বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

জুলাই অভ্যুত্থান: ‘মামলা নিয়ে এখন ব্যবসা শুরু হইছে.....’

প্রকাশিত: ২২:৫৮, ১৫ নভেম্বর ২০২৪ | ১৬

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, কারও নামে হয়রানিমূলক মামলা করা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগে তাঁর মন্ত্রণালয় থেকেও এ রকম সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ঢালাও মামলার পর এবার গায়েবি মামলা হচ্ছে। অর্থাৎ যিনি মারা যাননি, তাঁকেই ‘শহীদ’ বানিয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা।

প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিল চলাকালে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের গুলিতে স্বামী নিহত হয়েছেন উল্লেখ করে এক নারী মামলা করেন। এর তিন মাস পর তাঁর স্বামী থানায় এসে হাজির হয়ে জানান, তাঁর অজান্তে স্ত্রী তাঁকে ‘মৃত’ দেখিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে মামলা করেছেন। ঘটনা ঘটেছে ঢাকার আশুলিয়ায়।

পুলিশের ভাষ্যমতে, গত ২৪ অক্টোবর কুলসুম বেগম নামের এক নারী তাঁর স্বামীকে হত্যার অভিযোগ এনে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩০ জনকে আসামি করা হয়। পরে এটি ৮ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়া থানায় এজাহারভুক্ত হয়।

মামলার বাদী কুলসুম বেগম এজাহারে উল্লেখ করেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ৫ আগস্ট সকালে তাঁর স্বামী মো. আল আমিন মিয়া মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিকেল চারটার দিকে আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় বিজয় মিছিলে তিনিও ছিলেন। তবে পরাজয় মেনে না নিতে পেরে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী নির্বিচার গুলি চালায়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তাঁর স্বামী নিহত হন।

আল আমিন মিয়ার পরিবার থেকে বলা হয়, পারিবারিক ঝামেলার কারণে কুলসুম স্বামীকে মৃত দেখিয়ে মামলা করেছেন। আল আমিন সিলেটের দক্ষিণ সুরমার পিরিজপুরের বাসিন্দা। মামলার প্রায় দুই সপ্তাহ পর তিনি জানতে পারেন, তাঁকে ‘মৃত’ দেখিয়ে স্ত্রী মামলা করেছেন। মামলা থেকে আসামির নাম প্রত্যাহার করার কথা বলে নাকি তাঁর স্ত্রী লোকজনের কাছ থেকে টাকাপয়সাও নিচ্ছেন।

এখন প্রশ্ন হলো, মামলাটি কি কুলসুম একাই করেছেন, নাকি কারও প্ররোচনা ছিল? ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ রকম হয়রানিমূলক আরও মামলা হয়েছে।

৪ আগস্ট সুনামগঞ্জ পৌর শহরে গুলিবিদ্ধ হন মো. জহুর আলী। ঘটনার এক মাস পর তাঁর বড় ভাই হাফিজ আহমদ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছিলেন। এই মামলায় আসামি ধরা ও ছাড়া নিয়ে ব্যবসা শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ করেন গুলিবিদ্ধ জহুর আলী।

বৃহস্পতিবার নিজের ফেসবুক আইডি থেকে লাইভে এসে তিনি বলেন, ‘পুলিশ আমারে গুলি করছে। পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করব। কিন্তু পরে দেখি মাসুম হেলাল সবাইরে মামলায় ঢুকাইয়া দিছে। এই মামলা নিয়া এখন ব্যবসা শুরু হইছে। সে (মাসুম হেলাল) কোটি টাকা নিছে। শুনছি সে এখন কানাডা চইলা যাইব। টাকা নিয়ে জেলে ঢুকায়, বের করে। মামলায় যারার নাম নাই তারারে পুলিশ ধরে বেশি। লোকজন বলে, ‘‘আমরা টাকা নিচ্ছি।’’ এটা মিথ্যা। আমরা কোনো টাকা পাই নাই। আমরা গরিব মানুষ। এখন আমরা পড়ছি মহাবিপদে। সোমবার কোর্ট থেকে আমার ভাইরে তুলে নেওয়া হইছে।’ জহুর আলীর লাইভের ভিডিওটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। (প্রথম আলো অনলাইন, ১৪ নভেম্বর ২০২৪)

গুলিতে আহত মো. জহুর আলী এখন ঢাকা পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি) আছেন।

মিরপুরের এক হত্যা মামলার বাদী বলেন, তিনি থানায় যাওয়ার পর বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা আসামিদের নাম বসিয়ে দিয়েছেন। খিলগাঁওয়ে এক হত্যাচেষ্টা মামলায় অন্যদের মধ্যে আসামি করা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নাকে।

তিনি কেবল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থকই ছিলেন না, তাঁদের পক্ষে করা রিটের অন্যতম আইনজীবী ছিলেন। তিনি হলেন হত্যাচেষ্টার আসামি। জেড আই খান পান্নার মামলা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলে তালিকা থেকে তাঁর নামটি বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু যেসব মামলা নিয়ে হইচই হয়নি সেসব মামলায় মনগড়া আসামিরা এখনো হয়রানির শিকার।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, যারা ভূয়া মামলা করবেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। তাহলে কি জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে হতাহতদের ঘটনায় ভূয়া মামলা চলতে থাকবে?
গোপালগঞ্জের দিনমজুর জামাল মিয়া। তিনি রাজনীতি করেন না। তারপরও কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা শওকত আলী দিদার হত্যা মামলায় আসামি করে ৮ নভেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এক মাস আগে জামাল মোল্লার স্ত্রী যমজ কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। এর এক সপ্তাহ পর তিনি মারা যান। জামাল মোল্লা গ্রেপ্তার হলে তাঁর দুই যমজ সন্তানের দেখাশোনার ভার পড়ে ১৩ বছরের শিশুসন্তান সাজ্জাদ মোল্লার ওপর। ‘মা মারা গেছেন, বাবা কারাগারে’ শিরোনামে খবরটি ছাপা হলে বিষয়টি আদালতের নজর আনেন আইনজীবী হামিদুল মিসবাহ, ব্যারিস্টার নাজিয়া কবির ও সিফাত মাহমুদ শুভ।

আদালত তিন শিশুসন্তানকে দেখভাল করার জন্য স্থানীয় সমাজকল্যাণ দপ্তরকে নির্দেশ দেন। সবশেষ খবর বৃহস্পতিবার গোপালগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জামালকে জামিন দিলেও মামলাটি বহাল আছে।

জামাল মোল্লার পরিবারের অভিযোগ, মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়ার অনুরোধ করা হলে বাদীপক্ষ ৫০ হাজার টাকা চেয়েছিল।

৪ অক্টোবর প্রথম আলোর খবরে দেখা গেল, একটি হত্যা মামলায় তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন অন্যতম আসামি। বর্তমানে ওই সচিব সাবেক হয়ে গেছেন। এর আগে ও পরে অনেক সাবেক সচিবের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। একটি মামলায় ৫৩ জন সাবেক সচিবকে আসামি করা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে অনেকে ৫ বছর আগেই অবসরে গেছেন। তাঁরা কীভাবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারকে প্ররোচনা দিলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর নেই।

এরপর সচিব ছাড়িয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টাকেও হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। এই উপদেষ্টার নাম সেখ বশিরউদ্দিন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সোহান শাহ নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় আসামির তালিকায় তাঁর নাম আছে। ১০ নভেম্বর সেখ বশিরউদ্দিন উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন।

মামলার বাদী নিহত সোহান শাহর মা সুফিয়া বেগম প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশ তাঁর ছেলে হত্যার জন্য দায়ী। আসামি কারা করেছেন, তা তিনি বলতে পারবেন না। কারা নাম দিয়েছেন, তা-ও তিনি বলতে পারবেন না।

সোহান হত্যা মামলাটি ১৮ অক্টোবর রাজধানীর রামপুরা থানায় রেকর্ড হয়। এই মামলা পেছনেও যে কার বা কাদের প্ররোচনা আছে, সেটাও খুঁজে বের করা দরকার।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০দিনের কার্যক্রম বিচার–বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ঢালাও মামলার বিষয়টি উল্লেখ করেছে। এতে বলা হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের বিষয়টি সরকারকে সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। সেটা সাম্প্রতিক আন্দোলনের সময়ে হওয়া মামলা ও শেখ হাসিনার শাসনামলের পুরোনো মামলা—উভয় ক্ষেত্রে।

আবার ফিরে যাই শুরুতে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, যারা ভূয়া মামলা করবেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। তাহলে কি জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে হতাহতদের ঘটনায় ভূয়া মামলা চলতে থাকবে?

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor