বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

স্প্রিং

প্রকাশিত: ২৩:২৫, ১৮ নভেম্বর ২০২৪ |

আজ নিয়ে চারবার দেখা। প্রথম দিনেই মনে হয়েছিল এ লোক আর যা-ই হোক ভিক্ষুক নয়। প্রথম কয়েক দিন গাড়ির জানালার  কাচ খোলেনি তৌফিক। বাসায় ফেরার পথে এই লোকটিকে কয়েক দিন ধরে নিয়মিত দেখছে।

লোকটা গাড়ির জানালার কাচে ঠিক হাতও দেয়নি। খোলার ঈশারা করেছে মাত্র এবং তা অত্যন্ত ভদ্রভাবে। অনেক সাহায্যপ্রার্থী এখন এভাবে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। শুক্রবার মসজিদের বাইরেও এমন মানুষদের দেখা যায়।

কন্যার বিয়ে কিংবা নিজের অপারেশনের অর্থ দরকার—এই কথা বলে মোটামুটি পরিষ্কার কাপড় পরে এরা মুসল্লিদের মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকে। দেখেই বোঝা যায় এরা ভিক্ষুক নয়। অবস্থা ভালো ছিল একসময়। কোনো কারণে এখন পড়ে গেছে।

আজ তৌফিক জানালার স্লাইডিং কাচ নামাল। স্বাস্থ্যবান খাড়া নাকের মানুষটির বয়স ষাট হবে। সাহসী চেহারা। নিখুঁতভাবে লোকটি তৌফিককে সালাম দিল। তৌফিক বলতে পারল না, কী চান আপনি? এই কথাটা তার কাছে কেমন যেন শক্ত মনে হয়।

লোকটি কিছু চাইল না। বলল, ‘আপনাকে প্রতিদিনই দেখি, ভালো লাগে। তাই কথা বলতে ইচ্ছা করে, আর কিছু না।’ অন্যের উপকার করতে মনের মধ্যে হাত বাড়িয়ে থাকে এমন মানুষ এখনো আছে। এত ঠেলাঠেলি, হলাহল, কোলাহল আর অবিশ্বাসের মধ্যে বাস করে তৌফিকও তেমনি একজন। ‘অন্যে তোমার যে উপকার করেছে সে ব্যাপারে উচ্চকিত হও। তুমি অন্যের জন্য যা করেছ সে বিষয়ে নীরব থাকো’—কথাটায় তৌফিকের বেশ বিশ্বাস। তার প্রায়ই মনে হয়, যার বাসা অনেক বড় সেখানেই তো বাইরের মানুষ থাকতে পারবে। যে মানুষের করার ক্ষমতা আছে, মানুষ তো তার কাছেই আসবে সমস্যা নিয়ে। তার মনে হতে থাকে এ লোকটিকে ভালো মনে হলেও একদিন কোনো একটা কাজ বা সমস্যার কথা তার কাছে বলবে। এই কঠিন  প্রতিযোগিতার দেশে এটাকে সে দোষ ভাবে না। আরো দুই দিন গেল। এবার ট্রাফিক সিগন্যালে পড়ল তার গাড়ি। সে কাচ নামাল। হেসে সালাম দিল লোকটি। বলল, ‘স্যার একটা কথা বলব?’ ‘হ্যাঁ বলুন।’ আমার মেয়ের বিয়ে। গরিব মানুষ—তৌফিক ভাবলেন, এবার লোকটি সাহায্য চাইবে। সে স্ত্রীর কাছে গোপন রেখে এ রকম সাহায্য মানুষকে করে থাকে। সে বলল, ‘আমি কী করতে পারি?’ ‘আপনি তো ব্যাংকের এমডি। আমার একটা দোকান আছে। হেইডা বন্ধক রাইখা যদি এক লাখ টাকা ধারের ব্যবস্থা কইরা দিতেন। স্যার মাইয়ার বিয়া তো আর বারবার হইতো না।’ তৌফিক বলল, ‘আপনার দোকান ছাড়া আর আয় কী? সংসার চলবে কী করে?’ ‘স্যার, আল্লাহ চালাইব একরকম। ‘আচ্ছা আপনি কি লোনের অ্যাপ্লিকেশন জমা দিয়েছেন?’ লোকটি জানাল, দিয়েছে। তৌফিক বলল, সে বিষয়টা দেখবে। পরের দিন অফিসে গিয়ে সে ব্রাঞ্চ ম্যানেজারকে দোকানের খবর নিতে বলল। ম্যানেজার খবর নিয়ে বলল, ‘এই দোকানের বিপরীতে খুব বেশি হলে সত্তর হাজার টাকা দেওয়া যাবে। এবং এই দোকান ছাড়া লোকটির কোনো সম্পত্তি নেই।’ তৌফিকের মধ্যে তার পিতার অন্তরটি জেগে উঠল। একজন পিতার কন্যার বিয়ে। তার নিজের কন্যাটির বিয়েতে আঠারো লাখ টাকা ব্যয় হয়েছিল। যে অন্য কারোর জন্য কিছু করবে সে বাধার মধ্যেও পথ খুঁজে নেয়। যে করবে না সে সব সহজ পথের মধ্যেও একটা বাধা আবিষ্কার করে ফেলে। অতএব তৌফিক বলল, আচ্ছা দরকার নেই, লোকটার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলার। একবার বন্ধক নিলে এমন ছোটখাট সম্পত্তিকে আর আগের অবস্থায় আনা যায় না। আর এমন ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতারা সুদাসল ফেরত দিয়ে আর সম্পত্তি ফেরত নেওয়ার অবস্থায় আসতে পারে না।’ তৌফিক লোকটিকে ডাকল দুই দিন পর। বলল, ‘এহরাম মিঞা, আপনার ফাইল দেখেছি। এই সামান্য কটা টাকার জন্য ঝামেলায় যাবেন কেন? আমি আপনাকে টাকাটা ধার দিচ্ছি। যখন পারবেন ফেরত দিলেই চলবে। কোনো সুদ লাগবে না।’ এহরাম  তাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলল, ‘স্যার আমার ভাষা নাই আনন্দ প্রকাশ করনের। সমাজে এ রকম মানুষ আছে বলেই না কত অসহায় মানুষ বাইচা আছে। আপনারে দাওয়াত করনের সাহস আমার নাই। তার পরও স্যার।’ তৌফিক বলল, ‘সময় পেলে নিশ্চয় আসব। এক কথা, এই টাকাটার কথা বাড়িতে বলার দরকার নেই, কেমন? সামান্য কটা টাকা।’ গদগদ কণ্ঠে এহরাম বলল, ‘যারা বড় দিলের মানুষ তারা তো এমনই হয়। কারো উপকার কইরা গল্প কইরা বেড়ায় না।’ দিন পনেরো পরে তৌফিক অফিসের ডাক ফাইলে একটা নিমন্ত্রণপত্র পেল। তার পিএস নিরাভরণ। নিরাভরন কার্ডটা দেখিয়া বলল, এটা একটা বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র। তৌফিক আজিমপুরের গোরস্তানের কাছে একটি উপজেলা সমিতির কার্যালয়ের ছোট অডিটরিয়ামে শুক্রবার উপস্থিত হল যথাসময়ে। একটু একটু করে সবই আসছে ওখানে। খাবার, সাজসজ্জা, আলো, ফুল। কিন্তু তার পরও তার মনে হলো সব কিছুতেই বারন্ত অবস্থা, অভাব। মনে হলো তার স্ত্রীর মতো অসংখ্য আরো ভদ্রমহিলা যদি বিউটি পার্লারে মাসে তিন হাজার টাকা এবং কন্যাদের লেহেঙ্গা কেনার জন্য দুই লাখ করে টাকা ব্যয় না করত তাহলে এহরামের শ্রেণির মানুষদের কন্যার বিয়ের অনুষ্ঠানে এত টানাটানি পড়ত না। তৌফিকের মনে হলো, পৃথিবীর সব কন্যার পিতাই ভেতরে এক। বাইরের পার্থক্য সম্রাট আর ভিক্ষুক হোক না তাতে কী। খুব বিনয় আর কুণ্ঠার সঙ্গে এহরাম তৌফিককে জানাল, তার সহযোগিতা ছাড়া এটুকুও হতো না। তৌফিকেরও মনে হলো, সে আরো কিছু টাকা বেশি দিতে পারত। ঋণই তো। তৌসিফের জন্য আলাদা বড় চেয়ার, হাত ধোয়ার গরম পানি, সাবান, টিস্যু ও তোয়ালের আলাদা ব্যবস্থা দেখে তৌফিক মনে মনে লোকটার প্রশংসা করতে থাকল। কন্যার বিদায় অনুষ্ঠানে এহরামের সঙ্গে সঙ্গে তৌফিকও বুঝতে পারল তার চোখে জল এসেছে কখন যেন। অঙ্কের ছাত্র তৌফিক। কিন্তু এই মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ, মিনি ও কাবুলিওয়ার গল্প তার মনে পড়ল।
তৌফিকের কাজ ছিল অন্যত্র। সে অনুষ্ঠান থেকে বিদায় নিল। এহরাম ও তার কিছু আত্মীয়-স্বজন তাকে অতি উচ্চ সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে বিদায় জানাল। তৌফিকের মনে হলো, সমাজের উঁচু শ্রেণির ভদ্রলোকদের উপকার করার চেয়ে এই সব দুস্থ ও অসহায় মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানো অনেক শ্রেয়। এদের মধ্যে অন্তত আন্তরিকতা এবং কৃতজ্ঞতাবোধের মতো দুর্লভ দুটো গুণ এখনো রয়ে গেছে।

ক্রমে সন্ধ্যা হলো, তারপর রাত হলো। তা একসময় গভীর হলো। কন্যা বিদায় দেওয়ার সময় পিতার অশ্রুসজল চোখে যে করুণ ভাব ফুটে উঠেছিল অনেকক্ষণ ধরে, এহরাম মিঞার মধ্য থেকে এখন তা চলে গেছে। তার বদলে এক ক্রুর কুটিকতা এবং ভয়ংকর ভাব স্থান পেয়েছে তার চোখেমুখে।

একসময় দেশের কয়েকটি থানায় খুন, হত্যাচেষ্টা এবং ব্যাংক ডাকাতির ছয়টি মামলার আসামি প্রাক্তন সন্ত্রাসী এহরাম মিঞা এবার একটা মুঠোফোন নাম্বারে ফোন করে কারো সঙ্গে কথা বলল। আধাঘণ্টা পর একজন মোটরসাইকেল আরোহী এহরামের বাসায় এসে দরজায় টোকা দিল। ‘কন ওস্তাদ, কী কামে ডাকছেন? মোবাইলে কইলেন না।’ ‘এমন কথা মোবাইলে কওন যায় না। শোন, মানুষ গুম করতে কত ন্যাছ, তুই?’ সে কেসের বৃত্তান্ত শুনে অর্থের অঙ্কটা জানাল। এহরাম মনে মনে বলল, সত্তর হাজার টাকার ঋণ মুছে ফেলতে ব্যয় মাত্র দশ হাজার। ‘কিছুই না’। এবার তৌফিক সাহেবের দেওয়া নোটের বান্ডিল থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে এহরাম বলল, এই নে। কাম শেষ হইলে বাকি অর্ধেক।’ ‘ঠিক আছে ওস্তাদ এইডা কোনো কামই না।’

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor