আমার নাম মিলু। আমি একটি গল্প বলব। বিড়ালের গল্প। হুলো বিড়াল।
আমি তার নাম দিয়েছিলাম ‘হুলো সাহেব’।
গ্রীষ্মকাল। দুপুরের দিকে স্কুল থেকে ফিরছি। তালুকদারবাড়ির ভাঙা দালানের দিকটায় একটি বিড়ালছানা কাঁদছিল।
এগিয়ে গিয়েছি। দেখি ফুটফুটে সাদা একটি বিড়ালছানা। চোখ দুটি নীল। ছোট মার্বেলের মতো।
লেজের ডগায় একটুখানি কালো ছোপ। আমাকে দেখে ছানাটির কান্না বেড়ে গেল। আমার দিকে তাকায় আর মিউমিউ করে কাঁদে। খুব মায়া লাগল। দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছি।
লাফ দিয়ে আমার কোলে উঠল। পিঠে বইয়ের ব্যাগ। কোলে বিড়ালছানা। বাড়ি ফিরে এলাম।
আমরা দুই ভাই-বোন। আমি বড়। ৯ বছর বয়স। ক্লাস থ্রিতে পড়ি। ছোট বোনটির নাম নীলু। তার বয়স পাঁচ। সামনের বছরে স্কুলে ভর্তি হবে। বাড়িতে মায়ের সঙ্গে আমরা দুই ভাই-বোন। কাজের লোক জয়নাল আছে। ঝি আছে ফরিদা। বাবা ঢাকায় চাকরি করেন। আমরা থাকি গ্রামের বাড়িতে। প্রতি মাসেই বাড়িতে আসেন বাবা। আমাদের জন্য মজার মজার খাবার আর খেলনা নিয়ে আসেন। তাই সারা মাস আমরা বাবার জন্য অপেক্ষা করি।
বিড়ালছানাটি দেখে নীলু খুব খুশি। মা অবাক। ‘বিড়ালছানা কোথায় পেলি?’
‘তালুকদারবাড়িতে।’
‘এইটুকু ছানা নিয়ে এলি? ওর মাকে দেখিসনি?’
‘না। ছানাটি খুব কাঁদছিল। বোধ হয় হারিয়ে গেছে।’
নীলু বলল, ‘মা বিড়ালটি বোধ হয় ওকে ফেলে পালিয়ে গেছে। নিয়ে এসে ভালো করেছিস ভাইয়া। আমরা দুজন খুব আদর করব ছানাটিকে। দুধ খাওয়াব, মাছ-মাংস খাওয়াব। ছানাটি তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাবে।’
হুলো সাহেব সত্যি সত্যি খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল। ছোট থাকতে খুব নিরীহ ছিল। দুষ্টুমি করত না। আমার আর নীলুর পেছন পেছন ঘুরত। কোলে উঠে বসে থাকত। বড় হয়ে তেমন আর থাকল না। চঞ্চল হয়ে গেল। দুষ্টু হয়ে গেল। এদিক-ওদিক ছুটে যায়। হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায়। এক-দুই ঘণ্টা তাকে আর খুঁজেই পাওয়া যায় না। আমি আর নীলু চিন্তায় অস্থির হয়ে যাই। এদিক-ওদিক খুঁজতে থাকি। তারপর হঠাৎ করেই উদয় হয়। কোথায় গিয়েছিল, কোথা থেকে এলো, কিছুই আমরা বুঝতে পারি না।
একদিন দেখি, আমাদের রান্নাঘরের চালে উঠে বসে আছে। আরেক দিন দেখি, সে উঠে গেছে বকুলগাছটির মগডালে। আরেক দিন দেখি, উঠানের কোণে ওত পেতে আছে। উঠানে কয়েকটি শালিক আর চড়ুই খাবার খুঁজছিল। হুলো সাহেব পা টিপে টিপে তাদের দিকে এগোচ্ছে। তারপর হঠাৎ করে লাফ দিয়ে পড়ল একটি চড়ুই পাখির ওপর। চড়ুইটিও কম চালাক না। হুলোর মতলব বুঝতে পেরেছিল। সে ফুড়ুত করে উড়াল দিল। হুলো তাকে ধরতে পারল না।
আমি পাখি খুব পছন্দ করি। আমাদের উঠান বাগানে অনেক রকমের পাখি আসে। শালিক আর চড়ুই তো আছেই। কাক তো আছেই। এ ছাড়া ইষ্টিকুটুম পাখি আসে, দোয়েল আসে, ছাতারে আসে, টুনটুনি আসে। পাখি ধরার জন্য হুলোকে দেখি গাছেও চড়ে যাচ্ছে। তার ভয়ে উঠানে শালিক-চড়ুইয়ের নামা কমে গেল। বাগানের গাছপালায় অন্য পাখিরা আসা বন্ধ করল। এই দেখে আমার আর নীলুর খুবই মন খারাপ। মা একদিন বললেন, ‘তোদের হুলোটা পাজি বিড়াল। পাখির ডাকে বাড়িটা কী সুন্দর মুখর হয়ে থাকত। ওই পাজিটার ভয়ে পাখি এখন আর আসেই না।’
তারপর হুলো শুরু করল আরেক কাণ্ড। রান্নাঘরে ঢুকে দুধ চুরি করে খেতে লাগল। মাছ-মাংস খেতে লাগল। দুই দিন দুধের পাতিল উল্টে ফেলল। একদিন মাংসের কড়াই কাত করে ফেলল। আমরা সময়মতো তাকে খাবার দিই। তার পরও এই কাণ্ড।
প্রথম প্রথম মা তেমন কিছু বলতেন না। একসময় বিরক্ত হয়ে গেলেন। বাবা বাড়ি এসেছেন। আমরা সবাই আনন্দে আছি। বাবা পায়েস খেতে পছন্দ করেন। মা পায়েস রান্না করেছেন। টেবিলের ওপর কাচের গামলায় পায়েস ঢেলে রেখেছেন। ঢাকনাও দিয়ে রেখেছেন। হুলো সেই ঢাকনা ফেলে পায়েসে মুখ দিল। বাবা এই দৃশ্যটি দেখে ফেললেন। সেই পায়েস আর খাওয়া হলো না। মা-বাবা দুজনই গম্ভীর। ‘না, এ রকম অসভ্য বিড়াল বাড়িতে রাখা যাবে না। হুলোকে তাড়াতে হবে।’
আমি আর নীলু দুজনই মা-বাবাকে অনুরোধ করলাম। ‘হুলোকে আমরা চোখে চোখে রাখব। আদর করে বোঝাব, যাতে সে এ রকম আর না করে।’ কয়েক দিন সেই চেষ্টাও করলাম। কাজ হলো না। বাবা যেদিন ফিরে যাবেন, সেদিন সবচেয়ে খারাপ কাজটি হুলো করল। রাতেরবেলা আমরা চারজন খেতে বসেছি। পোলাও আর মুরগির মাংস রান্না করা হয়েছে। গল্প আর খাওয়াদাওয়া চলছে। হুলো এসে লাফ দিয়ে উঠল টেবিলে। বাবার প্লেট থেকে মুরগির রানটি নিয়ে উধাও হয়ে গেল। আমরা হতভম্ব।
পরদিন স্কুল থেকে ফিরে হুলোকে আর খুঁজে পাই না। কোথায় গেছে? কী ঘটনা? কেউ কিছুই বলে না। নীলুর চোখ দুটি ফোলা ফোলা। হয়তো কেঁদেছে। দুপুর গড়িয়ে গেল। হুলোর দেখা নেই। মাকে জিজ্ঞেস করি। তিনি কিছু বলেন না। জয়নাল আর ফরিদাকে জিজ্ঞেস করি। তারা নাকি দেখেনি। নীলুকে জিজ্ঞেক করি। নীলু কোনো কথাই বলে না। আমার মন খারাপ হয়ে গেল। বিকেলবেলা মাঠে খেলতে যাই। সেদিন আর গেলাম না। যত দুষ্টুই হোক, হুলোকে আমি খুব ভালবাসি। সে এভাবে উধাও হয়ে গেল?
একা একা বাগানে হাঁটি আর চোখ মুছি। হুলোর জন্য খুবই কান্না পাচ্ছে। চোখের পানি আটকে রাখতে পারছি না। দূর থেকে আমার কান্না দেখতে পেল নীলু। ধীর পায়ে সে এলো আমার কাছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সাবধানী গলায় বলল, ‘হুলো আর ফিরবে না, ভাইয়া।’
‘কেন? কোথায় গেছে?’
‘জয়নাল ভাই তাকে বনের ধারে ফেলে দিয়ে এসেছে।’
‘কিভাবে? কখন?’
‘তুই স্কুলে যাওয়ার পরই। হুলো উঠানের রোদে শুয়ে ছিল। খপ করে তাকে ধরেছে জয়নাল ভাই। চটের বস্তায় ভরে পিঠে ঝুলিয়ে নিয়ে গেছে। আমি দেখেছি। মা বলেছেন তোকে যেন এ কথা না বলি। জয়নাল ভাই আর ফরিদা আপা তো বলবেই না।’
কথা বলতে বলতে নীলুও কেঁদে ফেলল। ‘হুলোর জন্য আমিও তোর মতো কষ্ট পাচ্ছি, ভাইয়া। আমাদের ভালো হুলো কেন যে এত দুষ্টু হয়ে গেল! অমন না করলে কি মা ওকে ফেলে দিতেন?’
আমরা দুটি ভাই-বোন বাগানের ঘাসে বসে হুলোর জন্য কাঁদতে লাগলাম।
শেষ বিকেলে বাগানের পেছন দিককার ঝোপঝাড়ের কাছে শুনি মিউমিউ ডাক। আমরা দুজন লাফিয়ে উঠলাম। ‘আরে, এ তো হুলোর ডাক! হুলো কী তাহলে ফিরে এসেছে?’
আমি আর নীলু ঝোপের দিকে এগিয়ে গেলাম। সত্যি হুলো। আমার আর নীলুর দিকে মায়াভরা চোখে তাকাতে লাগল। সেই প্রথম দিনের মতো আমি তার দিকে দুহাত বাড়ালাম। সে লাফ দিয়ে আমার কোলে এলো। নীলু তখন আনন্দে চিৎকার করছে। ‘হুলো ফিরে এসেছে। হুলো ফিরে এসেছে।’
নীলুর চিৎকারে বাগানে ছুটে এলেন মা। জয়নাল আর ফরিদাও এসেছে। হুলোকে দেখে জয়নাল অবাক, ‘তিন কিলোমিটার দূরের বনে ফেলে দিয়ে এলাম। আর সেই বিড়াল কিনা বাড়ি চিনে ফিরে এলো! এ তো অদ্ভুত বিড়াল?’
হুলো সত্যি সত্যি অদ্ভুত বিড়াল। ফিরে আসার পর সে একদম বদলে গেল। দুষ্টুমি বলতে কিচ্ছু নেই। সেই শিশু বয়সের মতো নরম, নিরীহ আর আদুরে বিড়াল হয়ে গেল। আমরা তার খাওয়ার সময় বেঁধে দিয়েছিলাম। সেই সময়মতোই সে খায়। সকালবেলায় খায় দুধ। দুপুরে মাছ। রাতে মাংস। অন্য সময় সাহেবের ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়ায়। বাঘের ভঙ্গিতে আধশোয়া হয়ে থাকে। উঠান বাগানে আগের মতোই পাখিরা আসতে শুরু করেছে। হুলো কারো দিকে ফিরেও তাকায় না।
বাড়ি এসে সব শুনে বাবা খুব খুশি। গ্রামের বাজারে বিড়ালের খাবার পাওয়া যায় না। পরের মাস থেকে বাড়ি আসার সময় আমাদের খাবারের সঙ্গে হুলোর জন্যও প্যাকেট করা বিড়ালের খাবার নিয়ে আসেন বাবা। হুলো এখন সত্যি সত্যি সাহেব হয়ে গেছে। সাহেবদের মতো খাওয়াদাওয়া করে সে এখন সত্যিকারের হুলো সাহেব।
Publisher & Editor