যুক্তরাষ্ট্রের হবু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের (যদিও খুব দ্রুতই ক্রেমলিনের তরফ থেকে অস্বীকার করা হয়েছে) মধ্যকার ফোনালাপের খবর অদূর ভবিষ্যতে তাঁদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কের সুর ও গতিপথ কেমন হবে, তারই ইঙ্গিত দেয়।
ওয়াশিংটন পোস্টের খবর অনুযায়ী, ৭ নভেম্বর পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্প কথা বলেছেন। এ সময় তিনি পুতিনকে সতর্ক করে দেন, ইউক্রেনে যেন আর উত্তেজনা না বাড়ে। পুতিনকে স্মরণ করিয়ে দেন, ‘ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল সামরিক উপস্থিতির’ বিষয়টি।
এর এক দিন আগে, ভ্লাদিমির পুতিন সোচিতে থিঙ্কট্যাংক ভালদাই ডিসকাশন ক্লাবের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে দীর্ঘ একটি বক্তব্য দেন। এ ব্যাপারে বিস্ময়ের কোনো অবকাশ নেই যে পুতিন তাঁর বক্তব্য ও প্রশ্নোত্তর পর্বে কট্টর পশ্চিমাবিরোধী অবস্থান জানান দেন। পুরোপুরি আত্মবিশ্বাসের সুরে বলেন, বিশ্বব্যবস্থা এখন ‘প্রকৃত সৃষ্টির পর্যায়ে রয়েছে’।
কিন্তু একই সঙ্গে পুতিন ট্রাম্পকে ‘সাহসী মানুষ’ বলে তোষামোদ করেন। ট্রাম্প রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক পুনরায় নতুন করে শুরু করতে এবং ‘ইউক্রেন সংকট’ (পুতিনের ভাষায়) অবসানে কোনো প্রস্তাব দিলে সেটা পুতিন বিবেচনা করবেন বলে জানিয়েছেন।
কিন্তু এরপর পুতিন তাঁর বক্তব্যে রাশিয়া ও চীনের সম্পর্ক নিয়ে অনেকটা সময় ধরে কথা বলেন। এর কারণ খুঁজতে আমাদেরকে পুতিন ও সি চিন পিংয়ের প্রতি ট্রাম্পের আগের বার্তার কাছে ফিরে যেতে হবে।
৩১ অক্টোবর নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি রাশিয়া ও চীনের মধ্যকার মৈত্রী ভেঙে ফেলার কাজ করবেন। ট্রাম্প বলেন যে এই দুই দেশ ‘জাত শত্রু’। এর কারণ হলো রাশিয়ার বিশাল ভূখণ্ড আছে, আর চীনের আছে বিশাল জনসংখ্যা। সেই জনসংখ্যার জন্য রাশিয়ার ভূখণ্ড চীনের দরকার।
এদিকে চীনও অলস বসে নেই। সি চিন পিং রাশিয়াকে বড় আকারের আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে রাশিয়াকে নিজেদের পক্ষে রাখার জন্য। সামগ্রিকভাবে, আমেরিকাকে আবার মহান করতে গিয়ে ট্রাম্প এর ক্ষয়কেই ত্বরানিত করে তুলতে পারেন। সেটা তিনি করবেন, উদারনৈতিক বিশ্ব ব্যবস্থাকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে ভুলভাবে সাজাতে গিয়ে। চীনের সঙ্গে রাশিয়ার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। এই সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাসও আছে। ১৯৬০-এর দশকে চীন ও সোভিয়েতের মধ্যে যে বিভাজন দেখা দিয়েছিল, তাতেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চীনের দরজা খুলে দিয়েছিলেন।
নিক্সনের বিপরীত অবস্থানে গিয়ে ট্রাম্প বেইজিংয়ের সঙ্গে নয়, মস্কোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের দরজা খুলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। যদিও বর্তমানে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে সেই আগের মতো বিভক্তি চিন্তা করা কঠিন। কিন্তু ট্রাম্প রাশিয়া ও চীনের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করার যে আকাঙ্ক্ষা লালন করছেন, বাস্তবে সেটা পুরোপুরি অবাস্তব না–ও হতে পারে।
বাইরে থেকে দেখে মনে হয় পুতিন ও সি চিন পিং খুব ঘনিষ্ঠ মিত্র। কিন্তু দুই দেশের সম্পর্কের দিকে গভীরভাবে তাকালে দেখা যাবে অন্যান্য জোটের ক্ষেত্রে যেমন প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে গভীর সম্পর্ক থাকে, চীন ও রাশিয়ার ক্ষেত্রে সেটা অনুপস্থিত।
জনগণ ও নীতিনির্ধারক দুই পর্যায়েই চীন ও রাশিয়ার মধ্যে অনেক অসন্তোষ রয়েছে। মধ্য এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা নিয়ে রাশিয়ানরা চিন্তিত। বিরোধপূর্ণ সীমানার বিরোধ বেধে যাবে কি না, তা নিয়েও তাঁরা উদ্বিগ্ন। বেইজিংয়ের অধস্তন বন্ধু মস্কো—এই চিন্তা থেকে অনেকে অসন্তুষ্ট।
সম্ভাব্য এসব ইস্যুকে ব্যবহার করে ট্রাম্প চীন ও রাশিয়ার মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু এই প্রচেষ্টা কতদূর গড়াবে, সেটা পুতিনের ওপর অনেকখানি নির্ভর করবে। ট্রাম্পের ইউক্রেন–নীতি কী চেহারা নেবে এবং সেটা ইউক্রেন ও পশ্চিমাদের কাছে এর অর্থ কী, সেটা অবশ্যই পশ্চিমাদের মনোযোগের সঙ্গে দেখতে হবে।
ট্রাম্পের মধ্যস্ততায় যদি কোনো চুক্তি হয়, তাতে ২০১৪ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের যে ভূখণ্ড রাশিয়া দখল করেছে, সেটিও পুরোপুরিভাবে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং রাশিয়ার আন্তর্জাতিক পুনর্বাসনের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এর সঙ্গে অবশ্যই ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ কমিয়ে আনা ও ন্যাটো সম্প্রসারণ না করার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্প একটা চুক্তি করে ফেলতেই পারেন, কিন্তু পুতিন সেই চুক্তিতে কতটা অটল থাকবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। পুতিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন—দুই পক্ষের সঙ্গেই খেলতে শুরু করতে পারেন। কারণ, পুতিন আশা করেন, উদীয়মান তৃতীয় বিশ্বব্যবস্থায় তিনি রাশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর রাশিয়াকে তিনি তৃতীয় বড় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন।
রাশিয়ার অর্থনীতির আকার বিবেচনায় এটা পুরোপুরি কল্পনা। কিন্তু পুতিন দীর্ঘদিন ধরে পরাশক্তির মর্যাদায় রাশিয়াকে প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন দেখছেন, সেটা থেমে থাকছে না।
বেইজিংকে ঠেকাতে মস্কোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দরজা খুলে গেলেও ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা সেই একই পথ গ্রহণ করবে, সেটা ভাবা বোকামি হবে। কেননা, জার্মানি, ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশির ভাগ দেশ চীনের সঙ্গে যেতেই স্বচ্ছন্দ্য বোধ করবে। এর কারণ হলো, অর্থনীতি। এ দেশগুলো বর্তমানে রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর তাদের নির্ভরতা থেকে সরে আসতে পেরেছে। কিন্তু চীনের বাজারের ওপর তাদের বড় ধরনের নির্ভরতা থেকে সরে আসতে পারেনি।
এদিকে চীনও অলস বসে নেই। সি চিন পিং রাশিয়াকে বড় আকারের আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে রাশিয়াকে নিজেদের পক্ষে রাখার জন্য। সামগ্রিকভাবে, আমেরিকাকে আবার মহান করতে গিয়ে ট্রাম্প এর ক্ষয়কেই ত্বরানিত করে তুলতে পারেন। সেটা তিনি করবেন, উদারনৈতিক বিশ্ব ব্যবস্থাকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে ভুলভাবে সাজাতে গিয়ে।
Publisher & Editor