হ্যান্ডশেক করার মুহূর্ত তাঁর জন্য ছিল একটা কষ্টের সময়। জয়েসের ডান হাত ছিল অন্য রকম : হয়তো জুরিখে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাওয়া কোনো অল্পবয়সী ছেলে বলল, “যে হাতে ‘ইউলিসিস’ লেখা হয়েছে, সেই হাতে কি আমি চুমু খেতে পারি?” জয়েস তখন বললেন, “না, এই হাত দিয়ে ‘ইউলিসিস’ লেখা ছাড়াও আরো অনেক কাজ করা হয়েছে”
১৯২২ সালের ১৯ মে প্যারিসে দেখা হয় ফরাসি লেখক মার্সেল প্রুস্ত এবং আইরিশ কথাসাহিত্যিক জেমস জয়েসের। তাঁদের দেখা হওয়ার ঘটনা নানাজনে নানাভাবে তুলে ধরেছেন। পরস্পর সম্পর্কে তাঁদের দুজনের আপাত অনীহার বিষয়টি যেমন অবিশ্বাস্য, তেমনি চমকপ্রদও বটে।
একজন আরেকজনকে জানান, তিনি অন্যজনের কোনো বই পড়েননি। প্রুস্ত জানান, তিনি জয়েসের লেখা পড়েননি। জয়েস জানান, তিনিও প্রুস্তের কোনো বই পড়েননি। আসলে পড়ে থাকলেও হয়তো সামনাসামনি স্বীকার করতে চাননি।
কবি উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস দুজনের মধ্যে চলমান বৈপরীত্যের প্রসঙ্গে জয়েসের মাথাব্যথা চোখের সমস্যার কথা বলেন। অন্যদিকে প্রুস্তের পেটের পীড়া নাকি ছিল কষ্টদায়ক। দুজনের শারীরিক গঠনও ছিল আলাদা। প্রুস্তের হাত ছিল খুব নরমসরম, হালকা।
হ্যান্ডশেক করার মুহূর্ত তাঁর জন্য ছিল একটা কষ্টের সময়। জয়েসের ডান হাত ছিল অন্য রকম : হয়তো জুরিখে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাওয়া কোনো অল্পবয়সী ছেলে বলল, “যে হাতে ‘ইউলিসিস’ লেখা হয়েছে, সেই হাতে কি আমি চুমু খেতে পারি?” জয়েস তখন বললেন, “না, এই হাত দিয়ে ‘ইউলিসিস’ লেখা ছাড়াও আরো অনেক কাজ করা হয়েছে।” লেখক ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষক সিডনি শিফ ও ভায়োলেট শিফ অনেক দিন ধরে ভাবছিলেন, প্রুস্তের সম্মানে একবার রাতের খাবারের আয়োজন করবেন। ইচ্ছা অনুযায়ী আয়োজন করলেন। তবে বাড়িতে নয়, হোটেল ম্যাজেস্টিতে।
অবশ্য বিপদের কথা হলো, বিশের দশকের শুরুর দিকেই প্রুস্ত ছোট পরিসরের ব্যক্তিগত অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলা শুরু করেছেন। বাইরেই খুব একটা যেতেন না। সবচেয়ে বেশি সময় কাটানোর একমাত্র জায়গা হলো তাঁর শোয়ার ঘর। যা হোক, আয়োজকদের ইচ্ছা ছিল আরো তিনজনসহ প্রুস্তকে নিয়ে একই রুমে খাবারের আয়োজন করা : ইগর স্ট্রাভিনস্কি, পাবলো পিকাসো, জেমস জয়েস ও প্রুস্ত। তাঁদের কাছে চারজনের মধ্যে প্রুস্ত হলেন সবচেয়ে বড় শিকার। কারণ তিনিই লোকজনের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মেলামেশা করে ফেলেছেলেন এবং লোকসমাগমে তাঁকে পাওয়াই কঠিন। আবার তাঁর ‘সোডম এট গোমরহে’ প্রকাশ করার পর থেকে লোকজনের মুখে তাঁর নাম উচ্চারিত হতো বেশি। আড্ডায় যোগ দিতে প্রুস্তের অনীহার কথা মাথায় রেখেই আয়োজকরা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো নিমন্ত্রণ দেননি। তাঁকে বরং অন্য একটা চিঠিতে অনেকটা পরোক্ষে জানান, রাতের খাবারের পরে তাঁদের ওখানে কিছুক্ষণের জন্য আসতে পারেন কি না। পিকাসো ও স্ট্রাভিনস্কি সময়মতোই এলেন। জয়েসের আসার বিষয়ে তাঁদের ভরসা কম ছিল। তবে তিনিও এলেন। ততক্ষণে আগের দুজনের এক দফা কফি পান করা হয়ে গেছে। জয়েস এলেন খানিকটা মাতাল অবস্থায় : চেহারা খানিকটা মলিন। এপাশে-ওপাশে দুলছেন। তিনি নিজের মুখেই স্বীকার করলেন, ‘একজন ভবঘুরের মতো না হলে আমি সামাজিক অবস্থানে মানানসই হতে পারি না।’ সেই আসরে শিল্প সমালোচক ক্লাইভ বেলও উপস্থিত ছিলেন। জয়েসের আগমন সম্পর্কে তিনি জানান, জয়েস এলেন রাত আড়াইটায়। চেহারা ও হাবভাব দেখে মনে হলো, কালো পোশাকের মানুষটা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল করেছেন, বন্ধুর বাড়ির জানালায় আলো জ্বলছে। কৌতূহলবশত দেখতে এসেছেন, বন্ধু সত্যিই জেগে আছেন কি না। জয়েসের চেহারা দেখে সেই রাতে ক্লাইভের তেমন মনোযোগ দেওয়ার মতো মনে হয়নি। তবে তাঁর চোখের শক্তি ঠিক চিনে ফেলেন ক্লাইভ। আরো পরে এলেন প্রুস্ত। তাঁকে বসতে দেওয়া হলো স্ট্রাভিনস্কি ও সিডনির মাঝখানে। তাঁর চেহারা সম্পর্কে স্ট্রাভিনস্কির বর্ণনায় পাওয়া যায়, ‘তিনি দেখতে বিকেলবেলার চাঁদের মতো ফ্যাকাসে।’ তবে প্রুস্তের পরিহাসমূলক মন্তব্যের মধ্যে স্ট্রাভিনস্কির প্রতি তাঁর তির্যক মনোভাব প্রকাশ পায় : বেচারাকে প্রুস্ত বিটোফেনের সঙ্গে তুলনা করেন। তবে তিনি যে বিটোফেনের কোনো কিছুই পছন্দ করেন না, সেটাও উল্লেখ করেন।
এরই মধ্যে দুহাতের তালুর ওপর মুখ রেখে খানিকটা ঘুমিয়ে নিয়েছেন জয়েস। হঠাৎ নাক ডাকার মতো শব্দ করে জেগে ওঠেন। তারপর প্রুস্তের সঙ্গে পরিচিত হন। তখনকার দিনে পাঠকমহলে প্রচলিত ধারণা ছিল, তাঁরা দুজন একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁদের অনুসারীদের মধ্যে হয়তো দলাদলিও ছিল। তাঁদের সাক্ষাৎ সম্পর্কে নানাজনের মতামতের ভিত্তিতে নানা রকম চিত্র তৈরি হয়েছে। সেগুলোর কয়েকটা উল্লেখ করলে বলা যায়, প্রুস্ত বলেন, ‘মি. জয়েস, আমি আপনার কোনো লেখা পড়িনি।’ তখন জয়েস বলেন, ‘আমিও আপনার লেখা পড়িনি।’ অনেক বছর পরে জয়েস চলচ্চিত্র সমালোচক জ্যাক মারক্যান্টনকে বলেন, প্রুস্ত শুধু সম্রাজ্ঞীদের কথা বলতেন; তবে আমার ব্যাপারস্যাপার ছিল সম্রাজ্ঞীদের সহচরীদের নিয়ে। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইংরেজ চিত্রশিল্পী ও লেখক ফ্রাংক বাজেনকে জানান, তাঁর এবং প্রুস্তের কথার মধ্যে না-বাচক উত্তরের প্রাধান্য ছিল। তাঁদের নিমন্ত্রণকারী প্রুস্তকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি ‘ইউলিসিস’ উপন্যাসের অমুক-তমুক অংশ পড়েছেন কি না। উত্তরে প্রুস্ত বললেন, না। দুজন মানুষ পুরোই আলাদা—এ সত্য মেনেই জয়েস বলেন, ‘এ রকম মানুষ একসঙ্গে থাকা অসম্ভব। তাঁর যখন দিনের শুরু, আমার তখন শেষ।’ অন্যদিকে জয়েসকে প্রুস্ত যখন জিজ্ঞেস করেন, অমুক প্রিন্সেস কিংবা অমুক কাউন্টেস কিংবা তমুক ম্যাডামকে চেনেন কি না, জয়েস না-বোধক উত্তর দেন। শিফদের বাড়ির সেই আড্ডা শেষ হয় প্রুস্ত যখন আয়োজকদেরকে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। এখানে জয়েসের প্রতি প্রুস্তের প্রচ্ছন্ন অবজ্ঞা আরো প্রকট হয়ে ওঠে, যখন জয়েস জোর করে তাঁদের গাড়িতে ওঠেন। গাড়িতে উঠেই তিনি ধূমপান শুরু করেন এবং জানালা খুলে দেন। তখন হাঁপানির রোগী প্রুস্ত বিপদেই পড়ে যান। সংক্ষিপ্ত যাত্রার সময়টুকু প্রুস্ত অবিরাম কথা বলতে থাকেন। তবে জয়েসকে সরাসরি সম্বোধন করেন না। প্রুস্তের বাড়ির সামনে তাঁদের গাড়ি এসে দাঁড়ানোর পর তাঁরা সবাই নেমে পড়েন। তবে জয়েসকে গাড়ি থেকে নামতে নিরুৎসাহ করেন। অনেকটা জোর করেই তাঁকে গাড়িতে বসে থাকতে বাধ্য করা হয়। তখন প্রুস্ত জয়েসকে বলেন, ‘আমার গাড়ি আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে।’ কথাগুলো বলেই ভায়োলেটকে নিয়ে প্রুস্ত দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করেন। জয়েসকে শান্ত করে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে তারপর ভেতরে ঢোকেন সিডনি শিফ। এভাবে জয়সের হাত থেকে রক্ষা পান প্রুস্ত। প্রুস্তের বাড়িতে বসে প্রুস্ত, সিডনি ও ভায়োলেট আরামে শ্যাম্পেন পান করে গল্প করতে করতে রাত কাটিয়ে দেন। ভোরবেলা তাঁদের আড্ডা শেষ হয়।
Publisher & Editor