সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার পরিবারের নামে নতুন করে অন্তত অর্ধশত কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের দালিলিক প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর আগে তাদের ৬০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল।
দুদকের তদন্তে কামাল ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে ময়মনসিংহ, জামালপুর ও টাঙ্গাইল রুটে চলাচলকারী ১৮টি বাস, সীমান্ত স্কয়ারে দুটি দোকানের মালিকানা, বিভিন্ন ব্যাংকে ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রসহ প্রায় ২০ কোটি টাকা জমা থাকার প্রমাণ মিলেছে। এমনকি পালিয়ে থাকা অবস্থায়ও কামালের ব্যাংক হিসাবে আড়াই কোটি টাকা জমা হয় বলে জানা গেছে। ব্যাংকের নগদ টাকা ও দোকান-বাস মিলিয়ে আসাদুজ্জামান খান কামালের পরিবারের নামে নতুন করে ৫০ কোটি টাকার সম্পদ থাকার প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার পরিবারের নামে ৬০ কোটি ৫৫ লাখ ৯৯ হাজার ১৫৬ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। তাদের ৩৬টি ব্যাংক হিসাবের অস্বাভাবিক লেনদেনের মাধ্যমে মানিলন্ডারিংয়ের যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তার পরিমাণ ৪০০ কোটি ৭৪ লাখ ৬৮ হাজার ১০৯ টাকা।
এর আগে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার পরিবারের নামে ৬০ কোটি ৫৫ লাখ ৯৯ হাজার ১৫৬ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের প্রমাণ পাওয়া যায়। গত ৯ অক্টোবর এসব অভিযোগে চারটি মামলা দায়ের করে দুদক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বলেন, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার পরিবারের নামে ৬০ কোটি ৫৫ লাখ ৯৯ হাজার ১৫৬ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। তাদের ৩৬টি ব্যাংক হিসাবের অস্বাভাবিক লেনদেনের মাধ্যমে মানিলন্ডারিংয়ের যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তার পরিমাণ ৪০০ কোটি ৭৪ লাখ ৬৮ হাজার ১০৯ টাকা। তদন্তকাজ চলমান রয়েছে। পুরো তদন্ত শেষ হলে আরও বিস্তারিত বলা সম্ভব হবে।
দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, গত ১৫ আগস্ট আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার পাঁচ সহযোগীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এরপর ৯ অক্টোবর মামলা দায়ের করা হয়। মামলার তদন্তকালে নিত্য নতুন তথ্য-প্রমাণ যোগ হচ্ছে। সর্বশেষ পাওয়া তথ্যানুসারে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। আমাদের ধারণা, কামাল পরিবারের অবৈধ সম্পদের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। যদিও দুদক দালিলিক প্রমাণ ছাড়া আইনি পদক্ষেপে যেতে পারে না। সেজন্য যথাযথ তথ্য পেতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।
দুদক টিম সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান ও ছেলে শাফি মোদাচ্ছের খানের নামে ১৮টি বাস থাকার সত্যতা পেয়েছে। জনতা, শৌখিন ও একতা পরিবহনের ওই বাসগুলো ময়মনসিংহ, জামালপুর ও টাঙ্গাইল রুটে চলাচল করে দুদক সূত্রে জানা যায়, দুদক টিম সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান ও ছেলে শাফি মোদাচ্ছের খানের নামে ১৮টি বাস থাকার সত্যতা পেয়েছে। জনতা, শৌখিন ও একতা পরিবহনের ওই বাসগুলো ময়মনসিংহ, জামালপুর ও টাঙ্গাইল রুটে চলাচল করে।
তদন্তে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিজের নামে রাজধানীর ধানমন্ডিতে সীমান্ত স্কয়ারে দুটি দোকানের মালিকানা থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান ও মেয়ে শাফিয়া তাসনিমের নামে ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত আসাদুজ্জামান খান কামালের পরিবারের নামে প্রায় ২০ কোটি টাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকের ফার্মগেট কর্পোরেট শাখায় কামালের চারটি ব্যাংক হিসাবের একটিতে প্রায় ৭২ লাখ, একটিতে ১ কোটি ২৯ লাখ ৪৪ হাজার, একটিতে ৫৭ লাখ ৭৮ হাজার এবং একটিতে ১ কোটি ৫ লাখ ২৯ হাজার টাকা জমা অবস্থায় পাওয়া গেছে। যা ইতোমধ্যে ফ্রিজ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, শুধু তাই নয় আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর পুরো পরিবারসহ যখন পলাতক তখনও কামালের ব্যাংক হিসাবে নগদ আড়াই কোটি টাকা জমা হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। গত ৯ অক্টোবর ক্ষমতার অপব্যবহার, নিয়োগ বাণিজ্য, ঘুষ, অর্থপাচার ও দুর্নীতির অভিযোগে আসাদুজ্জামান খান কামাল, তার স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান, ছেলে শাফি মোদাচ্ছের খান ও মেয়ে শাফিয়া তাসনিম খানের নামে পৃথক চারটি মামলা করে দুদক। একই দিন কামালের এপিএস মনির হোসেনকে আসামি করেও একটি মামলা দায়ের করা হয়।
আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর পুরো পরিবারসহ যখন পলাতক তখনও কামালের ব্যাংক হিসাবে নগদ আড়াই কোটি টাকা জমা হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে আসাদুজ্জামান খানকে চার মামলায় আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রায় শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলাগুলোর মধ্যে কামালের বিরুদ্ধে ১৬ কোটি ৪১ লাখ ৫৭ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৮টি ব্যাংক হিসাবে ৫৫ লাখ ৯২ লাখ ৪৪ হাজার ৪৩৬ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন ও মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ রয়েছে। দুদকের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম ওই মামলার বাদী হয়েছেন।
দ্বিতীয় মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খানের সঙ্গে স্বামীকেও আসামি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ— স্বামীর দুর্নীতির টাকায় সম্পদশালী হয়েছেন তাহমিনা। তাহমিনার ১০টি ব্যাংক হিসাবে ৪৩ কোটি ৭৭ হাজার ৭৪৫ টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া, ১৫ কোটি ৪৬ লাখ ৯৪ হাজার ৫৯১ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ মামলার বাদী দুদকের উপপরিচালক মুহাম্মদ জয়নুল আবেদীন।
তৃতীয় মামলার আসামি কামাল ও তার ছেলে শাফি মোদাচ্ছের খান। তাদের বিরুদ্ধে ১৯ কোটি ৮৯ লাখ ৭৮ হাজার ৫০২ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। শাফি তার নামে ব্যাংক হিসাব খুলে সেখানে ৮৪ কোটি ৭৭ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭২ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন করেছেন। এ মামলার বাদী দুদকের সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ।
চতুর্থ মামলার আসামি কামাল ও তার মেয়ে শাফিয়া তাসনিম। তাদের বিরুদ্ধে ৮ কোটি ৭৭ লাখ ৬৮ হাজার ৪৮৯ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। শাফিয়ার ব্যাংক হিসাবে ২৬ কোটি ৩৪ লাখ ৭০ হাজার ৫৪২ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন পাওয়া গেছে। এ মামলার বাদী হয়েছেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. জিন্নাতুল ইসলাম।
এছাড়া পৃথক একটি মামলার আসামি কামালের এপিএস মনির হোসেন। তার বিরুদ্ধে ১৮ কোটি ৮২ লাখ ৫৬ হাজার ১৪২ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং ব্যাংক হিসাবে ৩১ কোটি ৩১ লাখ ৭০ হাজার ৮৩৪ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন পেয়েছে দুদক। মামলার বাদী ছিলেন সহকারী পরিচালক মো. নাছরুল্লাহ হুসাইন। আসামিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা তৎসহ মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
দুদক সূত্রে জানা যায়, অভিযোগসংশ্লিষ্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অবসরপ্রাপ্ত) মো. হারুন-অর-রশিদ বিশ্বাস, যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক (সিআইডি) মোল্যা নজরুল ইসলাম, মন্ত্রণালয়ের সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্যা ইব্রাহিম হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগসমূহের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।
গত ২১ আগস্ট কামালের পরিবার এবং তার সাবেক পিএস হারুন অর রশিদ বিশ্বাস, যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন, সহকারী একান্ত সচিব মনির হোসেন এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপুসহ আটজনের ব্যাংক হিসাবের সব লেনদেনের তথ্য তলব করে দুদক। ১ সেপ্টেম্বর তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত।
আসামিদের মধ্যে কামালের ছেলে শাফি মোদাচ্ছের খানকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় হওয়া একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা জেলা পুলিশ। আসাদুজ্জামান খানসহ বাকি সব আসামি এখনো পলাতক আছেন।
Publisher & Editor