সিরিয়ার বিদ্রোহী আক্রমণ প্রায় সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। বিদ্রোহী দলগুলো বছরের পর বছর ধরে ছিল একে অপরের দুশমন। এখন তারা এক হয়ে মাঠে নেমেছে। তাহরির আল-শাম ও অন্যান্য গোষ্ঠীগুলো দ্রুত সিরিয়ার দ্বিতীয় বড় শহর আলেপ্পো, এর বিমানবন্দর এবং বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি দখল করেছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ এতে কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছেন।
লেবাননে হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি হওয়ার পরপরই একটি ঘটনা ঘটেছে। ঠিক এমন সময় আক্রমণ শুরু হলো সিরিয়ায়। ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ইরান এখন আরও শক্তিশালী ইসরায়েলি আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ইসরায়েল চলে যাচ্ছে এক ফ্রন্ট থেকে অন্য ফ্রন্টে—গাজা থেকে, লেবানন হয়ে এখন ইরানে। কিন্তু তার জনগণকে সন্তুষ্ট কবার মতো সাফল্য আসছে না।
তাহরিরের নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি জন্মেছেন গোলান হাইটসে। তিনি সিরিয়া সরকারের সাবেক এক উপদেষ্টার কনিষ্ঠ পুত্র। ৯/১১-এরপর কট্টর ধর্মীয় পথে পা বাড়ান। ২০০৩ সালে তিনি ইরাকের মসুলে সক্রিয় একটি ছোট গোষ্ঠী সারায়া আল-মুজাহিদিনে যোগ দেন। ২০০৪ সালে ইরাকে আল-কায়েদা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই গোষ্ঠী আল-জারকাভির প্রতি আনুগত্য করে। পরে তা ইসলামিক স্টেট (আইএস) গ্রুপে পরিণত হয়।
জোলানিকে এরপর আটক হয়ে কুখ্যাত মার্কিন সামরিক হোল্ডিং সেন্টার ক্যাম্প বুক্কায় আসতে হয়। সেখানে তিনি ইরাকি জিহাদিদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেন। ২০১১ সালে তাঁর মুক্তির কিছুক্ষণ পরই সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলো। এই সব ছিল আজকের তাহরিরের উত্স। এই গ্রুপ ২০১৬ সালে আল-কায়েদা ও এর বিশ্বব্যাপী জিহাদি মিশন ত্যাগ করেছিল।
জোলানি কি আসলেই আন্তর্জাতিক জিহাদ ছেড়ে দিয়ে, নিজেকে ও তাঁর আন্দোলনকে আল-কায়েদা ও আইএসের সক্রিয় অংশ থেকে সরিয়ে রাতারাতি সিরিয়ার জাতীয়তাবাদী দলে রূপান্তরিত করেছেন? নাকি এ কেবল এক নিছক রিব্র্যান্ডিং?
তাহরির নিয়ন্ত্রিত ইদলিবের বাসিন্দারা জানান যে সেখানে শরিয়া কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয় না। রবার্ট ফোর্ড সিরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত। তিনি ২০১২ সালে তাহরিরকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। ফোর্ড বলেছেন যে তাহরির এখন আগের মতো কট্টরপন্থী নেই—‘তারা খ্রিষ্টানদের গির্জা পুনর্নির্মাণের অনুমতি দিচ্ছে। জিহাদিরা সাধারণত তা করে না’। তাহরির আল-শামের এক কমান্ডার সম্প্রতি খ্রিষ্টান ও আর্মেনীয়দের রক্ষা করার আহ্বান জানিয়ে একটি বক্তৃতা দিয়েছেন।
তুর্কি–সমর্থিত সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এসএনএ) কুর্দিদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে, সেটাই এখন বড় উদ্বেগের বিষয়। বিদ্রোহী দলগুলো আলেপ্পো ও এর গ্রামাঞ্চল দখলের ফলে কয়েক হাজার সিরিয়ান কুর্দি এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এসব অঞ্চলে এক লাখের বেশি কুর্দি বাস করে। ২০১৬ সালে কুর্দিদের দখলে এলে এলাকার অনেক সিরিয়ান আরবকে তুর্কি-নিয়ন্ত্রিত আজাজে পালিয়ে যেতে প্ররোচিত করা হয়েছিল। ফলে কুর্দিদের প্রতি তাহরিরের আশ্বাসে কতটা ভরসা রাখা যায়, তা বোঝা যাচ্ছে না।
এই পরিস্থিতির অন্যতম প্রভাবক শক্তি হচ্ছে তুরস্ক। এই আক্রমণ তুরস্কের সবুজ সংকেত ছাড়া সম্ভব ছিল না। তুরস্ক সরাসরি সিরীয় জাতীয় বাহিনীকে অর্থায়ন এবং অস্ত্র সরবরাহ করে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এখন শরণার্থী সংকট কমানোর চাপে রয়েছেন। সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা এলে তুরস্কে থাকা তিন মিলিয়ন শরণার্থীর অনেকেই তাঁদের দেশে ফিরে যাবেন।
উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার বেশির ভাগ অংশ মূলত কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) নিয়ন্ত্রণে আছে। তারা কয়েক দশক ধরে কুর্দি স্বায়ত্তশাসনের সমর্থনে তুরস্কের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। আঙ্কারার দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, এই সীমান্ত এলাকা পিকেকের হাত থেকে অন্য কারও নিয়ন্ত্রণে দেওয়া।
ঘরে শরণার্থী সংকট কমাতে চাপের মুখে আছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। এ জন্য তিনি আসাদের সঙ্গে বৈঠকের চাপ দিয়েছেন। আসাদ তাতে রাজি হননি। এমন এক সময় বিদ্রোহী আক্রমণ শুধু তুরস্ক নয়, রাশিয়ার জন্যও হতাশাজনক। এদিকে আবার ইরান তুরস্ককের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনেছে। জানিয়েছে, সিরিয়া অনুরোধ করলে ইরান সিরিয়ায় তাদের বাহিনী মোতায়েন করবে।
ইরান, তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে একটি শীর্ষ সম্মেলন হবে দোহায়। সেখানে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভও হাজির থাকবেন। তুরস্ক–সমর্থিত একটি বিদ্রোহী বাহিনী সিরিয়ায় এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে উত্তর সিরিয়ায় তুরস্কের ভূমিকা এখন আর দর্শকের নয়।
তবে ইরানকে বুঝতে হবে যে এবার অবস্থা ভিন্ন। উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো আসাদের পেছনে রয়েছে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও তাঁর সাবেক পরামর্শদাতা আরব আমিরাতের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ বিন জায়েদ নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে আসাদকে সম্পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার কথা জানিয়েছেন।
এসব সাম্প্রতিক ঘটনা হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্রের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পুনঃসরবরাহকে ব্যাহত করতে পারে। ইরানের সৈন্যদের জন্য হয়তো নতুন কৌশল নিতে হতে পারে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিয়ন সার তুরস্ক ও ইরানকে দুর্বল করার জন্য রাষ্ট্রহীন কুর্দি ও দ্রুজদের সঙ্গে একটি আনুষ্ঠানিক জোটের কথা ভাবছিলেন। এই ভাবনা এখন নিতান্ত বোকামি বলে মনে হচ্ছে। সিরিয়া বা মিসরে যেকোনো শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন এই অঞ্চলে ইসরায়েলের পরিকল্পনার জন্য গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
আসল কথা হলো, ইসরায়েল যতক্ষণ না ফিলিস্তিনে দখলদারত্ব বন্ধ করে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই অঞ্চলে সংকট আর যুদ্ধ থামবে না। এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।
Publisher & Editor