শাশুড়িকে পেয়ে আবেগাপ্লুত পুত্রবধূ জুবাইদা রহমানও * তারেক রহমান মাকে নিয়ে নিজেই গাড়ি চালিয়ে যান লন্ডন ক্লিনিকে * খালেদা জিয়ার প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু
এ এক অবিস্মরণীয় দিন। বাংলাদেশ থেকে ৮ হাজার কিলোমিটার দূরে লন্ডনে সূর্যের ঝলমলে আলোয় উদ্ভাসিত সকাল। ঘড়ির কাঁটায় তখন যুক্তরাজ্যের স্থানীয় সময় বুধবার সকাল ৯টা ৫ মিনিট। এ সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে বহনকারী উড়োজাহাজটি লন্ডনের হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সেখানে আগে থেকেই মা খালেদা জিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন বড় ছেলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সঙ্গে ছিলেন সহধর্মিণী ডা. জুবাইদা রহমান। সাত বছর পর মায়ের সঙ্গে দেখা হবে, সেই মুহূর্তের অপেক্ষায় থাকা তারেক রহমান ছিলেন অনেক হাস্যোজ্জ্বল। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে মাকে কাছে পান তিনি। তারেক রহমান ও পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান বিমানবন্দরে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানান। বিমানবন্দরে মাকে দেখেই কাছে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন তারেক রহমান। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হয়। মা-ছেলের এ মধুর মুহূর্ত এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি করে। দীর্ঘদিন পর শাশুড়িকে পেয়ে আবেগাপ্লুত হন পুত্রবধূ জুবাইদা রহমানও। তিনিও শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরেন। ইমিগ্রেশন কার্যক্রম শেষ করে বিমানবন্দরের চতুর্থ টার্মিনালের রয়্যাল ভিভিআইপি গেট দিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে বের হন খালেদা জিয়াসহ সফরসঙ্গীরা। এ সময় তারেক রহমান নিজেই গাড়ি চালিয়ে মাকে লন্ডন ক্লিনিকের উদ্দেশে রওয়ানা দেন। স্থানীয় সময় বেলা ১১টার দিকে হাসপাতালে পৌঁছান তারা। একই গাড়িতে তারেক রহমানের সহধর্মিণী জুবাইদা রহমানও ছিলেন। হাসপাতালে তিন নাতনি দাদি খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের খোঁজ নিয়েছেন।
এর আগে চোখ ও পায়ের ফালোআপ চিকিৎসার জন্য ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই যুক্তরাজ্যে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। এরপর তার আর কোনো বিদেশ সফর হয়নি। এ সময়ের মধ্যে তার সঙ্গে ছেলে তারেক রহমানেরও সরাসরি দেখা হয়নি। শুধু ভার্চুয়ালি মা ও ছেলের মধ্যে কথা হতো।
এদিকে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার হজরত আলী খান বিমানবন্দরে খালেদা জিয়াকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। খালেদা জিয়াকে ভিআইপি প্রটোকল দেন হিথ্রো বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এমএ মালিক, সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমদও বিমানবন্দরে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে। এ সময় যুক্তরাজ্য বিএনপি ও এর অঙ্গসহযোগী সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
রাতে যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এমএ মালিক যুগান্তরকে বলেন, যুক্তরাজ্যে পৌঁছে লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বাংলাদেশ থেকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে আসা চিকিৎসকরা লন্ডন ক্লিনিকের চিকিৎসকদের কাছে তাকে কাগজপত্রসহ বুঝিয়ে দিয়েছেন। তারা প্রয়োজনীয় সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও কাগজপত্র দেখে খালেদা জিয়ার প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করেছেন। প্রাথমিক চিকিৎসার পর চিকিৎসকদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। হাসপাতালে বাংলাদেশ থেকে আসা চিকিৎসক ছাড়াও পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত আছেন।
এর আগে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে রওয়ানা দেন খালেদা জিয়া। এ সময় লাখো মানুষ তাকে গুলশান, বনানী ও বিমানবন্দর সড়কের দুপাশে দাঁড়িয়ে বিদায় জানান। তার সঙ্গে সফরসঙ্গী ছিলেন চিকিৎসক, নার্স, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ১৫ জন। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির পাঠানো বিশেষ সুবিধা সংবলিত কাতার এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি পথিমধ্যে দোহায় যাত্রাবিরতি দেয়। বিরতির সময় খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন কাতারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নজরুল ইসলাম। তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের শারীরিক খোঁজখবর নেন।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, লন্ডন ক্লিনিকের চিকিৎসকরা সুপারিশ করলে খালেদা জিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে চিকিৎসা শেষে খালেদা জিয়া কবে দেশে ফিরতে পারবেন-এ বিষয়ে চিকিৎসকরা কোনো তথ্য জানাতে পারেননি। তবে চিকিৎসা শেষে ওমরাহ পালন শেষে দেশে ফেরার কথা রয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার। ৭৯ বছর বয়সি খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, কিডনি সমস্যাসহ নানা স্বাস্থ্য জটিলতায় দীর্ঘদিন ভুগছেন।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার লিভার প্রতিস্থাপন খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, লিভার প্রতিস্থাপনের পর পুরো চিকিৎসায় দেড় থেকে দুই মাসের মতো লেগে যেতে পারে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসা শেষ হলে বিএনপির চেয়ারপারসন আবার লন্ডনে যাবেন। সেখান থেকে সৌদি আরবে পবিত্র ওমরাহ পালন করে তারপর দেশে ফিরতে পারেন।
বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসক, ব্যক্তিগত স্টাফসহ খালেদা জিয়ার সঙ্গে গেছেন ১৫ জন। তারা হলেন ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলী রহমান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ড. মোহাম্মদ এনামুল হক চৌধুরী, দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল, ব্যক্তিগত চিকিৎসক ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ সিদ্দিকী, মো. সাহাবুদ্দিন তালুকদার, নুর উদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ আল মামুন, শরীফা করিম স্বর্ণা, খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তার, সহকারী একান্ত সচিব মো. মাসুদুর রহমান, প্রটোকল অফিসার এসএম পারভেজ এবং গৃহকর্মী ফাতিমা বেগম ও রূপা শিকদার।
মা-ছেলের ছবি মুহূর্তেই ভাইরাল, দোয়া ও শুভেচ্ছার বন্যা : এদিকে দীর্ঘ সাত বছর পর লন্ডনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও বড় ছেলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাক্ষৎ হয়। এ সময় হিথ্রো বিমানবন্দরে এক আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ পুনর্মিলনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি হয়। দোয়া ও শুভেচ্ছার সঙ্গে বয়ে যায় আনন্দের জোয়ার। প্রতিটি পোস্টে নিজ নিজ প্রতিক্রিয়ায় কমেন্ট বক্সে ঝড় তুলেন সবাই। মা ও ছেলে এবং শাশুড়ি ও পুত্রবধূর ছবি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। নিগার সুলতানা নামের এক নেটিজেন লেখেন, ‘এই বন্ধন অটুট থাকুক চিরকাল’। নীরব অনুভূতি নামের এক নেটিজেন লেখেন, ‘মহান নেত্রী। দীর্ঘ ১৬ বছর সীমাহীন নির্যাতন সহ্য করার পরও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি’। আবুল হাসান নামের একজন লেখেন, ‘পৃথিবীর সব সৌন্দর্য যেন মিশে আছে এই এক ফ্রেমে। সাত বছরের বিরতির পর মা আর সন্তানের মিলন-এ দৃশ্যের চেয়ে হৃদয়ছোঁয়া আর কী হতে পারে! ২৪ শুধু একটি দিন নয়, এটি একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। মানবিকতার এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছে এটি। এ যেন ভালোবাসার নতুন ভাষা শেখার দিন। আমাদের অনুভূতিকে আরও গভীরভাবে স্পর্শ করেছে এই মুহূর্ত’। পাশাপাশি কমেন্টে মা-ছেলেকে দোয়া ও ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়েছেন অসংখ্য নেটিজেন।
প্রসঙ্গত, বিএনপির চেয়ারপারসন ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হন। দুই বছরের বেশি সময় কারাবন্দি ছিলেন তিনি। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর সাজা ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকার নির্বাহী আদেশে স্থগিত করে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছিল। তখন থেকে ছয় মাস পরপর তার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ বাড়াচ্ছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। গুলশানে বাসায় থাকলেও বেশির ভাগ সময়ই তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকবার তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণেও পড়েন। উন্নত চিকিৎসায় তাকে বিদেশে নেওয়ার জন্য অন্তত সাতবার পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হলেও তাতে সাড়া দেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। এর মধ্যে এভারকেয়ার হাসপাতালে তার হৃদ্যন্ত্রে পেসমেকার বসানো হয়। এছাড়া সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর হার্টে তিনটি ব্লক ছিল। একটিতে রিং পরানো হয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এনে খালেদা জিয়ার রক্তনালিতে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। এবার সরাসরি বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ পেলেন তিনি।
Publisher & Editor