বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারি ২০২৫

নিউইয়র্কের নাট্য ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রতিবাদী গণসমাবেশ (ভিডিওসহ)

প্রকাশিত: ১২:১৭, ১১ নভেম্বর ২০২৪ | ৩২

বাংলাদেশে মঞ্চনাটক ও সাংস্কৃতিক চর্চার পথকে রুদ্ধ করার পরিকল্পিত দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে নিউইয়র্কের নাট্য ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা প্রতিবাদী গণসমাবেশ করেছে।

১০ নভেম্বর রবিবার নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় সন্ধ্যায় আয়োজিত এই সমাবেশে বক্তরা বাংলাদেশে উগ্র রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে প্রতিহত করে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংস্কৃতির ধারাকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে সবাইকে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান। সেই সাথে সম্প্রতি বাংলাদেশে নাট্যকর্মীদের উপর যে নগ্ন হামলা হয়েছে, সেই ঘটনায় তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবী করা হয়।

জঙ্গি ও মৌলবাদীদের ধারাবাহিক আক্রমণের বিরুদ্ধে মঞ্চ নাটক ও নাট্যকর্মীদের সুরক্ষার দাবিতে নাট্য ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রতিবাদী গণসমাবেশ থেকে একটি ঘোষনা পত্র পাঠ করা হয়। ঘোষনা পত্র পাঠ করেন লুৎফুন নাহার লতা, মিথুন আহমেদ, শিতেষ ধর, মিনহাজ আহমেদ শাম্বু, স্বাধীন মজুমদার প্রমূখ।

সমাবেশের শেষ পর্বে বিভিন্ন নাটকের অংশ বিশেষ ও কবিতা আবৃত্তি করেন লুৎফুন নাহার লতা, ফকির ইলিয়াস, স্বাধীন মজুমদার. গোপন সাহা,শুক্লা রায়,হাসান আল আব্দুল্লাহ,খায়রুল ইসলাম পাখী,পারভিন সুলতানা,দীলিপ মোদক প্রমূখ।

সমাবেশের সূচনা পবর্ব বক্তব্য রাখেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট উত্তর আমেরিকার আহ্ববায় মিথুন আহমদ। মূল আয়োজনের শুরুতে সমবেত কণ্ঠে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন মিনহাজ আহমেদ শাম্বু ও স্বীকৃতি বড়ুয়া।   

প্রতিবাদী সমাবেশে পাঠ করা আনুষ্ঠানিক বক্তব্য: ‘বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অসহনীয় দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে স্বল্পসময়ের প্রস্তুতিতে আহূত আমাদের এই প্রতিবাদী গণসমাবেশে অংশগ্রহণকারী সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমাদের আজকের অনুষ্ঠানের মূল প্রতিপাদ্য সম্পর্কে আমরা কিছু কথা আপনাদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করতে চাই।

উপস্থিতি প্রিয় সংগ্রামী নাট্যকর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং সর্বস্তরের দেশপ্রমিক বাংলাদেশের নাগরিকগণ, আমরা আশা করছি, বাংলাদেশের চলমান অস্থির পরিস্থিতি আপনারা সম্পূর্ণ অবগত আছেন। বাংলাদেশের এই চলমান সাংস্কৃতিক অস্থিরতা আমাদের জানান দিচ্ছে যে, এই দখলদার অরাজনৈতিক অসংবিধানিক অন্তর্বর্তী সরকার শুধু অগণতান্ত্রিকই নয়, তারা স্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধি চর্চা ও অবাধ সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য এক হুমকি। তারা মঞ্চ নাটককে প্রতিপক্ষ মনে করে। তারা মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিপক্ষ মনে করে। তারা ৫২, ৬৯ এবং ৭১-কেও প্রতিপক্ষ মনে করে।

এই সরকার মনে করে রাজাকার, আলবদর, আল শামস, ইসলামী ছাত্র সংঘ, হিজবুত তাহেরী, ইসলামী ছাত্রশিবির এবং একাত্তরের স্বাধীনতা বিরোধী জামায়েতে ইসলাম তাদের মিত্র। তারা ইসলামের মানবতাবাদী উদারনীতির পরিপন্থী ও ইসলামের অপব্যাখ্যাকারী একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও উগ্র জঙ্গি মানবতাবিরোধী জিহাদিদের মদদপুষ্ট।

এই অবৈধ সরকারের শাসননীতি বাংলাদেশের ৭২ এর সংবিধান পরিপন্থী। একথা আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে, যখন আমরা দেখতে পাই এই সরকার–সুকৌশলে ও সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে অমুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার না-করা বা আত্মপরিচয় গোপনকারী জাতীয় শত্রুদের সমন্বয়ে।

বাংলাদেশ আজ এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ভুলুন্ঠিত। আজ ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হেসেন দিবসে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রকাশ্য দিবালোকে উন্মুক্ত স্থানে কতিপয় ছাত্র-যুবক আক্রমন করে আহত করেছে।

৫ অগাষ্ট মূলত ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের নামে দেশে নৈরাজ্য, অনাস্থা, অস্থিতিশীলতা তৈরি করে দেশকে একাত্তর-পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার সুপরিকল্পিত উদ্যোগ। জঙ্গি-ইসলামি দলগুলোর অনুসারী শিক্ষার্থীরা দেশকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মানবতা বিরোধী পাগলা ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দিয়েছে। ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ এখন সাম্প্রদায়িক আদর্শের অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে সকল গণতন্ত্র, বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা আজ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী কৃর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারী আন্তর্জাজিত ষড়যন্তের অংশীদার দেশপ্রেমহীন মানবিক মূল্যবোধ ও বিবেকহীন কতিপয় জঙ্গি ও এনজিও ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত এই অগণতান্ত্রিক অবৈধ সরকার ইতোমধ্যে নিজেদের অকার্যকর প্রমাণিত করেছে, দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট করেছে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে, মিথ্যা মামলা দিয়ে নিরপরাধ মানুষদের গণ-গ্রেফতার করছে এবং হাজার হাজার মানুষকে হয়রানি করছে, সর্বত্র অবাধে চাঁদাবাজী করছে এবং দেশের অবকাঠামোসহ অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রুখতে না পেরে জনজীবনকে দুর্বিসহ করে তোলেছে।

এই সরকার সারাদেশে শতাধিক নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মহড়াকক্ষ, বাদ্যযন্ত্র, শিল্পকর্ম ও দপ্তর দখল করেছে কিংবা জ্বালিয়ে দিয়েছে। অতি সম্প্রতি দেশ নাটকের জনপ্রিয় নাটক ‘নিত্য পুরাণ’ ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় প্রর্দর্শনী চলাকালে একদল উছৃঙ্খল জনতা হামলা করলে সরকার আইনানুযায়ী সুরক্ষা দেওয়ার স্থলে উল্টো তারা হামলাকারীদের প্রশ্রয় দিয়েছে এবং প্রদর্শনী বন্ধ করতে বাধ্য করেছে।

উক্ত ঘটনার প্রতিবাদে গত ৮ নভেম্বর বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন আয়োজিত শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সভায় হামলাকারীরা পুনরায় হামলা করে। এবং সেখানেও সরকার কোনো সুরক্ষা প্রদান করেনি।

মানব প্রগতির ইতিহাসে নাটক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যুগ যুগ ধরে চর্চিত ঐতিহ্যবাহী নাট্য ধারা ছাড়াও আধুনিক নাট্যরীতির নাট্য প্রযোজনা বাংলাদেশের জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ, এবং একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। গণতন্ত্র, সামাজিক পরিবর্তন, অর্থনৈতিক সমতা ও মৌলিক অধিকার আদায়ে নাটকের ভূমিকা সর্বজন বিদিত। আমাদের নাটক গণ মানুষের সার্বিক মুক্তির কথা বলেছে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সবসময় সক্রিয় থেকেছে। সেই নাটকের কন্ঠ রোধ করতে চায় যারা, তারা আর যাই হোক নিশ্চয়ই জনতার মুক্তির পক্ষের মানুষ নয়। এরা মানবতা বিরোধী, স্বাধীনতা ও মানবমুক্তি বিরোধী অশুভ শক্তি। রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীল পরিবেশের সুযোগে এরা পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রকে অন্ধকারে নিক্ষেপ করতে চায়। আমরা নাট্যকর্মীরা এই উছৃঙ্খল, প্রগতি-বিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চালিয়ে যাবো। সারা দেশের সংস্কৃতি কর্মীদের প্রতি আহ্বান, সকল বিভাগ, জেলা ও উপজেলায় এই হিংস্র অপশক্তির বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করে গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির সংগ্রাম অব্যাহত রাখুন।

সংগ্রামী বন্ধুগণ, দেশকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যাওয়ার এই প্রক্রিয়াকে আমরা যে কোন মূল্যে প্রতিহত করবো। এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য সুস্পষ্ট- এই সরকার সম্পূর্ণ অবৈধভাবে এবং অগণতান্ত্রিকভাবে আমাদের বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় চেপে বসেছে, তাদেরকে অবিলম্বে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নিতে, এবং নিরপরাধ সাংস্কৃতিক কর্মীদের নির্যাতনকারী উছৃঙ্খল সংঘবদ্ধ দলকে আইনি বিচারের পথ উন্মুক্ত করে দিতে হবে। আমরা মনে করি সংস্কৃতির প্রবাহমানতাই পারে একটি সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুশৃঙ্খল করতে।

পরিশেষে আমাদের যেসব শিল্পী, নাট্যকর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী, লেখক, সাংবাদিক ও নানান শ্রেণী পেশার মানুষ সরকারি পদ, স্বীকৃতি, অর্থ এবং নানান সুযোগ-সুবিধার লোভে, এবং বিগত সরকারের প্রতি প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের প্রতি আমাদের আন্তরিক আহ্বান- আপনারা অবিলম্বে এই ভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসুন, নচেৎ বিশ্বাসঘাতক বেঈমান হিসেবে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আপনাদের পরিচিতি আমৃত্যু স্থায়ী হয়ে থাকবে।

আমাদের স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতে আয়োজিত এই প্রতিবাদী গণসমাবেশে অংশগ্রহণকারী সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, এবং অনাগত সময়ে জরুরি প্রয়োজনে সর্বাত্মক সহায়তার প্রদানের আগাম আহ্বান জানিয়ে শেষ করছি।- জয় বাংলা’

 

ভিডিও - New York cultural activist protest against attacki on Bangladesh cultural activists.

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor