ও মাঠঘেরা প্রান্তরের কবিতার ‘অমর-কানন’—এখানে তুমি আছ। আর শুনেছ তো তোমাকে নিয়ে লিখেছি বেহাগ মিশ্র-কাওয়ালিনির্ভর গান ‘অঘ্রাণে মা গো আমন ধানের সুঘ্রাণে ভরে অবণী, হেরিনু পল্লী জননী।”
হেমন্তিকার নীরবতায় অনুতপ্ত কণ্ঠে নজরুল বললেন, ‘আমি অঘ্রানের ধানের গন্ধ তুলেছি আমার কবিতায়, কারণ সেই মুহূর্তগুলো বাংলার জীবন, শস্য, শ্রমিক আর তাদের আনন্দের প্রতীক।’
তারপর নজরুল খ্যাপার মতো চলে গেলেন। চল চল চল, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদলের মতো করে। সেই পথের দিকে তাকিয়ে হেমন্তিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হেমন্তিকা বলে, ‘নজরুলের সুরে বাংলার আন্দোলন, কৃষক, শ্রমিক আর মাঠের শস্য। কিন্তু সেই শস্যের ফাঁকে ফাঁকে যে ফাঁকা জমি, সেই ফাঁকেই লুকিয়ে আছে আমার বিষাদ। হয়তো নজরুলের কলমে সেই মাধুর্য ধরা পড়েনি, কিন্তু তিনি একটু করে হলেও অনুভব করেছিলেন আমার উপস্থিতি, কোমল দুঃখ।’
পরদিন হেমন্তিকা সব স্মৃতির গহন ফেলে বেরিয়ে চলে যায় এক প্রাচীন লাইব্রেরিতে। সেখানে বসে পৃথিবীর সব বইয়ের মধ্যে সে তার নিজেকে খুঁজে পেতে চাইছিল। পাশেই খোলা জানালা দিয়ে হালকা বাতাস আসছে, আর সেই সঙ্গে শিশিরের মতো শীতল অনুভূতি তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। লাইব্রেরির পুরনো কাঠের তাকগুলোতে সাজানো বইগুলো যেন তার একমাত্র সঙ্গী।
লাইব্রেরির একটি জীর্ণ কর্নারে পড়ে আছে ধূসর পাণ্ডুলিপি, সাতটি তারার তিমির, রূপসী বাংলা। হেমন্তিকা বইগুলো থরথর বুকে, কেঁপে কেঁপে পড়ে। পাখির নীড়ের মতো চোখ যেন তার এত দিনের অন্বেষণ, এত দিনের বুকভরা সব কষ্টকে মলিন করে দিল। বইগুলো বুকে নিয়ে লাইব্রেরির প্রাচীন পাকুড়গাছের নিচে গিয়ে বসে। ঝুরিবহুল, অশত্থের বিশাল পাতাদের ছোঁয়ায় বিহ্বল হয়ে পড়ে।
লাইব্রেরির চারদিকেই অরণ্যনীল ঝোপ। দুচোখ ভরা খুশি নিয়ে হেমন্তের পাতাঝরা অরণ্য, শীতের প্রত্যাশায় পর্ণমোচী বৃক্ষদের নিষ্পত্র গাম্ভীর্যে দাঁড়িয়ে থাকা দেখতে দেখতে হেমন্তিকার মনে পড়ে যায় বাংলার হেমন্তের কথা। তখন তার শৈশবকাল—পুজোর ছুটিতে পরিবারের সঙ্গে দূরপথগামী ট্রেনে বেড়াতে যেত। ট্রেনের জানালায় বসে হেমন্তিকা দেখতে পেত বিস্তীর্ণ চষাক্ষেতে ধান পেকে হলদে হয়ে আছে। আর ফসলশূন্য নিস্তব্ধ হেমন্তপ্রান্তর যেন বিষণ্নতাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। ভাবতে ভাবতেই আকাশে চেয়ে দেখে, সূর্য ধীরে ধীরে অস্ত যাচ্ছিল, হেমন্তিকা মনে মনে ঠিক করল, কালই যাবে তার কাছে—তাহার কাছে!
পরদিনই যাত্রা করে বরিশাল, পৌঁছেই ধানসিড়ি নদীর তীর। সেখানে তখন বুনো হাঁসের ঝাঁক, দূরের আকাশে মেঘের ভেলা, আর পাখিদের সংগীতময় কলরব। শজনেগাছের ডালে লক্ষ্মীপেঁচা বসে, নিম নিম করে ডাকছে। জীবনানন্দ ধানসিড়ির তীরে বসে, তার কোলের ওপর খোলা ডায়েরি, কী যেন লিখছেন! গাছের হলুদ হয়ে আসা পাতার মাঝে, মেঘভেজা দূরবর্তী মাঠের সবুজে, হেমন্তিকার চুপটি করে থাকা শিশিরের মতো মৃদু উপস্থিতি, জীবনানন্দের গভীর দৃষ্টির সামনে ধরা পড়ে মুহূর্তেই।
হেমন্তিকার বিদিশার নিশা ভরা চুলে, ঝরা শিউলির একরাশ পাপড়ি, চোখ নীলাভ বেতফলের মতো। জীবনানন্দ সে চোখের ভেতরে ডুবে যান, এক বিস্তীর্ণ চেতনায়। জীবনানন্দ তাকে চিনলেন গভীর হৃদয়ের ভালোবাসা দিয়ে, তার সব কবিতার মাঝে, তার প্রতিটি পঙক্তিতে যে হেমন্তিকা।
জীবনানন্দের চোখের ভেতরে হেমন্তিকা খুঁজে পায় আশ্রয়, হেমন্তিকার মিষ্টি বিষাদ জীবনের অন্য রূপে রূপান্তরিত হয়ে যায়। জীবনানন্দকে বলল, ‘আপনি এত দিন কোথায় ছিলেন?’
সেই প্রশ্নে ছিল গভীর আকাঙ্ক্ষা, এক ধরনের স্বীকৃতি যে তারা যুগে যুগে একে অপরের অপেক্ষায় ছিল। জীবনানন্দ স্নিগ্ধ হেসে বললেন, ‘তুমি তো আমার হেমন্তিকা; আমার সুদর্শনা, বনলতা সেন। তোমার জন্যই তো লিখেছি ঝরা পালক, তুমি যে আমার মহাপৃথিবী। আমি তো ধানসিড়ি নদীর তীরে সেই কতকাল ধরে তোমারই অপেক্ষায়!’
হেমন্তিকা আবেগে ভেসে যাচ্ছিল। অবাক হয়ে জীবনানন্দকে বলে, ‘আমাকে নিয়ে কেন এত লেখো তুমি, কবি? আমি তো খুবই সাধারণ এক প্রকৃতি।’
জীবনানন্দ হেমন্তিকার আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বললেন, “কে বলেছে তোমায়! আমার কবিতার চিরন্তন অংশ তুমি। তোমাকে নিয়ে আমি ভেসে যাই ‘দারুচিনি দ্বীপের’ ভিতর, যেখানে তোমার নিভৃত সৌন্দর্য ও আমার ভালোবাসা, একাকার হয়ে যায়।”
কথা বলতে বলতেই রাতের আকাশ থেকে নক্ষত্র ঝরে পড়ছিল। হেমন্তিকা ফিরে আসে পৃথিবীভরা ভালোবাসা নিয়ে। জীবনানন্দও ফিরে যান হেমন্তিকার শিশিরের জল নিয়ে। রাঙা রাজকন্যার মতো জীবনানন্দের হেমন্তিকা!
এরপর হেমন্তিকার মাঝে এক বোধের জন্ম নেয়, যেখানে জীবনানন্দ সমগ্র হয়ে আছে। সেই রাত ছিল হেমন্তিকার জন্য এক আলোকময় প্রণয়ের মুহূর্ত, যেখানে জীবনানন্দের কবিতা, ভালোবাসা, তার সমস্ত বেদনা মুছে দিয়েছিল। হেমন্তিকা ভুলে গেল তার সব দুঃখ, সব অবহেলা—তার হৃদয় শুধু কবির প্রতি মুগ্ধতায় ভরা।
হেমন্তিকা জীবনানন্দের প্রেমে পড়ে যায়। সে তার এই খুশির একটি অংশ ‘নবান্নের উৎসব’ করে ছড়িয়ে দেয় পৃথিবীর বুকে।
হেমন্তিকা, হেমন্তের রূপসী দেবী, নবান্নের এই আনন্দে নিজের অপার্থিব রং ছড়িয়ে দেয়। চাষিরা ধান কাটতে কাটতে তার রূপের ছোঁয়া অনুভব করে, অনায়াসেই তাদের পরিশ্রমের ক্লান্তি মুছে যায়।
নবান্নের উৎসবে রাতভর ঢেঁকির গহন হতে ফসলের চালের সাদা ধুলো বের হয়, যেখানে মিশে থাকে হেমন্তিকার খুশি। চাষিরা আনন্দের সুরে গান গায়, ঢোল বাজে সারাক্ষণ। উঠানে পাতা জোছনার মাদুরে বসে নবান্নের পিঠা খায় সবাই। আলতো করে চাষিদের ঘরের বউরা পায়ে আলতা পরে, চাষি শাড়ির আঁচলে তুলে দেয় ধানের শীষ।
হেমন্তিকার এই রঙিন সুরভিত উপস্থিতি শুধুই আনন্দ নয়, বরং তার সঙ্গে মিশে থাকে ধীর, গভীর প্রত্যয়। চাষিদের প্রতিটি ঘরে তার এই ভালোবাসার ছোঁয়া ঢেঁকির গহনে, পিঠার মিষ্টতায়, ম-ম করে। দাওয়ায় বসে নক্ষত্র জলে ভিজে, কৃষাণ-কৃষাণীর সুখের গল্পে কেটে যায় ভোর।
নবান্নের উৎসব পৃথিবীতে দিয়ে এসে হেমন্তিকা, জীবনানন্দের জন্য বিহ্বল, দিশেহারা। কিছুদিন পর হেমন্তিকা আবারও যায় ধানসিড়ি নদীর তীরে। কিন্তু জীবনানন্দ তখন কলকাতায়। সে বুঝতে পারে যে কবির জন্য তার হৃদয় গভীর ভালোবাসায় ভরে গিয়েছে। এই অস্থির মধুর অনুভূতি সে আর লুকিয়ে রাখতে পারছে না। প্রতিজ্ঞা করে, কবি যখন ফিরে আসবেন, তখন সে তার মনের কথা সব খুলে বলবে।
হেমন্তিকা কবির প্রেমে দিনের পর দিন আরো প্রমত্ত, আকুল হয়ে উঠেছিল। সে জীবনানন্দের কবিতায় তার আত্মার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছে। তার বিষাদমাখা হৃদয় সত্যিই কবির প্রেমে ধীরে ধীরে দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছিল। হেমন্তিকা কলকাতায় জীবনানন্দের কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। এ সময় একদিন হঠাৎ করেই একটি খবর আসে। দিনটি ছিল ২২ অক্টোবর ১৯৫৪। কলকাতার ট্রামলাইনে এক দুর্ঘটনায় জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু হয়েছে।
খবরটি শুনে হেমন্তিকার পুরো পৃথিবী যেন থমকে যায়। সে কিছু বলতে পারে না, শুধু চোখের জলে ভিজে যায় সারা পৃথিবী। তার জীবনে ভালোবাসা আর পূর্ণতা পেল না। বাতাসে ভেসে আসা কবির শেষ কথা—‘ধূসর পাণ্ডুলিপির রঙ সারাটা আকাশ জুড়ে’—এ যেন হেমন্তিকার জীবনেরও প্রতিচ্ছবি।
এরপর হেমন্তিকা তার সব কষ্ট নিয়ে, বিষাদ নিয়ে হিমালয়ে চলে যায়। সেখানে তার অশ্রু, জমে জমে বিশাল বরফের পর্বত হয়ে গেছে। সেই কবেকার কান্না এখনো যেন থামতেই চায় না। হেমন্তিকা প্রতিবছর শরতের ঝলমলে সোনালি রং শেষ হয়ে গেলে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে জীবনানন্দের জন্য। তাঁর স্মরণে ভালোবাসার অর্ঘ্য দিতে, হেমন্তিকা নিয়ে আসে হিমালয় থেকে ব্যথার শিশির।
হেমন্তিকার জীবন যেন জীবনানন্দের কবিতার মতোই এক গভীর বিষাদের প্রতীক—যেখানে ভালোবাসা আর অপূর্ণতার, তীব্র অসম্পূর্ণ সুর মিশে থাকে। ধূসর আকাশের অসীম শূন্যতায় চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে তার জীবনানন্দ, আর সেই শূন্যতায় তার হৃদয়ের কান্না বৃষ্টি হয়ে ঝরে। আজও প্রকৃতির প্রতিটি অন্ধকারে, প্রতিটি ঝরাপাতায়, প্রতিটি নিঃশব্দ ঢেউয়ে হেমন্তিকার কষ্ট নীল নক্ষত্র হয়ে ঝরছে।
আজও জীবনানন্দের জন্য হেমন্তিকার আর্ত অপেক্ষা, বুকের গভীরে রাতভর দুঃখের গহন অতল। পথের পাতার মতো সপ্রতিভ হয়ে সারা দিন ছুঁয়ে থাকে। এই বেদনা তার সারা জীবনের, এই আকুলতা তার অপার্থিব ভালোবাসার। যুগ যুগ ধরে নদীর মতো এই হিম ব্যথা সে বয়ে বেড়াচ্ছে। হিমালয়ে সঞ্চিত এই বেদনা যেন শেষ হয়নি, শেষ হবে না কখনো। হেমন্তিকার বেতের মতো নীলাভ দুটো চোখ থেকে আজও কান্না হয়ে ঝরে—পৃথিবীর পাহাড়ে, সাগরের ঢেউয়ে, শিশিরের টুপটাপে, ভোরের নীল কুয়াশায়, গোধূলির শেষ রঙে...
Publisher & Editor