বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

দস্তয়েভস্কি : হৃদয়ের প্রণয়নীল চিঠি

প্রকাশিত: ২৩:৩৮, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩

সাহিত্যের শিল্পবিশ্বে পরিশীলিত কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন, যারা অতুলনীয়। তাদেরই একজন ফিওদর দস্তয়েভস্কি। অস্তিত্বতাত্ত্বিক মানবাত্মার গভীরতম অন্ধকারে প্রবেশ করে তিনি অনন্য সৃষ্টির মাধ্যমে পাঠককে স্তব্ধ করেছেন, সেই দস্তয়েভস্কির জীবনে রয়েছে এমন এক দিক, যা অনেকেই জানেন না—একটি প্রেমময় হৃদয়ের কাব্যিক প্রকাশ, যা অভিব্যক্তির শিল্পভাষা। হৃদয়ের প্রণয়নীল চিঠি যাকিয়া সুমি সেতুদস্তয়েভস্কির জীবনে দুঃখ-বেদনা-দর্শন এবং অন্ধকারে কিছু ব্যক্তিগত চিঠি রয়েছে।

এই চিঠিগুলো তার হৃদয়ের গভীরতাকে উজ্জ্বল করে। চিঠিগুলো এমন এক প্রণয়নীল রঙে রাঙানো, যা প্রেম, স্নেহ ও অনুভূতির নিখুঁত মিশ্রণে আকাশ ভরা নক্ষত্র হয়ে আছে।
জোসেফ ফ্র্যাংক, দস্তয়েভস্কির অন্যতম জীবনীকার, এই চিঠিগুলোর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘আনাকে লেখা দস্তয়েভস্কির চিঠিগুলো শুধু ভালোবাসার চিঠি নয়; এগুলো অস্তিত্বের প্রতিফলন, যেখানে একজন মানুষ তার নিজের সন্দেহের সঙ্গে লড়াই করছে, তবু প্রেমের মধ্যে মুক্তির সন্ধান পাচ্ছে। এই চিঠিগুলো এক দস্তয়েভস্কিকে প্রকাশ করে, যিনি তার গাঢ় সাহিত্যিক থিমের মধ্যেও প্রেমের মুক্তিদায়ী শক্তিতে বিশ্বাস করতেন।

আনা কেবল তার প্রেরণা নয়, বরং তার আশ্রয়স্থলও ছিলেন, এবং তাদের এই চিঠিপত্র তার আত্মার শান্তির গভীর অনুসন্ধানের সাক্ষ্য দেয়।’
দস্তয়েভস্কির লেখা চিঠিগুলো মূলত তার প্রিয় দ্বিতীয় স্ত্রী আনা গ্রিগরিয়েভনার উদ্দেশে লেখা, প্রেমময় ও আবেগঘন শব্দে। এখানে এমন এক দস্তয়েভস্কিকে দেখতে পাই, যিনি গভীর প্রেম ও বিনম্রতার সঙ্গে তার স্ত্রীকে মুগ্ধ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে যারা কেবল তার কঠিন, অস্তিত্ববাদী উপন্যাসের সঙ্গে পরিচিত, তাদের কাছে এই চিঠিগুলো এক ভিন্ন দস্তয়েভস্কির পরিচয় বহন করে।

এই চিঠিতে দস্তয়েভস্কি শুধু একজন লেখক নন; বরং প্রেমিক হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেছেন, তার হৃদয়ের প্রতিটি খুঁটিনাটি আনার কাছে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। এগুলোর গভীর আবেগময় সুর, কেবল দস্তয়েভস্কির বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ নয়; বরং তার কোমল, দুর্বল, অত্যন্ত সংবেদনশীল হূদয়েরই প্রতিচ্ছবি। এসব চিঠিতে দস্তয়েভস্কির আনার প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রকাশিত। পাশাপাশি আনা তাকে কিভাবে আত্মিক শান্তি ও শক্তি দিয়েছিল তা-ও উদ্ভাসিত হয়েছে।
ফিওদর দস্তয়েভস্কি ও আনা গ্রিগরিয়েভনার মধ্যে লেখা চিঠিগুলো ১৮৬৬ থেকে ১৮৮১ সালের মধ্যে লেখা হয়েছিল, মূলত রুশ ভাষায়।

চিঠিগুলো পরবর্তী সময়ে ‘Dear Friend, I Have Devoted My Life to You: Selected Letters of Fyodor Dostoevsky’  নামের সংকলনে একত্রিত হয়, যা ১৯৮৭ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ডেভিড লাভিন। বইটি বিশ্বব্যাপী পাঠকদের কাছে পৌঁছে এবং দস্তয়েভস্কির আত্মিক দ্বন্দ্ব, প্রেম এবং আনার প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা তুলে ধরে। ইংরেজি অনুবাদক ডেভিড লাভিন, যিনি এই চিঠিগুলোর সংকলন  ‘Dear Friend, I Have Devoted My Life to You’  শিরোনামে প্রকাশ করেছিলেন।
দস্তয়েভস্কি ও আনা গ্রিগরিয়েভনার সম্পর্কের সূচনা ও বিয়ে এক রোমাঞ্চকর অধ্যায়।

১৮৬৬ সালে, দস্তয়েভস্কি এক গভীর আর্থিক সংকটে ছিলেন। তার ঋণ অত্যধিক পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল এবং তিনি অবশেষে এক অপ্রিয় চুক্তিতে বাধ্য হন। চুক্তিটির শর্ত ছিল, তিনি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি উপন্যাস লিখে জমা দিতে না পারলে তার সব সাহিত্যিক কাজের অধিকার হারাতে হবে। এই চুক্তি পূরণ করার জন্য আনা গ্রিগরিয়েভনাকে স্টেনোগ্রাফার হিসেবে নিয়োগ করেন।

আনা তখন ছিলেন মাত্র ২০ বছর বয়সী এক তরুণী। দস্তয়েভস্কির চেয়ে প্রায় ২৫ বছরের ছোট। কিন্তু সাহিত্যের প্রতি আনার অগাধ শ্রদ্ধা, আন্তরিক সহানুভূতি দ্রুতই একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। তা ছাড়া সেই সংকটের মুহূর্তে আনার সহযোগিতা ও নীরব অনুপ্রেরণা দস্তয়েভস্কিকে মানসিকভাবে শক্তি দেয়। পরে দস্তয়েভস্কি ১৮৬৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আনাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, এবং কিছুদিনের মধ্যেই তারা বিয়ে করেন। আনা দস্তয়েভস্কির শুধু একজন জীবনসঙ্গী নন, বরং একজন নির্ভরযোগ্য সঙ্গী। দস্তয়েভস্কির লেখালেখিতে সাহায্য করেছেন এবং মানসিক, আর্থিক ও সৃজনশীল বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করেছেন। ফলে তাদের সম্পর্ক গভীর আত্মিক বন্ধনে রূপান্তরিত হয়, যা দস্তয়েভস্কির শেষ জীবনের প্রতিটি ধাপেও প্রভাব ফেলেছিল।

দস্তয়েভস্কি সম্পর্কে খ্যাতনামা জীবনীকার জোসেফ ফ্র্যাংক তার বিখ্যাত বই  ‘Dostoevsky: A Writer in His Time’

 সিরিজে লিখেছিলেন যে আনা ছিলেন দস্তয়েভস্কির জীবনের ‘একটি শান্তির আশ্রয়’। ফ্র্যাংকের পর্যবেক্ষণে দস্তয়েভস্কির চিঠিগুলো কেবল ভালোবাসার প্রকাশ নয়, বরং এটি তার ‘অন্তর্দৃষ্টি, কষ্ট ও অব্যাহত ভালোবাসায় আশ্রয়ের  ‘Dear Friend, I Have Devoted My Life to You: Selected Letters of Fyodor Dostoevsky’

 বইটির নামটির মূল ভাবনা ইংরেজি অনুবাদক ও সম্পাদকদের পক্ষ থেকেই আসে। তবে মূল রুশ চিঠিগুলো থেকে এই শিরোনামটি নির্বাচন করা হয়, যা দস্তয়েভস্কির আনাকে লেখা চিঠিরই একটি পঙিক্তর ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এই সংকলনে মোট ৪৭টি চিঠি রয়েছে।

চিঠিগুলোর বেশির ভাগই তার প্রিয় দ্বিতীয় স্ত্রী আনা গ্রিগরিয়েভনাকে লেখা, যেগুলো তাদের প্রেম, সম্পর্কের জটিলতা এবং দস্তয়েভস্কির জীবনের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করে। বইটির প্রচ্ছদ ও সংকলনের পরিকল্পনা মূলত অনুবাদক ও প্রকাশনা দলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। সাধারণত এমন বইয়ের ক্ষেত্রে প্রকাশক ও সম্পাদকরা দস্তয়েভস্কির ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি আগ্রহী পাঠকদের চাহিদা মেটানোর জন্য সংকলনটি তৈরি করেন। এই চিঠিগুলো প্রকাশিত হওয়ার পেছনে মূলত দস্তয়েভস্কির ব্যক্তিজীবন, তার দার্শনিক চিন্তা এবং আনা গ্রিগরিয়েভনার সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে বিশ্বব্যাপী সাহিত্যপ্রেমীদের কৌতূহল একটি বড় কারণ।

চিঠিগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল দস্তয়েভস্কির পারিবারিক সংগ্রহ এবং রুশ আর্কাইভ থেকে, যেখানে তার ব্যক্তিগত চিঠিপত্র সংরক্ষিত ছিল। আনা তার চিঠিগুলোর বেশ কিছু অংশ সংরক্ষণ করেছিলেন এবং এগুলোর অনেক অংশই তাদের পরিবার ও ব্যক্তিগত সংগ্রহের মধ্যে রক্ষিত ছিল।

দস্তয়েভস্কির কিছু নির্বাচিত চিঠির অংশে রয়েছে তার গভীর ভালোবাসার প্রত্যয়। যেমন—দস্তয়েভস্কির আনাকে লিখেছেন : ‘প্রিয় আনা, তোমার ভালোবাসা আমার অন্ধকারে একমাত্র আলো। তোমাকে ছাড়া আমি কিভাবে আমার অস্তিত্বের বোঝা বইতাম, জানি না। তোমার প্রতি প্রতিটি ভাবনা আমাকে শান্তি দেয়, প্রতিটি স্মৃতি আনন্দ দেয়।’

দস্তয়েভস্কির আরেকটি চিঠি : ‘তোমাকে হারানোর চিন্তা আমার আত্মাকে কাঁপিয়ে তোলে, কারণ তোমাকে ছাড়া জীবন কেবল এক শূন্য মরুভূমি।’

আরেকটি চিঠিতে দস্তয়েভস্কির লেখা : ‘তোমাকে দেখি, প্রিয়তমা, পৃথিবীর সবচেয়ে কোমল ও দয়ালু মানুষ হিসেবে, যার উপস্থিতি আমার জীবনের সমস্ত কঠিন প্রান্তকে মসৃণ করে দেয়। তোমাকে ভালোবাসা মানে নিঃশ্বাস নেওয়া, জীবিত থাকা।’

আনার প্রতি দস্তয়েভস্কির ভালোবাসার চিঠিগুলো একজন মানুষ ও মনকে নিবিড়ভাবে জানার সুযোগ করে দেয়, যিনি প্রায়শই যন্ত্রণা ও অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলেন। প্রণয়নীল এক রং, যা নীলের গভীরতা এবং বেগুনির উত্তেজনার মিশ্রণ। এটি একটি গম্ভীর অথচ প্রশান্ত রং, যা দস্তয়েভস্কির জটিল আবেগের প্রতীক—একদিকে তার দুঃখময় জীবন, অন্যদিকে আনার স্নেহময় ভালোবাসা, একত্রিত। প্রণয়নীলের মতো এই চিঠিগুলো এমন এক গভীর, প্রশান্ত প্রেম প্রকাশ করে, যা উদ্দীপ্ত অথচ শান্ত, বিষণ্ন, মনোমুগ্ধকর, গভীর ও উজ্জ্বল। এই প্রণয়নীল চিঠিগুলো পড়া মানে সেই ভালোবাসাকে উপলব্ধি করা, যা দস্তয়েভস্কির জন্য ছিল একটি আশ্রয়।  আনার প্রতি তার ভালোবাসায় তিনি এমন সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছিলেন, যা তার উপন্যাসের চরিত্রগুলোর জন্য এক ধরনের রহস্য ছিল—এক সৌন্দর্য, যা তার যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবনেও এক টুকরো আলোর মতো। দস্তয়েভস্কি-আনা তাদের প্রণয়নীল আকাশে চিরদিন শিল্পভাষায় আন্দোলিত, জ্বলজ্বল।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor