বুধবার, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

আল মাহমুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব

প্রকাশিত: ২৩:৩০, ১১ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৩

আমার পরম সৌভাগ্য, বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম কবি আল মাহমুদ আমাকে তাঁর বন্ধু মনে করতেন। একসময় তিনি ছিলেন আমার স্বপ্নের নায়ক। ১৯৭৩ সালে যখন লেখালেখির জগতে প্রবেশ করি, তখন আমার সামনে চার-পাঁচজন কথাসাহিত্যিক, চার-পাঁচজন কবি তাঁদের বিশালত্ব নিয়ে অবস্থান করছিলেন। কথাসাহিত্যে রশীদ করীম, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, মাহমুদুল হক ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।

কবিতায় শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান ও মহাদেব সাহা। এই কবি ও কথাসাহিত্যিকরা প্রত্যেকেই আমার তখন স্বপ্নের মানুষ। কী সৌভাগ্য, স্বপ্নের মানুষগুলোর প্রত্যেকের কাছেই আমি একসময় পৌঁছে যেতে পেরেছিলাম। প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হয়েছে।

অনেকের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছি। তাঁরা অনেকেই আমাকে বই উৎসর্গ করেছেন। বলতে দ্বিধা নেই, বড় ও প্রধান প্রধান কথাসাহিত্যিকের তুলনায় আমার ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্ব হয়েছিল কবিদের সঙ্গে। রফিক আজাদের সান্নিধ্যে না গেলে আমি তো লেখকই হতে পারতাম না।

পিতা যেমন সন্তানকে হাত ধরে হাঁটতে শেখান, রফিক আজাদ আমাকে তেমন করে সাহিত্যের জগতে হাঁটতে শিখিয়েছেন। একুশে ফেব্রুয়ারি সকালবেলা বাংলা একাডেমিতে দীর্ঘ একটি কবিতাপাঠের অনুষ্ঠান হতো। ১৯৭২ সালে সেই অনুষ্ঠানে প্রথম গিয়েছিলাম। কবিরা মঞ্চ আলোকিত করে বসে আছেন। একের পর এক কবিতা পাঠ করা হচ্ছে।

আমি মুগ্ধ শ্রোতা। ওই অনুষ্ঠানেই প্রথম আল মাহমুদকে দেখি। ছোটখাটো ফরসা মানুষটি। মুখে হাসি লেগে আছে। প্রিন্টের হাওয়াই শার্ট আর প্যান্ট পরা। পায়ে স্যান্ডেল। কবিতা পড়ার ভঙ্গিটি একেবারেই নিজস্ব। তিনি যখন মঞ্চ থেকে নামলেন, ভক্ত-অনুরাগীরা তাঁকে ঘিরে ধরল। আমি তো তখন কবিতার কিছুই বুঝি না। কোন ভরসায় তাঁর সামনে যাব। অবাক বিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সেই মুহূর্তে নিয়তি নিশ্চয়ই মুচকি হেসেছিল। নির্ধারণ করে দিয়েছিল, এই মহান কবির সঙ্গে আমার একসময় বন্ধুত্ব হবে। তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনার সংকলনটি ‘শ্রেষ্ঠ আল মাহমুদ’ আমি সম্পাদনা করব। সেই বইয়ের মুখবন্ধে তিনি লিখবেন, “আমার লেখা গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা ইত্যাদি থেকে বাছাই করে ‘শ্রেষ্ঠ আল মাহমুদ’ নামে একটি বই যে বেরোতে পারে, তা আমার মাথায় ছিল না। এ ব্যাপারে আমার স্নেহসিক্ত বন্ধু কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলন একদিন আমার বাসায় এসে এ ধরনের একটি বই প্রকাশের প্রস্তাব দিলে আমি বিস্মিত হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। তিনি আলমগীর রহমানের মতো দক্ষ প্রকাশককে সঙ্গে নিয়ে আমার বাসায় এসেছিলেন। আমি এ ধরনের একটি কাজ নিজে গুছিয়ে তুলতে পারব তা কখনও চিন্তা করিনি। বন্ধুবর ইমদাদুল হক মিলন আমার লেখা থেকে বাছাই এবং সম্পাদনা করে বইটি প্রকাশ করবেন বলে জানালে আমি এতে রাজি হয়ে যাই...”।
সাহিত্য সম্মেলনের জন্য মুন্সীগঞ্জ শহরটি একসময় খুব বিখ্যাত ছিল। দূর অতীতে এখানকার সাহিত্য সম্মেলনে শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এসেছেন, কাজী নজরুল ইসলাম এসেছেন। কোনো একটি সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধন করেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস। তিনি ছিলেন বিক্রমপুরের তেলিরবাগ গ্রামের মানুষ। দেশ স্বাধীনের পর, ১৯৭৫-৭৬ সালের দিকে মুন্সীগঞ্জে বেশ বড় করে একটি সাহিত্য সম্মেলন হলো। দুই দিনের আয়োজন। হরগঙ্গা কলেজ প্রাঙ্গণে বিশাল প্যান্ডেল করা হয়েছে। ঢাকা থেকে কবি-লেখকরা অনেকেই গিয়েছেন। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ থেকে শুরু করে অনেক কবি। কথাসাহিত্যিকও আছেন দু-চারজন। কিন্তু কবিদের ঘিরেই পাঠক-শ্রোতার আগ্রহ বেশি। মুন্সীগঞ্জ শহরের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব কাদের ডাক্তার। তাঁর ছেলে বাবুল আখতার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ পাঠক ছিলেন। বিখ্যাত কণ্ঠযোদ্ধা। পরে বিটিভিতেও খবর পড়তেন। তাঁর ছোট ভাই মুনীর কাদেরের ডাকনাম ঝিল্লু। সে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। আমার বন্ধু। আমার তখন লেখক হিসেবে একটু একটু পরিচিতি হয়েছে। ঝিল্লু আমাকে সেই সাহিত্য সম্মেলনে নিয়ে গেছে। ’৭৩ সালে আমার প্রথম লেখা প্রকাশের পরপরই বন্ধুত্ব হয়েছে পূর্বদেশ পত্রিকার ছোটদের পাতা ‘চাঁদের হাট’ ঘিরে আমার বয়সী যে লেখক-কবিদের দলটি হয়েছে, সেই দলের সঙ্গে। সেখানে আছে ছড়াকার আবদুর রহমান, আছে ছড়া কবিতা গল্প সব কিছুই লেখে আমার তেমন বন্ধু গোলাম মাওলা শাহজাদা। শাহজাদা পড়ত ঢাকা ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগে। একসময় পুরো নামটাই সে বদলে ফেলল। হয়ে গেল হাসান হাফিজ। কবি হাসান হাফিজ। প্রচুর বই বেরিয়েছে তার। কবিতার বই অনেকগুলো। ছড়ার বই, রূপকথার বই, জীবনীগ্রন্থ, অনুবাদগ্রন্থ ও সম্পাদিত গ্রন্থ অনেক। মোটকথা আমাদের সাহিত্যজগতে হাসান হাফিজ বড় নাম। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি। কালের কণ্ঠের সম্পাদক।

মুন্সীগঞ্জের সাহিত্য সম্মেলনে তখনকার শাহজাদা আর আজকের হাসান হাফিজ ছিল আমার সঙ্গে। সেবার তাকে নিয়ে অদ্ভুত একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। রাতের বেলা ঝিল্লুদের বাড়িতে থাকতে দেওয়া হয়েছে আমাকে আর হাসান হাফিজকে। একটা চৌকিতে দুই বন্ধু পাশাপাশি শুয়েছি। ভাবলাম অনেকক্ষণ জেগে জেগে গল্প করব দুজনে। আশ্চর্য ব্যাপার, শোয়ার পর এক মিনিটও কাটেনি, হাসান হাফিজ গভীর ঘুমে ডুবে গেল। আমি বিস্মিত। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন মানুষ এভাবে ঘুমিয়ে যেতে পারে? জানি না হাসান হাফিজের সেই অভ্যাসটা এখনো আছে কি না।

মুন্সীগঞ্জ সাহিত্য সম্মেলনের কথা বলতে গিয়ে ঘটনাটা মনে পড়ল। সেই সম্মেলনে দেখেছিলাম দুজন কবিকে নিয়ে পাঠক-শ্রোতাদের কী বিপুল আগ্রহ! শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ। মুন্সীগঞ্জের মেয়েরা সুন্দরী আর স্মার্ট। কিশোরী মেয়েরাও শাড়ি পরে এসেছে। চমৎকার করে সেজেছে একেকজন। অনেকের হাতেই এ দুই কবির কবিতার বই। অটোগ্রাফ নিচ্ছে। মুগ্ধ চোখে কবিদের দিকে তাকাচ্ছে। কবিদের মুখও আনন্দে ঝলমল করছে। অদূরে দাঁড়িয়ে আমি দৃশ্যটি দেখছি। এক মেয়ে আল মাহমুদের একটু বেশি ভক্ত। আল মাহমুদকে ধরেছে ওই ভিড়ের মধ্যেই তাকে আলাদা করে কবিতা শোনাতে হবে। কবি একটুও বিব্রত হলেন না। তাঁর কবিতার কয়েকটি লাইন হাসিমুখে আবৃত্তি করলেন। সেই দৃশ্য এখনো আমার চোখে লেগে আছে।

আল মাহমুদ বাংলা কবিতার বিশাল একটি জায়গা দখল করে আছেন। কিন্তু তাঁর লেখালেখির যাত্রা শুরু হয়েছিল গল্প লিখে। ক্লাস সেভেনের ছাত্র। সত্যযুগ পত্রিকায় লিখলেন ‘তিতাস চরের ছেলে’ নামের কিশোর গল্প। জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌরাইল গ্রামে। ১১ জুলাই ১৯৩৬। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় আন্দোলনের পক্ষে কবিতা লেখার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। ক্লাস টেনের ছাত্র। গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে থেকেছিলেন অনেক দিন। সাংবাদিকতা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। কারাভোগ করেছেন। শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরি করেছেন। সাহিত্যকর্মের জন্য দেশের প্রায় সবগুলো বড় পুরস্কার পেয়েছেন।

আমি প্রথম পড়ি তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালী কাবিন’। বাংলা সাহিত্যে ‘সোনালী কাবিন’-এর সনেটগুলোর কোনো তুলনা হয় না। কবিতার পাশাপাশি কথাসাহিত্যিক হিসেবেও আল মাহমুদ বিশিষ্ট জায়গা দখল করে আছেন। তাঁর গদ্যভাষা চমৎকার। দুর্দান্ত সব গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। ১৯৭৪-৭৫ সালের দিকে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় একটি বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর ‘কালোনৌকা’ গল্পটি। পড়ে আমি মুগ্ধ। ‘জলবেশ্যা’ গল্পটি ছাপা হয়েছিল সম্ভবত জনান্তিক নামের একটি লিটল ম্যাগাজিনে। সেও এক অসামান্য গল্প। ‘পানকৌড়ির রক্ত’ তাঁর খুবই সাড়া-জাগানো গল্প। যত দূর মনে পড়ে, এই গল্পও ছাপা হয়েছিল বিচিত্রায়। কবি ফজল শাহাবুদ্দীন চমৎকার একটি পাক্ষিক পত্রিকা বের করেছিলেন—বিনোদন। পত্রিকার গেটআপ-মেকআপের ক্ষেত্রে ফজল ভাই ছিলেন মাস্টার। আল মাহমুদের ‘রোকনের স্বপনদোলা’ গল্পটি ছাপা হয়েছিল বিনোদন পত্রিকায়। ’৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হলো আল মাহমুদের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পানকৌড়ির রক্ত’। বইটি উৎসর্গ করলেন তাঁর দুই প্রিয় কথাশিল্পী বন্ধু মাহমুদুল হক ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে। প্রকাশনা সংস্থা বর্ণ মিছিল বের করেছিল ‘পানকৌড়ির রক্ত’। প্রকাশক তাজুল ইসলাম। প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জা শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। দাম ১০ টাকা। বর্ণ মিছিলের বইয়ের দোকানটি ছিল লক্ষ্মীবাজারে। সেই বই এখনো আমার কাছে আছে। কিনেছিলাম বাংলাবাজারের নওরোজ কিতাবিস্থান থেকে। তারা টেন পার্সেন্ট কমিশন দিয়েছিল। বইটির সঙ্গে সেই ক্যাশ মেমোটিও এখনো আমার কাছে আছে। গল্প ছিল পাঁচটি। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫—এই সময়কালের মধ্যে লেখা হয়েছিল গল্পগুলো।

তারপর কত দিন কত জায়গায় আল মাহমুদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। গল্প-আড্ডা হয়েছে। কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে তাঁর কবিতা শুনতে গিয়েছি। তাঁর একেকটা কবিতার বই বেরোচ্ছে, গল্প-উপন্যাস বেরোচ্ছে, গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়ি, মুগ্ধ হই। কবিতায় একেবারেই স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা আল মাহমুদ সাহিত্যের অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। কবিতায় পাঠক হৃদয় জয় করে চলেছেন। তরুণ ও প্রবীণ কবিরা মুগ্ধ হয়ে থাকেন তাঁর কবিতায়। আমরা যারা গল্প-উপন্যাস লিখি, তারা মেতে থাকি আল মাহমুদের গল্প-উপন্যাস নিয়ে। একের পর এক স্মরণীয় গল্প লিখতে শুরু করেছেন তিনি। ‘ভেজা কাফন’, ‘নীল নাকফুল’, ‘খনন’, ‘মীর বাড়ির কুরসিনামা’—এ রকম কত গল্প! মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দুর্দান্ত উপন্যাস লিখলেন ‘উপমহাদেশ’। তাঁর ‘কাবিলের বোন’ উপন্যাসটিও চমৎকার। একটা ভ্রমণকাহিনি লিখলেন ‘কবিতার জন্য সাত সমুদ্র’। নিজের কবিতা নিয়ে লিখলেন ‘আমি ও আমার কবিতা’। জসীমউদ্দীনের কবিতা নিয়ে প্রবন্ধ লিখলেন। গভীর মমতা ও ভালোবাসায় বন্ধু কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে লিখলেন ‘পরিবেশ, শামসুর রাহমান, তাঁর কবিতা’। ছোট্ট পরিসরে লিখলেন আত্মজীবনী ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’। কী চমৎকার লেখা! বড় কবির গদ্যভাষাও যে অতি আকর্ষণীয় ও পাঠকপ্রিয় হয়, আল মাহমুদ তার বড় প্রমাণ। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, জসীমউদ্দীন, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতোই শক্তিশালী গদ্য আল মাহমুদের। প্রতিটি লেখায় গভীর যত্নের ছাপ। ছোটদের জন্য কী অসামান্য সব লেখা লিখেছেন! তাঁর ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’ বইটির কোনো তুলনা হয় না। হাইনরিশ হাইনের কবিতা অনুবাদ করেছেন। প্রাচীন জাপানি কবিতা অনুবাদ করেছেন। হোর্হে লুইস বোর্হেসের কবিতা অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ করেছেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির কবিতা। সাহিত্যের যে জায়গাতেই তিনি হাত দিয়েছেন সেই জায়গাটিই আলোকিত করেছেন তাঁর নিজস্ব আলোয়।

বহু বছর আগে তরুণ কবি ও শিশুসাহিত্যিক সৈয়দ আল ফারুক তাঁর বাড়িতে কবি-লেখকদের বেশ একটা সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন। সেদিনের একটা ছবি আছে আমার কাছে। সেই ছবিটার কথা একদিন তুললেন আল মাহমুদ। তাঁর গুলশানের ফ্ল্যাটে গিয়েছি। আমার সঙ্গে অনন্যা প্রকাশনীর মনিরুল হক। অনন্যা থেকে বেরিয়েছে দুই খণ্ডে আল মাহমুদের ‘গল্পসমগ্র’। সময় প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে তাঁর ‘উপন্যাসসমগ্র’, তা-ও দুই পর্বে। ঐতিহ্য বের করেছে পাঁচ খণ্ডে ‘আল মাহমুদ রচনাবলী’। যে দিনটির কথা বলছি, সেদিন আল মাহমুদ একটু অসুস্থ। আমরা গিয়েছি তাঁর শরীরের খবর নিতে। তিনি হাঁটতে পারছিলেন না। ভেতরের ঘর থেকে একজন তাঁকে ধরে ধরে এনে সোফায় বসাল। তত দিনে তাঁর চোখের জ্যোতি কমে এসেছে। কানও আগের মতো কাজ করে না। সেই অবস্থায় আমাদের দুজনকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত কবি। জমিয়ে গল্প করতে শুরু করলেন। তাঁর শরীর খারাপ। আমরা উঠে যেতে চাচ্ছিলাম। আমাকে একটা ধমকই দিলেন। ‘আরে বসো মিয়া।’ তারপর ফারুকের বাড়ির সেই দিনটির কথা মনে করলেন। ছবিটির কথাও মনে করলেন। এতজন কবি-সাহিত্যিক একসঙ্গে খেতে বসেছেন, সেই খাবার টেবিলের ছবি। কেন যে হঠাৎ ছবিটার কথা তাঁর মনে পড়েছিল! বড় কবি-সাহিত্যিকদের বোধ হয় এ রকম হয়। হঠাৎ হঠাৎ ফেলে আসা জীবনের ছোট্ট একটি ঘটনা বড় হয়ে স্মৃতিতে চলে আসে।

আল মাহমুদ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি, এ কথা জেনে আমার অগ্রজপ্রতিম বন্ধু আলমগীর রহমান একদিন বললেন, “আমি ‘শ্রেষ্ঠ আল মাহমুদ’ বের করব। আপনি সম্পাদনা করবেন।” আলমগীর রহমান আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। বিচিত্রার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে প্রকাশনা সংস্থা করলেন। অবসর ও প্রতীক প্রকাশন। অত্যন্ত রুচিশীল ও গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করেন। ‘শ্রেষ্ঠ আল মাহমুদ’ প্রকাশ করবেন এবং সম্পাদনার দায়িত্ব আমার, শুনে আমি ভীষণ আনন্দিত। দুজনে গেলাম আল মাহমুদের কাছে। তিনি রাজি হলেন। বইটির একটি মুখবন্ধও লিখে দিলেন। এই বই সম্পাদনা করতে গিয়ে আমি বেশ ফাঁপরে পড়ে গেলাম। কোন লেখা রেখে কোন লেখা নির্বাচন করব। আল মাহমুদের সব লেখাই তো আমার পছন্দ! তার পরও বইটি প্রকাশিত হলো। এই বই আল মাহমুদ উৎসর্গ করলেন তাঁর বন্ধু আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে। সায়ীদ স্যার আমাকে খুব ভালোবাসেন। ‘শ্রেষ্ঠ আল মাহমুদ’ বইটি তাঁকে উৎসর্গ করা হয়েছে এ কথা একদিন বললাম। তখনো বইটি তাঁর হাতে পৌঁছেনি। তবে তিনি খুব খুশি হলেন। আল মাহমুদ খুব ভালোভাবে পড়া তাঁর। সেই বিকেলে স্যার তাঁর বিখ্যাত কণ্ঠে আল মাহমুদের দুটি লাইন আবৃত্তি করলেন—

‘বধূবরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকুল

গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল, কবুল।’

এক সন্ধ্যায় হুমায়ূন আহমেদের ফ্ল্যাটে গিয়েছি। দেখি তিনি ফ্ল্যাটের ভেতর একা একা পায়চারি করছেন আর বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন। বললাম, কী হয়েছে? তিনি বললেন, “আমি নুহাশপল্লীতে অনেকগুলো কাঁঠালচাঁপার গাছ লাগাব। বিকেল থেকে কথাটা ভাবছি। আর মনে পড়ছে আল মাহমুদের কবিতার লাইন—

‘আম্মা বলেন, পড়রে সোনা

               আব্বা বলেন, মন দে;

পাঠে আমার মন বসে না

               কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।’

লাইন কটি মনে পড়ার পর থেকে শুধুই কাঁঠালচাঁপার গন্ধ পাচ্ছি। কী অসাধারণ কবি!”

আল মাহমুদের কবিতা এক ঐশ্বরিক কাঁঠালচাঁপার গন্ধে মাতোয়ারা করে পাঠককে। তাঁর কবিতার সুবাস চিরকাল বাঙালি পাঠককে মোহাবিষ্ট করে রাখবে।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor