শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

ব্যাংকিং খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারে কী করে

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৫

দুনিয়ার সব সেরা ও সফল বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের বৈশিষ্ট্য হলো এগুলো পরিচালনা পর্ষদের সহযোগিতা, তদারকি ও নিরীক্ষণের মধ্যে থেকেও স্বাধীনভাবে কাজ করে। নির্দিষ্ট নিয়মানুসারে চলা এসব তদারকির মধ্যে কোনো অবাঞ্ছিত কিংবা অযৌক্তিক হস্তক্ষেপ হয় না। লব্ধপ্রতিষ্ঠ এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কৌশলগত এবং কার্যপ্রণালির প্রধান সিদ্ধান্তগুলো পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক উপযুক্ত নিরীক্ষা, পর্যালোচনা ও অধ্যবসায়ের পর চূড়ান্ত প্রয়োগ করা হয়। 

নিবিড় পর্যবেক্ষণের পর দেখা গেছে, অনেক ব্যাংকের সফলতার পেছনে অনেক স্বাধীন পরিচালকের প্রধান ভূমিকা থাকে, যাঁরা কিনা ব্যক্তিগত স্বার্থের বাইরে থেকে ব্যাংকের উন্নতি ও অর্জনের কথা চিন্তা করে কাজ করেন। উদ্বেগের বিষয় হলো বাংলাদেশের বেশির ভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংক স্বাধীন কিংবা স্বায়ত্তশাসিত নয়। পঞ্চাশের অধিক বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে শুধু কিছুসংখ্যক ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ দ্বারা সঠিক দিকনির্দেশনা ও সহযোগিতায় আংশিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত। বলা বাহুল্য, এই মুষ্টিমেয় ব্যাংকই দেশে সবচেয়ে সফল, দৃঢ় ও প্রশংসিত।

অন্যদিকে বাংলাদেশের ‘পরিচালনা পর্ষদ’ নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলো দৈনিক ভিত্তিতে তাদের দ্বারা চালিত; কিন্তু নীতি কার্যকর করার ক্ষেত্রে এখানে পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে ব্যবস্থাপনা পর্ষদের ভারসাম্য ও সমঝোতার অভাব রয়েছে। এই সমঝোতা ও ভারসাম্যের অভাবের কারণ হলো বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ অধিক কর্তৃত্বপরায়ণ। আমাদের বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সরাসরি তাদের মালিকানার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, এমনকি মালিকদের নিকটাত্মীয়রাও প্রভাবশালী হিসেবে পরিগণিত হন।

এ অবস্থার কারণে দেখা যায়, ব্যক্তিগত লাভের আশায় ব্যাংকের কার্যক্রম ও নীতি তৈরির ক্ষেত্রে প্রভাব খাটানো হয়। বলা যায়, অনেক সময় পুরো কার্যপ্রণালিই দূষিত হয়ে ভুল পথে ব্যাংকগুলো চালিত হয়। ব্যাংকের পরিচালকেরা নিজেরা স্বাধীন নন, উপরন্তু তাঁদের মাধ্যমেই নানা অনৈতিক হস্তক্ষেপ আসে। এই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রাথমিক পরিকাঠামোই ভুলভ্রান্তি ভরা হয়ে থাকে এবং নীতিতেও নানা জটিলতা তৈরি হয়।

বাণিজ্যিক ব্যাংক পরিচালনার ইতিহাসের ক্ষেত্রে মালিকানা কিংবা দলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চেয়ে নির্বাহী দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা পরিচালকদের কাজ বেশি ফলপ্রসূ হয়েছে। ব্যাংকের সঙ্গে এসব পরিচালকের সরাসরি কোনো বিশেষ সম্পর্ক থাকে না এবং এ কারণে তাঁদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য থাকে কাজের মাধ্যমে ব্যাংকের উন্নতি।

জেপি মর্গ্যান চেজের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মধ্যে পেশাদারি ও খাত সম্পর্কে জ্ঞান, ব্যবসায়িক, আর্থিক দক্ষতা, উচ্চপর্যায়ের ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি এসবের উপস্থাপনার বৈচিত্র্যের ভারসাম্যের দিকে গুরুত্ব দেন। এই মূলনীতি মেনে নেতৃত্ব, ব্যবসায়িক ব্যবস্থাপনা, জেপি মর্গ্যান চেজ এবং এর ব্যবসা সম্পর্কে অভিজ্ঞ লোকদের মধ্য থেকে আবার যাঁরা বিচারবুদ্ধি, অর্জন, সততা ও চ্যালেঞ্জ গ্রহণে আগ্রহী; পরিচালনা পর্ষদে তাঁদের নিয়োগ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার নীতি অনুসারে বলা হয়, বোর্ডের দুই–তৃতীয়াংশ সদস্য অন্তত স্বাধীন হবেন। এই পদ্ধতিতে পরিচালকদের ব্যবসাসংক্রান্ত চিন্তা থেকে বের করে আনা হয়, যেন তাঁদের মুনাফা লাভের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক রেখে নতুন পরিকল্পনা, ধারণা তৈরি করেন এবং তা নিয়ম–শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে কাজে পরিণত করা সম্ভব হয়।

এই পদ্ধতি অনুসারে ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার জন্য ব্যাংকিং খাতে তাঁর বহুদিনের অভিজ্ঞতা না থাকলেও এই খাত কীভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। এ ছাড়া এই স্বাধীন পরিচালকেরা প্রয়োজনীয় বাস্তবসম্মত ধারণা ও প্রযুক্তিগত কাজগুলো অন্য কার্যনির্বাহী পরিচালকদের কাছ থেকে শিখে নিতে পারেন। কেননা একটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ম, গঠন ও কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাঁদের মানবিক গুণাবলিসম্পন্নও হতে হবে। কেননা এর মধ্য দিয়ে অন্য সদস্যদের যুক্তি বা দৃষ্টিভঙ্গি বুঝে কাজ করা সহজ হবে। এর পাশাপাশি বাইরের জগতের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ বা পরিচয় থাকলে এ ধরনের পরিচালকেরা বাজার, শিল্প ও মানুষের মিশ্রণে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে প্রতিষ্ঠানকে আরও সংহত করতে সক্ষম হন। যেহেতু পরিচালকেরা ব্যাংকের সঙ্গে সম্বন্ধের বন্ধনে যুক্ত নন, তাই তাঁরা সহজেই নানা প্রশ্ন তুলতে, এমনকি সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। যার ফলে একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না কিংবা ভুলভ্রান্তির প্রতি যে প্রশ্ন ওঠে, তা শোধরানো যায়। 

জেপি মর্গ্যান চেজের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মধ্যে পেশাদারি ও খাত সম্পর্কে জ্ঞান, ব্যবসায়িক, আর্থিক দক্ষতা, উচ্চপর্যায়ের ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি এসবের উপস্থাপনার বৈচিত্র্যের ভারসাম্যের দিকে গুরুত্ব দেন। এই মূলনীতি মেনে নেতৃত্ব, ব্যবসায়িক ব্যবস্থাপনা, জেপি মর্গ্যান চেজ এবং এর ব্যবসা সম্পর্কে অভিজ্ঞ লোকদের মধ্য থেকে আবার যাঁরা বিচারবুদ্ধি, অর্জন, সততা ও চ্যালেঞ্জ গ্রহণে আগ্রহী; পরিচালনা পর্ষদে তাঁদের নিয়োগ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার নীতি অনুসারে বলা হয়, বোর্ডের দুই–তৃতীয়াংশ সদস্য অন্তত স্বাধীন হবেন।

অন্তর্ভুক্তির কিছু মানদণ্ড অনুসারে যেসব প্রার্থী বিশেষভাবে নীতির প্রমাণ দেখিয়েছেন; ব্যবসায়িক, পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা কিংবা সমপর্যায়ের নীতিনির্ধারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন; বিশেষ কোনো কাজে দক্ষ কিংবা এর আগে কাজ করেছেন বলে সদস্যদের কেউ বলে থাকেন; আর্থিক বিষয়ে এমন দক্ষতা আছে, যা দ্বারা নানা বিষয় নিরীক্ষণ করতে পারবেন; সবার সঙ্গে মিলে বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করার সঙ্গে ব্যবস্থাপনার নানা বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে ইচ্ছুক; এমন ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। 

এইচএসবিসি হোল্ডিংসের নীতি অনুসারে এর পর্ষদে স্বাধীন কার্যনির্বাহী পরিচালকদের প্রাধান্য থাকতে হবে, যাঁদের কাজ হবে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা নিরীক্ষণ এবং চ্যালেঞ্জ করার পাশাপাশি কৌশলগত বিষয়ের উন্নতিকল্পে সাহায্য করা। প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকির পাশাপাশি গৃহীত নীতি এবং ব্যবস্থাপনা মূল্যায়ন করে তা জানানোও তাঁদের কাজ। আঞ্চলিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে কিছু ব্যাংক, যেমন সিঙ্গাপুরের ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব সিঙ্গাপুর (ডিবিএস) কিংবা ইউনাইটেড ওভারসিজ ব্যাংক (ইউওবি); ভারতের এইচডিএফসি বা আইসিআইসিআই ব্যাংক অনেকটা এমনই মতাদর্শে চলে।

এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ প্রাথমিক রূপে স্বাধীন পরিচালকদের হাতেই চলে। পরিচালকদের বেশির ভাগই প্রাসঙ্গিক বিষয়ে যথেষ্ট প্রশংসিত ও স্বাধীন পরিচালক হিসেবে তাঁরা আক্ষরিক অর্থেই ব্যাংকের কৌশল ও ব্যবস্থাপনাকে প্রভাবিত করেন। তাঁদের পারিশ্রমিকও তদ্রূপ তাঁদের উৎসাহী ও কর্মদক্ষতাকে সুবিচার করার মতো করেই পরিকল্পিত। এসবের ভিত্তিতে বলা যায়, বিশ্বের বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক মানের ব্যাংক, এমনকি অনেক আঞ্চলিক ব্যাংকও স্বাধীন নির্বাহী পরিচালক নিয়োগে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor