শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪

জামদানির দামে কেন এত তারতম্য

প্রকাশিত: ২৩:৩০, ১৩ নভেম্বর ২০২৪ | ১৮

বাজারে বেশ চড়া দামেই বিক্রি হয় জামদানি। জায়গাভেদেও এই শাড়ির দামে বেশ তারতম্য দেখা যায়। মূলত নকশার কাজ, সুতার কাউন্ট আর সুতার মানের ওপর নির্ভর করে জামদানি শাড়ির দাম। জামদানি শাড়ির সূতিকাগার রূপগঞ্জের তাঁতিরা জানান, সাধারণত ৪০ থেকে ১২০ কাউন্ট সুতায় বোনা হয় জামদানি। সুতি আর রেশম—দুই রকম সুতা জামদানির বুননে ব্যবহার করে থাকেন তাঁরা। সুতা যত চিকন হবে, কাউন্ট হবে তত বেশি, সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে শাড়ির মূল্য।

বাজার ঘুরে দেখা গেল আড়ং, অরণ্য, কুমুদিনী হ্যান্ডিক্র্যাফটস, সাদাকালোসহ নানা দেশীয় ব্র্যান্ডের শাখাগুলোয় পাওয়া যাচ্ছে জামদানি। ৬০ থেকে ৮০ কাউন্টের সুতার জামদানি কাজের ধরন অনুযায়ী বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে ২০ হাজার টাকায়। ৮০ থেকে ১০০ কাউন্টের হাফ সিল্ক জামদানি মিলছে ২০ হাজার টাকা থেকে কয়েক লাখ টাকায়। অরণ্যে গিয়ে জানা গেল, তাদের বোনা জামদানি শাড়িতে রয়েছে প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার। আড়ংয়ে জামদানি শাড়ির কাজের সঙ্গে সুতার এমব্রয়ডারির করা ফিউশন জামদানির দেখাও মিলছে। কুমুদিনী হ্যান্ডিক্র্যাফটসের বনানী শাখার ম্যানেজার শিবনারায়ণ চৌধুরী জানান, তাঁদের নিজস্ব নকশার জামদানি শাড়ি আছে। আদি নকশা বজায় রাখার পাশাপাশি নান্দনিক অলংকরণের মৌলিক ও যৌগিক মোটিফও করেন। শাড়ির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আর সুতার মান ধরে রেখে তাঁদের তাঁতিরা নানা জ্যামিতিক নকশা ফুটিয়ে তোলেন।

রাজধানীর মিরপুরের বেনারসিপল্লির বেশ কিছু দোকানে ঢুঁ মেরে দেখা গেল, আসল ঢাকাই জামদানি শাড়ির সঙ্গে মেশিনে বোনা শাড়িও রয়েছে। দোকানের বিক্রয়কর্মীরা জানান, কারখানার তাঁতিদের কাছ থেকে সরাসরি জামদানি সংগ্রহ করেন দোকানের মালিকেরা। অনেক সময় মহাজন মারফতেও জামদানি শাড়ি আসে। আবার জামদানি হাট থেকেও পাইকারি শাড়ি নিয়ে এসে বিক্রি করা হয়। ৪ হাজার টাকা থেকে দাম শুরু, শেষ লাখ টাকা।

ঢাকায় জামদানি বিক্রির আরেক জনপ্রিয় জায়গা নিউমার্কেট–সংলগ্ন ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট। এখানে জামদানি শাড়ির খোঁজে আসা ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকে। হাতে বোনা রেশম সুতার জামদানি থেকে শুরু করে মেশিনের তৈরি জামদানি—সব মিলছে। মেশিনে তৈরি নাইলন সুতার জামদানি বিক্রি হয় ৮০০-১৫০০ টাকার ভেতর। ৪০ কাউন্টের মোটা সুতার জামদানি আড়াই থেকে পাঁচ হাজার টাকা। অন্যদিকে ৬০ থেকে ৮০ কাউন্টের শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে ৬ থেকে ১৩ হাজার টাকার মধ্যে, ৮০ কাউন্টের শাড়ি ৮ থেকে ১৭ হাজার টাকায়, ৮৪ কাউন্টের জামদানি ১২ থেকে ২৫ হাজার টাকা আর ১০০ কাউন্টের রেশম হাফ সিল্ক জামদানি ২০ হাজার টাকা থেকে লাখ টাকাও গড়াচ্ছে। বিভিন্ন দোকান ঘুরে বিক্রয়কর্মীদের থেকে এমন তথ্য জানা গেল। তবে বলা বাহুল্য, এই মার্কেটে শাড়ি কিনতে গেলে আপনাকে জামদানি শাড়ি চিনতে বেশ পটু হতে হবে। নয় তো নকল সুতার জালে জড়িয়ে ঠকার আশঙ্কা রয়েছে।

রূপগঞ্জের দক্ষিণ রূপসী গ্রামে বহু তাঁতি পরিবার বংশপরম্পরায় তৈরি করছে জামদানি শাড়ি। সেখানেই রুবেল জামদানি অ্যান্ড উইভিং ফ্যাক্টরির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ রুবেল জানান, আসল জামদানি তৈরি বেশ কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাঁদের কারখানায় ১০ জন তাঁতি জামদানি বোনার কাজ করেন। একই এলাকার সামিয়া জামদানি হাউসের তাঁতিরা বলেন, নিজেরা জামদানি বানিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করেন। মূলত বাড়ি থেকেই তাঁরা এই কাজ পরিচালনা করেন। জামদানি শাড়ির দাম সুতা এবং কাজের পুরুত্বের ওপরও নির্ভর করে। যে জামদানিতে যত ভারী ও জটিল নকশার কাজ হবে, শাড়ি তৈরিতে সময় তত বেশি যাবে। এতে করে মজুরি লাগে বেশি। মানের বিবেচনায় একেকটি জামদানি শাড়ি তৈরি করতে দুজন তাঁতির পাঁচ দিন থেকে দু-চার মাস পর্যন্ত সময় লাগে।

তাঁদের কাছে ৬০–৮০ কাউন্টের জামদানির দাম ৪ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এসব জামদানিতে সাধারণত ৯-১০ হাত পর্যন্ত কাজ থাকে। ৮০ কাউন্টের সুতার শাড়ি পাওয়া যায় কাজের পুরুত্ব অনুযায়ী সাড়ে ৬ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে। কোমরের দিকের ভাঁজের জন্য ২ হাত ছাড়া শাড়িজুড়ে থাকে কাজ। ৮৪ কাউন্টের জামদানির দাম পড়বে ১০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ২২ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ জামদানিগুলোয় সাধারণত দেড় হাত ফাঁকা থাকে। সঙ্গে মিলবে ব্লাউজের কাপড়ও। সবচেয়ে মিহি ১০০ কাউন্টের সুতার জামদানি তৈরি করতে মাসখানেক সময় পার হয়ে যায়। তাই দামও হয় চড়া। ২০ হাজার থেকে শুরু করে লাখ টাকা পর্যন্ত হয় এই সব মিহি সুতার জামদানি। ১২০ কাউন্টের সুতার শাড়ি মূলত কোনো বিশেষ খদ্দেরের দেওয়া অর্ডারের ভিত্তিতে তৈরি করা হয় বলে জানান এখানকার তাঁতিরা।

দাম বাড়ছে
জামদানি শাড়ির সুতার দাম দিন দিন বাড়ছে। ফলে উৎপাদন খরচও বেড়েছে প্রচুর। অন্যদিকে দোকানভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, অবকাঠামোগত ব্যয়, তাঁতিদের মজুরি—সব মিলিয়ে জামদানি শাড়ির মূল্যও এখন ঊর্ধ্বমুখী। তবে প্রান্তিক পর্যায় থেকে শুরু করে জনপ্রিয় দেশি ব্র্যান্ডের দোকান ঘুরে বোঝা গেল, সুতার মানের পাশাপাশি অনন্য নকশা শাড়ির মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। নকশা অনুযায়ী আবার জামদানির বিভিন্ন ভাগ আছে। এ ছাড়া সুতার মান কেমন, কোথা থেকে আমদানি হচ্ছে, সুতার প্রক্রিয়াজাতকরণ—সবকিছুই শাড়ির দামে বিবেচনায় আনা হয়। সাধ আছে সাধ্য নেই, এমন অনেক ক্রেতাই তাই দেখতে আসল জামদানির মতো মেশিনে তৈরি পলিয়েস্টার বা নাইলনের নকল জামদানির দিকে ঝুঁকছেন। ৬৫০ থেকে ১৫০০ টাকায় মিলছে এসব জামদানি শাড়ি। তবে এটি আসল ঢাকাই জামদানিশিল্পের জন্য ভয়াবহ হুমকি বলে মনে করছেন তাঁতিরা।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor