মুম্বাইয়ের আজাদ ময়দানের ধুলোময় পিচে হাজার হাজার শিশুকে ব্যাটিং করতে দেখেছেন মুম্বাইয়ের ক্রিকেট কোচ জোয়ালা সিং। শুধু একজন তাঁর জীবন বদলে দিয়েছে।
১০ বছর আগে কোনো একদিন জোয়ালা সিং সবে একাডেমির একটি ম্যাচ দেখা শেষ করেছেন। এমন সময় তিনি লক্ষ্য করলেন মাঠের পাশের নেটে দুই বালক ব্যাটিং করছে। অসম পিচে ডানহাতি ব্যাটসম্যান ভুগছে আর উচ্চ স্বরে অভিযোগ জানাচ্ছে।
আরেকজন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান এমন উইকেটেও নিজেকে দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে। জোয়ালা তখনই বুঝতে পারেন, সেই বালকের মধ্যে বিশেষ কিছু আছে। তিনি সেই বালকের খোঁজখবর নিতে শুরু করেন।
অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ দৈনিক সিডনি মর্নিং হেরাল্ডকে বিশেষ প্রতিভাবান সেই বালকের ভারতের ব্যাটিং তারকা হয়ে ওঠার গল্পই শুনিয়েছেন জোয়ালা। গল্পের শুরুতে তিনি বলেছেন, ‘আমি যখন ওর ব্যাপারে জানতে চাইলাম, আমার বন্ধু বলল, “ছেলেটার বয়স ১২ বছরের কাছাকাছি; কিন্তু ওর কোনো বাড়ি নেই, ওর কাছে খাবারও নেই।” আমার বন্ধু আরও বলল, “ছেলেটাকে নিয়ে আমার ভয় হচ্ছে। সে বাজে লোকের খপ্পরে পড়ে প্রাণ হারাতে পারে”।’
জোয়ালা এরপর বলেন, ‘কিছুক্ষণ পর ছোট্ট বালকটি নেট থেকে বেরিয়ে এল এবং হেলমেট খুলে ফেলল। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম কী? সে বলল, “আমার নাম যশস্বী জয়সোয়াল”।’
নামটা জানার পর চিনতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ভারতীয় দলের তরুণ বাঁহাতি ওপেনার জয়সোয়াল, শুক্রবার শুরু হতে চলা বোর্ডার–গাভাস্কার ট্রফিতে যাঁর কাছে থেকে দারুণ কিছুর প্রত্যাশায় আছেন ভারতের সমর্থকেরা।
সিডনি মর্নিং হেরাল্ডকে জোয়ালা বলে চললেন, ‘নাম শোনার পর আমি ওকে বললাম, এখানে কোথায় থাকো, তোমার বাড়ি কোথায়? সে বলল, ‘উত্তর প্রদেশ থেকে এসেছি। এখানে একটি তাঁবুতে থাকি। শুধু ক্রিকেটের জন্যই এখানে এসেছি”।'
যশস্বী জয়সোয়ালের জন্ম উত্তর প্রদেশের ছোট্ট শহর সুরিয়াওয়ানে। উত্তর প্রদেশ ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্যগুলোর একটি। জোয়ালা সিংয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার দুই বছর আগে বাবা ভূপেন্দ্র জয়সোয়ালের সঙ্গে ২৪ ঘণ্টার বেশি ভ্রমণ করে মুম্বাইয়ে যান যশস্বী জয়সোয়াল।
বাবা–ছেলের পরিকল্পনা ছিল মুম্বাই শহরটা ঘুরে দেখার পর আবারও সুরিয়াওয়ানে ফিরে যাবেন; কিন্তু কয়েক দিন থাকার পর জয়সোয়াল বাবাকে বললেন, তিনি মুম্বাইয়ে থেকে ক্রিকেটার হওয়ার চেষ্টা করতে চান। ভূপেন্দ্র ছেলের কথায় রাজি হয়ে যান।
মুম্বাইয়ে শুরুর দিকে এক চাচার বাড়িতে থাকতেন জয়সোয়াল; কিন্তু বাড়িটা খুব ছোট হওয়ায় তাঁকে রাখাটা চাচার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে জয়সোয়াল চাচার বাড়ি ছেড়ে আজাদ ময়দানে মাঠকর্মীদের তাঁবুতে থাকতে শুরু করেন, যে মাঠ থেকে শচীন টেন্ডুলকারের মতো কিংবদন্তি খেলোয়াড় উঠে এসেছেন। খরচ জোটাতে জয়সোয়াল একসময় মুম্বাইয়ের রাস্তায় পানিপুরিও বিক্রি করতেন।
কোচ জোয়ালা সিং জয়সোয়ালের মধ্যে যেন নিজেকেই আবিষ্কার করেছিলেন। জয়সোয়ালের মতো জোয়ালার বাড়িও উত্তর প্রদেশে। টেস্ট ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে তিনিও বাড়ি ছেড়ে মুম্বাইয়ে আসেন। জোয়ালা পেশাদার ক্লাব ক্রিকেট অবধি যেতে পেরেছেন। কিন্তু ভারতের হয়ে খেলার স্বপ্ন কখনোই পূরণ হয়নি। কিন্তু জয়সোয়ালকে দেখে তাঁর মধ্যে বিশ্বাস জন্মে ‘ছেলেটা পারবে।’ কিন্তু জয়সোয়ালকে প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গেও লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছিল।
‘ও আমাকে বলল, “আমার মা–বাবা এখানে থাকেন না। আমার হাঁটুতেও ব্যথা আছে। জানি না কী হবে।” সে যখন ওর কথাগুলো বলে যাচ্ছিল, তখনই আমি চিন্তা করতে থাকি আরে, এটা তো একদম আমার জীবনের গল্প। মুম্বাইয়ে এসে আমাকেও এমন সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়েছে। তাই আমার মনে হলো, এই সেই বালক যে আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে’—সিডনি মর্নিং হেরাল্ডকে বলছিলেন জোয়ালা সিং।
গল্পটাকে তিনি আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যান, ‘ওর কথা শোনার পর বললাম, চিন্তা কোরো না, তুমি আমার একাডেমিতে চলে এসো। আমি তোমাকে কিছু দিন পরখ করে দেখব। যদি মনে হয় আসলেই তোমার মধ্যে বিশেষ কিছু আছে, তাহলে অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করব।’
২০১৩ সালে জয়সোয়াল জোয়ালা সিংয়ের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। তখন থেকে জোয়ালাই তাঁর স্থানীয় (মুম্বাইয়ের) অভিভাবক। কোচের তত্ত্বাবধানে জয়সোয়ালের ক্রিকেটার হওয়ার পথটা সুগম হয়ে যায়। দ্রুতই ফিটনেসে উন্নতি করতে থাকেন। শট নির্বাচন ও শট খেলার সময় হাত ও চোখের সমন্বয়ও ঠিক হয়ে যায়। তবে জোয়ালা চেয়েছিলেন জয়সোয়াল যেন মানসিক দিক থেকেও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। সেই লক্ষ্যে জয়সোয়ালকে আলাদাভাবে আরও বেশি সময় দিতে থাকেন।
জোয়ালা বলেন, ‘ও তখন এক ছোট্ট বালক ছিল। ওর মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখতে পাচ্ছিলাম। কারণ, লোকে ওর মাথায় নানা ধরনের দ্বিধা ও সংশয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। মনস্তাত্ত্বিকভাবে সে খুব খারাপ অবস্থায় ছিল। হাঁটুতে চোট থাকায় ওর ফিটনেসেও ঘাটতি ছিল; কিন্তু আমি অকপটে বলেছিলাম, তুমি হবে ভারত জাতীয় দলে খেলা আমার প্রথম খেলোয়াড়।’
জোয়ালা সিংয়ের তত্ত্বাবধানে জয়সোয়ালের মধ্যে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। জোয়ালা তাঁকে ভারতের সাবেক ক্রিকেটার দিলিপ ভেংসরকার ও ওয়াসিম জাফরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। মাঠের বাইরে তাঁরাও জয়সোয়ালকে পরামর্শ দিয়েছেন। সমবয়সী খেলোয়াড়দের মধ্যে জয়সোয়াল সবার নজর কাড়তে শুরু করেন। তখন থেকেই লম্বা সময় ধরে ব্যাট করার সামর্থ্য ছিল তাঁর। হাতে গোনা দু–একবার তাঁকে দ্রুত আউট করা সম্ভব হয়েছে। জয়সোয়ালের লক্ষ্য ছিল একটাই—যতক্ষণ সম্ভব ব্যাট করে যাওয়া।
জয়সোয়ালের প্রতিভা বেশি দিন আড়াল করে রাখা যায়নি। ২০১৮ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই ভারতের অনূর্ধ্ব–১৯ দলে জায়গা করে নেন। ২০২০ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপ জিতলেও জয়সোয়ালই টুর্নামেন্টসেরা হন। সেই বছরই আইপিএল ফ্রাঞ্চাইজি রাজস্থান রয়্যালস তাঁকে কিনে নেয়।
গত বছর জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ডমিনিকা টেস্ট দিয়ে ভারত জাতীয় দলের জার্সিতে জয়সোয়ালের অভিষেক হয়। প্রথম ইনিংসেই করেন ১৭১ রান। তাতে দুটি রেকর্ডে তিনি ছাড়িয়ে যান ভারতের সাবেক দুই অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন ও সৌরভ গাঙ্গুলীকে। এরপর তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
জয়সোয়াল ভারতের হয়ে খেলতে পারায় স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তাঁর কোচ জোয়ালা সিংয়েরও। শিষ্যের খেলোয়াড়ি জীবন গড়ে দেওয়ার পর জীবন বদলে গেছে তাঁরও। মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশেই জোয়ালার ক্রিকেট একাডেমির অবস্থান। জয়সোয়ালকে কেন্দ্র করে কোচিংয়ে সফল হওয়ায় সবাই এখন তাঁর কাছে শিখতে চায়। মাঠে গেলেই অভিভাবকেরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। যেন তাঁদের সন্তানকেও নিজের কাছে রেখে জয়সোয়ালের মতো কীর্তিমান বানিয়ে দেন।
গত ফেব্রুয়ারিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে জয়সোয়াল দুটি ডাবল সেঞ্চুরি করার পর অভিভাবকদের এই আবদার আরও বেড়েছে। জোয়ালা জানেন, তাঁকে গর্বে গৌরবান্বিত করা শিষ্য জয়সোয়ালকে এবার অস্ট্রেলিয়ান চ্যালেঞ্জও নিতে হবে, নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। জোয়ালার বিশ্বাস, জয়সোয়াল পারবেন।
সেই বিশ্বাস থেকে সিডনি মর্নিং হেরাল্ডকে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, চার–পাঁচ বছরের মধ্যে সে ভারতীয় ক্রিকেটের পরবর্তী কিংবদন্তি হয়ে যাবে। এখন ওর লক্ষ্য শুধু ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করা নয়; বরং পরবর্তী কিংবদন্তি হওয়া।’
Publisher & Editor