হাজার হাজার সিরিয়ান দামেস্ক এবং সিরিয়ার অন্যান্য স্থানে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন বাশার আল-আসাদের ২৪ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের পতন উদ্যাপন করতে। বিদ্রোহীরা কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই দামেস্কে প্রবেশ করে সরকারি দপ্তরগুলো দখল করে ফেলেন। পিছু হটেন আসাদ বাহিনী এবং সরকারি কর্মীরা ।
রাশিয়া দাবি করে যে আসাদকে মানবিক কারণে মস্কোতে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ গাজি আল-জালালি ভিডিও বার্তায় জানান, তিনি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগপর্যন্ত শাসনব্যবস্থা চালিয়ে যেতে প্রস্তুত। বিদ্রোহী নেতা আহমদ আল-শারাআ তাঁর বাহিনীকে সরকারি প্রতিষ্ঠান রক্ষার নির্দেশ দেন। বিদ্রোহীরা মুক্তি দেন হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দীকে।
হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) এখন সিরিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি। এরা আসাদের পতন ঘটিয়েছে। সিরিয়ার বড় অংশে আছে এদের আধিপত্য। মার্কিন সেনা এবং রাশিয়ার ঘাঁটির উপস্থিতির পাশাপাশি, সিরিয়া বিভিন্ন দলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এদের মধ্যে কিছু দল যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত, যেমন ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টি (পিওয়াইডি)। পিওয়াইডি কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) সিরিয়ান শাখা। এদেরকে তুরস্ক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ২০১৭ সাল থেকে এরা আসাদ শাসনের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে কাজ করছে। মার্কিন সমর্থনপ্রাপ্ত দল হলো ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (এফএসএ) এবং সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ)। এসডিএফ উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে।
কিছু পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করতেন যে আল-আসাদ একটি প্রতিরোধ জোটের অংশ ছিলেন। এই জোটে ছিল ইরান, ইরাক, ইয়ামেন, লেবানন এবং গাজা। তাঁদের মতে, আল-আসাদের পতনে ফিলিস্তিনিদের অবস্থা আরও খারাপ হবে। অন্যদিকে অনেকে মনে করেন যে আসাদ শাসন ছিল কেবল ইসরায়েলিদের দখলদারির রক্ষক। তাঁরা আসাদের পতন এবং সিরিয়ায় এইচটিএসের উত্থানে উদ্বিগ্ন।
একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে, আমি আল-আসাদকে শুধুই ইসরায়েলের রক্ষক হিসেবে দেখি। ইসরায়েলি দখলের বিরুদ্ধে কথিত শত্রুতাকে কাজে লাগিয়ে আসাদ নিজের স্বৈরাচারী শাসনকে সুসংহত করেছেন। সেই শাসনের ভিত্তি ছিল সিরিয়ানদের দমন, তাদের স্বাধীনতা হরণ এবং ইসরায়েলি দখলের বিরুদ্ধে প্রকৃত প্রতিরোধের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করা।
আসাদের স্বৈরশাসন আসলে ছিল ১৯৭৪ সালে আসাদের বাবা এবং ইসরায়েলের মধ্যে স্বাক্ষরিত বিযুক্ত থাকার চুক্তির অংশ। ছয় দিনের যুদ্ধের পর কয়েক মাস ধরে চলা সংঘর্ষের অবসান ঘটিয়ে এই চুক্তি করা হয়েছিল। চুক্তির শর্ত অনুসারে জাতিসংঘ পরিচালিত একটি বাফার জোন তৈরি করা হয়।
ইসরায়েল সিরিয়ার বেশ কিছু এলাকায় দখল নেবেে। এর ফলে আল-জুলানি ইসরায়েলের সঙ্গে নতুনভাবে হিসাব-নিকাশ করার সুযোগ পাবেন। আর যদি তা ঘটে, তাহলে আমেরিকা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো হস্তক্ষেপ করবে সিরিয়ায় বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। আসাদ এই মার্কিন মধ্যস্থতাকারী চুক্তির শর্ত মেনে চলতেন। তবে আমি জন্মের পর থেকে দেখেছি ইসরায়েলিরা বারবার এই চুক্তি লঙ্ঘন করছে। প্রতিবার লঙ্ঘনের পর আসাদ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে অভিযোগ জানাতেন। উপযুক্ত সময় ও স্থানে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতেন। সেই প্রতিশোধ কখনই নেওয়া হয়নি।
ইসরায়েল ও আরবদের মধ্যে এই শান্তিচুক্তি ৪৫ বছরের বেশি সময় ধরে টিকে ছিল। এই সময়ে, আসাদ সিরিয়াকে ইসরায়েল এবং আরব ও মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে একটি বাফার জোনে পরিণত করেছেন। ইরানের সঙ্গে সম্পর্ককে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে দমন করেছেন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সব প্রচেষ্টা। ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে ইসরায়েল গোলান মালভূমি দখল করার পরেও আসাদ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
আসাদ পরিবারের শাসনামলে শুধু সিরিয়ানরাই ভুক্তভোগী হয়েছেন এমন নয়। ৫০ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থীও ভুগেছে। ২০১১ সালে শুরু হওয়া সিরিয়ার বিদ্রোহকে দমন করতে আসাদ সরকার শত শত ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, আটক করেছে, গুম করেছে এবং বাস্তুচ্যুত করেছে।
আসাদের পতনের পর, মুক্তি পেয়েছেন হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসাম ব্রিগেডের সদস্যসহ ৬০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনি বন্দী । হামাস যোদ্ধারা কখনো সিরিয়া থেকে ইসরায়েলি দখলের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধ করেনি। তবুও ইসরায়েলকে রক্ষা করার দায়িত্ব হিসেবে তাদের আটক করা হয়েছিল।
অনেকে উল্লেখ করেন যে আসাদ আশ্রয় দিয়েছিলেন হামাস নেতাদের। সিরিয়ার ভূমিকে তিনি তাঁদের প্রশিক্ষণ ঘাঁটির জন্য ব্যবহার করতে দিয়েছেন। কিন্তু এর ফলে তথাকথিত ‘প্রতিরোধ জোট’ মজবুত হয়েছে। আর ইসরায়েল নিজের ‘অস্তিত্বের প্রতি হুমকি’র অজুহাত দেখিয়ে যুদ্ধ করার সুযোগ পেয়েছে।
এখন সিরিয়ায় আসাদের শাসনামল শেষ হয়ে হিজবুল্লাহর অস্ত্র রসদের জোগান ধ্বংস হওয়ার কারণে সুন্নি মুসলিমরা এ অঞ্চলে একটি প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। এই বাস্তবতা ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য ইতিবাচক হবে।
অনেকে দাবি করেন যে আল-জুলানি একজন চরমপন্থী। বলা হয় যে তাঁর নেতৃত্বে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা বাড়বে এবং শরিয়া আইনের চরমপন্থী ব্যাখ্যা ছড়িয়ে পড়বে। বাস্তবতা হচ্ছে, আল-জুলানি মার্কিন-সমর্থিত আল-কায়েদা ছেড়ে এসেছেন। তিনি বেশিরভাগ মধ্যপন্থী এবং কার্যকর বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে একত্রিত করে ইদলিবে প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি স্থিতিশীল আধা-রাষ্ট্র। সেখানে সংখ্যালঘুদের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। শরিয়া আইন কেবল সেখানে কার্যকর হয়েছে যেখানে জনগণ তা মেনে নিয়েছে। খ্রিস্টানদের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে গির্জায় উপাসনার ।
আল-জুলানি এমন একটি সফল শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন, যা সামরিক খাতসহ সব ক্ষেত্রে কার্যকর। তিনি উন্নত গোয়েন্দা ড্রোন, বড় ওয়ারহেডযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জামের ব্যবস্থা করেছেন, যা অধিকাংশ স্বাধীন আরব দেশ তৈরি করতে পারেনি।
এখন তাঁর যে কাজগুলো করা উচিত, তা হচ্ছে সিরিয়াকে স্থিতিশীল করা, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য কাজ করা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন করা, বিভিন্ন সম্প্রদায় এবং জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক পুনর্মিলন ঘটানো, নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা এবং সিরিয়ার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মেরামত করা। এই কাজগুলো সম্পন্ন করার পর তিনি ইসরায়েলের দিকে মনোযোগ দিতে পারবেন।
রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল কোনো অস্থিতিশীল দেশ পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বল দেশটির সঙ্গেও যুদ্ধ করতে পারবে না। গোলান মালভূমির বাসিন্দা আল-জুলানি কখনো নিজের জন্মভূমির কথা ভুলবেন না।
এদিকে ইসরায়েল ঘোষণা করেছে যে তারা সিরিয়ার সঙ্গে শান্তিচুক্তি থেকে সরে আসছে। তাদের দাবি অনুযায়ী চুক্তিটি ‘ধসে পড়েছে’। ইসরায়েল দখলদার বাহিনীকে গোলান মালভূমির বাফার জোন, হর্মন পর্বত এবং আল-কুনেইত্রা প্রদেশের বেশ কিছু এলাকায় দখল নিতে নির্দেশ দিয়েছে। এর ফলে আল-জুলানি ইসরায়েলের সঙ্গে নতুনভাবে হিসাব-নিকাশ করার সুযোগ পাবেন। আর যদি তা ঘটে, তাহলে আমেরিকা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো হস্তক্ষেপ করবে সিরিয়ায় বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে।
সিরিয়ায় এখন ইসরায়েল এবং তার মিত্ররা বর্তমান পরিস্থিতিকে ব্যাহত বা বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে। এর একটি কারণ হতে পারে এই যে, আসাদকে উৎখাত করা এবং ‘প্রতিরোধ জোট’-এর পতন ফিলিস্তিনিদের জন্য আসলে ইতিবাচক।
Publisher & Editor