সোমবার, ০৬ জানুয়ারি ২০২৫

সিরিয়ার কুর্দি যোদ্ধাদের সঙ্গে ইসরায়েল কেন আঁতাত করছে

প্রকাশিত: ২৩:৩৮, ০৩ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৫

১০ ডিসেম্বর সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পর ইসরায়েল তার প্রতিবেশী দেশটির বিরুদ্ধে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক বিমান হামলা শুরু করে। ‘বাশান অ্যারো’ নামে অভিহিত এই অভিযানে ইসরায়েলের ৩৫০টি যুদ্ধবিমান দামেস্ক থেকে তারতাস পর্যন্ত ৩২০টি কৌশলগত লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করেছে।

বিমানঘাঁটি, মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান, স্কাড মিসাইল ব্যাটারিজ, ড্রোন ব্যবস্থা, নৌজাহাজের রাডার সিস্টেম ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোয় বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। ইসরায়েলের এই হামলায় সিরিয়ার কৌশলগত সামরিক সম্পদের ৭০ শতাংশই ধ্বংস হয়েছে। ফলে সিরিয়ায় ভাগ হয়ে যাওয়া ও দেশটিতে বৈশ্বিক খেলোয়াড়দের প্রভাব বাড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এই আক্রমণাত্মক অভিযান বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। ইসরায়েল ও আসাদ সরকারের কৌশলগত বোঝাপড়ার পটভূমি থেকে এটাকে বিচার করা প্রয়োজন। আসাদের আমলে ইসরায়েল দখলকৃত গোলান মালভূমিতে তার স্বার্থ রক্ষা করে গেছে। সম্পর্ক থাকলেও ইসরায়েল আসাদকে একজন সমস্যাজনক প্রতিবেশী হিসাবে দেখত।

গোলান মালভূমিতে অর্ধশতাব্দীকাল ধরে শান্তি বিরাজ করছিল। আসাদের পতনের পর ইসরায়েল চায় যে তার উত্তরসূরি শাসক, বিদ্রোহী জোট অথবা বিদেশি কেউ যেন ইসরায়েলকে চ্যালেঞ্জ করতে না পারে।

আসাদের পতনের পর সিরিয়ার লোকেরা এখন নিজেদের দেশ পুনর্গঠনের জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলের আক্রমণ তাদের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ একটা বাঁকবদল হতে পারে।

সিরিয়ায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের মাত্রা ও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু দেখে কয়েকটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে। এই হামলার পেছনে ইসরায়েলের উদ্দেশ্য কী? সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার ওপর এর কী প্রভাব পড়বে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করের, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট ইরাক ও লিবিয়ায় আক্রমণের পর দেশ দুটিতে যে রকম বিভাজন সৃষ্টি হয়েছিল, সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। সিরিয়ার গোলান মালভূমির অংশ ইসরায়েল দখলে নেওয়ায় এই অনিশ্চয়তা বেড়েছে।

কৌশলগত ও প্রতীকীভাবে গুরুত্বপূর্ণ গোলান মালভূমির অংশ ইসরায়েল নিজেদের দখলে নেওয়ার পর জাতিসংঘ সেটাকে অবৈধ পদক্ষেপ বলেছিল। আসাদের পতনের পর ইসরায়েল গোলানের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের তদারকিতে থাকা নিরপেক্ষ অঞ্চলের দখল তারা নিয়েছে।

গোলান মালভূমিতে সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব নিয়ে জাতিসংঘের সম্মতি থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েলে দখলদারির বিরুদ্ধে পশ্চিমারা নিন্দা জানায়নি।

অন্যদিকে তুরস্ক ওই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ একজন ক্রীড়নক। ওয়াইপিজিকে তারা অস্তিত্বের হুমকি মনে করে। ইসরায়েলের সঙ্গে ওয়াইপিজির যেকোনো ধরনের আঁতাত ইসরায়েল-তুরস্ক সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি করবে। সেটা বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাত ডেকে আনতে পারে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, ‘গোলান অনন্তকালের জন্য ইসরায়েল রাষ্ট্রের অংশ হবে।’ এই অবস্থান ইসরায়েলের কৌশলগত অবস্থানকে খাটো করে। সিরিয়ার অস্থিতিশীলতার সুবিধা নিয়ে ইসরায়েল তার আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অগ্রাধিকার দিতে গেলে সিরিয়ার গোষ্ঠীগুলোর আগাম পরাজয় ঘটতে পারে। সেখানে নতুন বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। ফলে দেশ গঠন প্রচেষ্টা থেকে থেকে সিরিয়ানদের মনোযোগ সরে যেতে পারে। এ পরিস্থিতিতে ইসরায়েলই লাভবান হয়। ইসরায়েল চায় একটা সিরিয়া যেন বিভক্ত থাকে। কেননা, সিরিয়া বিভক্ত হলে দেশটি আর ইসরায়েলের নিরাপত্তার ওপর কোনো হুমকি ফেলতে পারবে না। ইসরায়েলের পরভূমি দখলে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষার ওপরেও বাধা আসবে না।

সিরিয়ানদের জন্য এই বিভাজন নিষ্ঠুর এক ধাঁধা। দেশ পুনর্গঠনের জন্য তাদের স্থিতিশীলতার দিকেই সব মনোযোগ দেওয়া দরকার। কিন্তু সিরিয়া বিদেশি শক্তির দখলে থাকলে জনগণের একটা বড় অংশই বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করাটাকেই তাদের মূল দায়িত্ব হিসাবে নেবে।

ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সংহতি বজায় রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি গোষ্ঠী দ্য পিপলস প্রটেকশন ইউনিটসের (ওয়াইপিজে) নিয়ন্ত্রিত এলাকা পুররুদ্ধার করার প্রচেষ্টা খাটো হবে।

এ ছাড়া ইসরায়েল শুধু সামরিক স্থাপনায় আক্রমণ করছে না। গোয়েন্দা আর্কাইভও তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। ইসরায়েলসহ বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে আসাদ সরকারের সম্পর্কের দলিলগুলো এতে ধ্বংস হয়ে গেছে।

রাশিয়ার মধ্যস্থতায় আসাদ সরকার ও ইসরায়েলের মধ্য গোপন চুক্তি হয়েছিল। আসাদের পতনের পর সেই নথি ফাঁস হয়েছে।

ইসরায়েলের কর্মকর্তারা খোলাখুলিভাবে কুর্দিদের ওয়াইচিজি-এর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার কথা বলেছেন। ওয়াইচিজি কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি গোষ্ঠী। পিকেকেকে তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করে।

ইসরায়েলের এই অবস্থান আঞ্চলিক বিরোধের সঙ্গে সিরিয়াকে গভীরভাবে যুক্ত করে দেবে। বিশেষ করে তুরস্কের সঙ্গে ইসরায়েলের বিরোধে সিরিয়াকেও জড়িয়ে পড়তে হবে। এ ছাড়া সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিভক্তি আরও গভীর হবে।

ওয়াইপিজি এর আগে আসাদ সরকার, ইরান, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন খেলোয়াড়দের সঙ্গে আঁতাতের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। তারা এখন সিরিয়ায় ইসরায়েলের কৌশল পূরণের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে।

কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি ইসরায়েলের সমর্থনের উদ্দেশ্য হচ্ছে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুর্বল করা।  

অন্যদিকে তুরস্ক ওই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ একজন খেলোয়াড়। ওয়াইপিজিকে তারা অস্তিত্বের হুমকি মনে করে। ইসরায়েলের সঙ্গে ওয়াইপিজির যেকোনো ধরনের আঁতাত ইসরায়েল-তুরস্ক সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি করবে। সেটা বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাত ডেকে আনতে পারে।

এই ধরনের উত্তেজনা সিরিয়াকে আরও অস্থিতিশীল করতে পারে। আঞ্চলিক শক্তিগুলো সেই বিশৃঙ্খলাকে সুযোগ হিসাবে নিয়ে তাদের এজেন্ডা নিয়ে সেখানে হাজির হতে পারে।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor