বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

ট্রাম্পের ইরান আর গাজানীতি কেমন হবে

প্রকাশিত: ২৩:১৫, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৭

ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের কাছে কোনো চমক ছিল না। ট্রাম্প জিতছেন—এমনটি ধরে নিয়ে এ অঞ্চলের সরকারগুলো আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছিল। তারা ট্রাম্পের শপথ নেওয়ার এক মাস আগেই তাঁর সঙ্গে কাজ করার সব প্রস্তুতি শেষ করেছে।

তবে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্যে যে পরিস্থিতি ছিল, আজকের মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

এই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে ইরান ও গাজায়।

ইরান দিয়ে শুরু করা যাক। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করতে যে যৌথ সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা (জেসিপিওএ, যেটি ইরান চুক্তি নামে পরিচিতি পেয়েছে) চুক্তি করা হয়েছিল, ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে সে চুক্তি বাতিল করেছিলেন। সেই সময় ইরানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মধ্যপন্থী হাসান রুহানি।

২০২১ সালে তাঁকে পরিবর্তন করে অতি রক্ষণশীল ইব্রাহিম রাইসিকে দায়িত্বে আনা হয়। কিন্তু বর্তমানে ইরানের প্রেসিডেন্ট পদে আবার একজন অপেক্ষাকৃত মধ্যপন্থী নেতা এসেছেন। তিনি মাসুদ পেজেশকিয়ান।

পেজেশকিয়ান দায়িত্ব নেওয়ার আগেই ইরান তার আরব প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০২৩ সালের মার্চে ইরান ও তার প্রধান আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন হয়। এই অপ্রত্যাশিত ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা একটি চলমান চীনা উদ্যোগের অংশ, যা কিনা এই অঞ্চলে উত্তেজনা কমানো ও স্থিতিশীলতা বাড়ানোর লক্ষ্যে গ্রহণ করা হয়েছিল।

আরেকটি পরিবর্তন হলো চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে (এবং তারা একে অপরের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নত করেছে)। ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে চীন ও ইরানের প্রতি সব সময় শত্রু ভাবাপন্ন ছিলেন; যদিও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের একধরনের ‘ব্রোম্যান্স’ ছিল।

কিন্তু ট্রাম্প ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ বন্ধে পুতিনের সঙ্গে সরাসরি সমন্বয় করার আগ্রহ দেখালেও তাঁকে এ দফায় নতুন সম্পর্কের গতিশীলতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পা ফেলতে হবে।

যাই হোক, মধ্যপ্রাচ্যে শত্রুতা কমানো সহজ হবে না। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েল গাজায় অভিযান চালায়। এই হামলা এখন পর্যন্ত বহু বেসামরিক মানুষের মৃত্যু, বাস্তুচ্যুতি এবং কষ্টের কারণ হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স লেবাননে যুদ্ধবিরতি আনতে সক্ষম হয়েছে এবং ট্রাম্পের শপথ নেওয়ার আগেই ইসরায়েলের হিজবুল্লাহবিরোধী অভিযান শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে, লেবাননে শান্তি চুক্তি হলে গাজায় একই রকম চুক্তি করা সহজ হবে নাকি কঠিন হবে, তা এখনই বলা মুশকিল। কারণ, অনেক বিষয়েই ট্রাম্পের অবস্থান পরিষ্কার নয়।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে বোঝা তুলনামূলক সহজ। তিনি এবং তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন একটি নির্দিষ্ট মাত্রার জায়নবাদী মতাদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গি বহন করেন। সে কারণে বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলকে তার অভিযান বন্ধ করতে বলেছে এবং গাজার বেসামরিক মানুষের পরিস্থিতি উন্নত না হলে ইসরায়েলকে সাহায্য বন্ধের হুমকি দিয়েছে; যদিও একই সঙ্গে তারা ইসরায়েলের কার্যকলাপকে ন্যায্যতা দেওয়া এবং অস্ত্র সরবরাহ দেওয়া চালিয়ে গেছে।

লেবাননে যুদ্ধবিরতির পরও বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলের কাছে ৬৮ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রির পরিকল্পনা করছে বলে খবর বেরিয়েছে।

ট্রাম্পও ইসরায়েলের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার একই ধরনের প্রবণতা দেখিয়েছেন। তাঁর প্রথম প্রশাসনের সময় তিনি কয়েক দশকের স্থিতিশীল নীতি ভেঙে মার্কিন দূতাবাসকে তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করেছিলেন; দখলকৃত গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সহায়তাকারী প্রধান কর্মসূচি জাতিসংঘের রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সির (ইউএনআরডব্লিউএ) অর্থায়ন বন্ধ করেছিলেন।

এ ছাড়া ট্রাম্প আরব-ইসরায়েল ‘স্বাভাবিককরণ প্রক্রিয়া’ শুরু করেছিলেন। এর মাধ্যমে ২০২০-২১ সালে ইসরায়েল সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো এবং সুদানের সঙ্গে তথাকথিত আব্রাহাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল।

ট্রাম্প তাঁর নতুন প্রশাসনে প্রচুর ইসরায়েলপন্থী ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করছেন। তবে গাজার যুদ্ধের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের নির্দিষ্ট কোনো আদর্শিক অঙ্গীকার না থাকার কারণে তাঁর লক্ষ্য খুবই স্পষ্ট। তা হলো, একটি চুক্তি করা। তবে বোঝা যাচ্ছে, যে চুক্তিই হোক না কেন, তা সম্ভবত ফিলিস্তিনিদের জন্য ক্ষতিকর হবে। এর কারণ শুধু মার্কিন প্রশাসনের ইসরায়েলপন্থী মনোভাব নয়, বরং বাইরের মধ্যস্থতায় হওয়া চুক্তিগুলোও সাধারণত বিদ্যমান শক্তির ভারসাম্যকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে; আর এটি স্পষ্টতই ইসরায়েলের পক্ষে যায়।

ফিলিস্তিনিরা আরব দেশগুলোর কাছ থেকেও খুব বেশি সমর্থন পাচ্ছে না। অবশ্য, সৌদি আরব ঘোষণা করেছে, ১৯৬৭ সালের সীমানার মধ্যে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠিত না হলে তারা ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে না। কিন্তু ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিককরণে প্রস্তাবকৃত আব্রাহাম চুক্তিগুলো চাপের মুখে থাকলেও এখনো তা ভেঙে পড়েনি।

ইসরায়েলি সাংবাদিক বারাক রাভিদের মতে, ট্রাম্প হয়তো ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর ক্ষোভ পুষে রাখতে পারেন। কারণ, ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প পরাজিত হওয়ার পর নেতানিয়াহু তড়িঘড়ি করে বাইডেনকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এতে ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। সে জন্য বহুবার শত্রুদের টার্গেট করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া ট্রাম্পের পক্ষে সেই ক্ষোভ ধরে রাখা একেবারেই অসম্ভব নয়।
তবে ট্রাম্প যদি নতুন কোনো চুক্তি করেন, সেটি ইসরায়েলের জন্যও খুব ভালো না–ও হতে পারে। ইসরায়েলি সাংবাদিক বারাক রাভিদের মতে, ট্রাম্প হয়তো ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর ক্ষোভ পুষে রাখতে পারেন। কারণ, ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প পরাজিত হওয়ার পর নেতানিয়াহু তড়িঘড়ি করে বাইডেনকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এতে ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। সে জন্য বহুবার শত্রুদের টার্গেট করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া ট্রাম্পের পক্ষে সেই ক্ষোভ ধরে রাখা একেবারেই অসম্ভব নয়।

সবচেয়ে সম্ভাব্য পরিস্থিতি হলো, বর্তমান যুদ্ধ শেষ হয়ে ৭ অক্টোবরের আগে যে অবস্থা ছিল, সে অবস্থায় ফিরে যাওয়া। তবে ট্রাম্পের অস্থিরতা এবং ইসরায়েলপন্থী মনোভাবের কারণে এ অঞ্চলের অনেকেই চিন্তা করছেন, ট্রাম্প হয়তো পশ্চিম তীরের কিছু অংশ ইসরায়েলকে দখল করতে অনুমতি দেবেন কিংবা গাজায় ইহুদি বসতি স্থাপনে সায় দেবেন।

ট্রাম্প এর আগেও একটি ইসরায়েলপন্থী চুক্তি করার চেষ্টা করেছিলেন। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তিনি তাঁর মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশ করেছিলেন। সেই চুক্তিকে তিনি ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’ বলেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে চুক্তি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়।

সমস্যা হলো, ফিলিস্তিনিরা যখনই দেখবে, দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের কোনো সম্ভাবনাই আর নেই, তখনই তারা কড়া প্রতিক্রিয়া দেবে। সে কারণে ট্রাম্প যদি ৭ অক্টোবরের আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার লক্ষ্যে চুক্তি করেনও, সে চুক্তি বেশি দিন টিকবে না।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor