তাত্ত্বিক দিক থেকে টিউলিপ সিদ্দিকের অর্থ মন্ত্রণালয়ের জুনিয়র মন্ত্রীর পদত্যাগ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের জন্য একটি রাজনৈতিক ধাক্কা হতে পারে। তবে এটি কোনো বড় সংকট নয়।
টিউলিপ একজন স্বল্প পরিচিত রাজনীতিক; শীর্ষ সারির কেউ নন। সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর নাম খুব বেশি পরিচিত নয়। তাই তাঁকে সহজেই রাজনৈতিকভাবে বলি দেওয়া সম্ভব। তবে বাস্তবতা হলো, তাঁর পদত্যাগে সরকারের নীতিগত দিক পরিবর্তিত হবে না।
স্বাভাবিকভাবেই এটি টিউলিপের জন্য একটি কঠিন ব্যক্তিগত মুহূর্ত। তবে ব্রিটিশ জনগণের কাছে এটি একেবারেই গৌণ একটি বিষয়; এবং এটাই স্বাভাবিক। খুব কম মন্ত্রীই সাধারণ মানুষের মনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলতে পারেন। তাঁদের মধ্যে যাঁদের পদত্যাগ স্মরণীয় হয়ে থাকে (যেমন জিওফ্রে হাও, রবিন কুক বা সাজিদ জাভিদ) তাঁদের কথা অবশ্য আলাদা।
অধিকাংশ মন্ত্রীর পদত্যাগের প্রসঙ্গ সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যায়। টিউলিপ সিদ্দিকের ক্ষেত্রেও সেটি হবে। তবে তাঁর বিদায় থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নেওয়ার আছে। প্রথমত, সিদ্দিক নিজেই নিজের পতন ডেকে এনেছেন। তাঁর জানা উচিত ছিল—তাঁর লন্ডনের ফ্ল্যাট ও সম্পত্তি সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তাঁর বোঝা উচিত ছিল, তিনি যেহেতু মন্ত্রী হতে ইচ্ছুক ছিলেন, বিশেষ করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, সেহেতু তাঁকে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতেই হতো। কিন্তু তিনি তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
টিউলিপ সিদ্দিক মন্ত্রী থাকাকালে বাংলাদেশে তাঁর খালা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন—এটি বিবেচনায় নিলে এর গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। তাঁর নানা ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। তাঁর খালা হাসিনা ১৫ বছর ধরে ক্রমে দমনমূলক নীতি অনুসরণ করেছিলেন। ব্রিটেনে লেবার পার্টির বিজয়ের এক মাস পর, গত আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। সিদ্দিকের উচিত ছিল হাসিনার পতনের আগে এবং পরে আরও সাহসী ও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া, যাতে তাঁর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনো প্রশ্ন বা সন্দেহ ওঠার সুযোগ না থাকে।
অবশ্য এখন যা ঘটে গেল তাঁর জন্য তিনি একাই দায়ী নন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টি রাজনীতিতে জনগণের বিশ্বাস পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচারণা চালায়। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে রাজনৈতিক সংস্কারকে ভোটারদের জন্য একটি মূল প্রতিশ্রুতি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী স্টারমার আগেভাগেই সু গ্রে-কে নিয়োগ দেন। সু গ্রের দায়িত্ব ছিল দলকে সরকার পরিচালনার জন্য প্রস্তুত করা। তাঁর অন্যতম কাজ ছিল সম্ভাব্য মন্ত্রীদের আর্থিক অবস্থা ও তাঁদের সন্দেহজনক কোম্পানি বা শাসকদের সঙ্গে থাকা সম্পর্ককে কঠোরভাবে যাচাই করা। রাজনীতি ও সরকারকে যে গভীর সংকট থেকে বের করে আনা দরকার—সেটি লেবার পার্টির কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত ছিল।
কিন্তু তা হয়নি। বরং, যখন ২০২২ সালে সিদ্দিকের সম্পত্তির বিষয়ে প্রশ্ন ওঠে, তখন লেবার পার্টি তাঁকে রক্ষা করতে এককাট্টা হয়ে যায়। এটি একধরনের প্রবণতা হয়ে ওঠে। স্টারমার ও গ্রের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি দলের শীর্ষ নেতাদের স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে খুব বেশি উদাসীন ছিল।
স্টারমার ও অন্যান্য সিনিয়র নেতা (যেমন অ্যাঞ্জেলা রেইনার ও র্যাচেল রিভস) আবাসন, পোশাক ও বিনোদনের জন্য ব্যবহার্য জিনিস উপহার হিসেবে গ্রহণ করেন।
টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগ ব্যক্তিগত ভুলের কারণে হলেও এটি আসলে বড় রাজনৈতিক সমস্যার একটা অংশ। তাঁর ভুলগুলো দুর্নীতির মতো গুরুতর নয়, বরং অসাবধানতা ও অব্যবস্থাপনার ফল। আগে মন্ত্রীরা কেলেঙ্কারির পর টিকে যেতে পারতেন, কিন্তু এখনকার রাজনীতিতে ছোট ভুলেও কড়া শাস্তি আসে। যখন তাঁদের এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়, তখন তাঁরা ক্ষমা চাওয়ার বদলে বা নিয়ম কঠোর করার উদ্যোগ নেওয়ার বদলে বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সিদ্দিকের ঘটনা সেই একই প্রবণতার প্রতিফলন। গত মঙ্গলবার মন্ত্রীদের নৈতিক মানদণ্ড পর্যালোচনাকারী স্বাধীন উপদেষ্টা লরি ম্যাগনাস তাঁর প্রতিবেদনে বলেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার জন্য টিউলিপ সিদ্দিককে দোষ দেওয়া যায় না; তবে এর ফলে টিউলিপ ‘অপরাধে সহযোগিতার’ অভিযোগের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছিলেন।
ম্যাগনাস লিখেছেন, ‘দুঃখজনক যে তিনি তাঁর ও সরকারের জন্য সম্ভাব্য মর্যাদাগত ঝুঁকি সম্পর্কে যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন না।’ এটি অত্যন্ত মৃদুভাবে বলা হলেও, বিষয়টি কিন্তু খুবই গুরুতর।
সার্বিক দিক বিবেচনা করলে বলা যায়, কিয়ার স্টারমারকেও এই ব্যর্থতার দায় নিতে হবে। কারণ, বিরোধী দলে থাকাকালে তিনি বিশ্বাসযোগ্যতা ও সততার ওপর জোর দিলেও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সেগুলোকে অগ্রাধিকার দেননি। তিনি মন্ত্রিসভার আচরণবিধির হালনাগাদ অবস্থা প্রকাশ করতে দেরি করেছেন। অথচ এটি তাঁর প্রথম দিনেই করা উচিত ছিল।
দৃশ্যত টিউলিপ সিদ্দিক মন্ত্রিত্বের আচরণবিধি লঙ্ঘন করেননি। তবে তদন্তকারী লরি ম্যাগনাস তাঁকে পুরোপুরি দায়মুক্তিও দেননি। নিয়ম অনুযায়ী, মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সরকারি দায়িত্বের মধ্যে কোনো সংঘাত তৈরি হতে পারে এমন পরিস্থিতি এড়ানোর কথা ছিল। তবে এই নিয়ম খুবই দুর্বল ও অস্পষ্ট এবং তা আরও কঠোর করার প্রয়োজন হতে পারে।
রাজনীতিতে জনগণের বিশ্বাস কমে যাওয়ার জন্য শুধু রাজনীতিবিদরাই দায়ী নন, গণমাধ্যমও ভূমিকা রেখেছে। মূলধারা ও সামাজিক গণমাধ্যম রাজনৈতিক ভুলত্রুটি খুঁজে বের করে নেতাদের এমন পরিস্থিতিতে ফেলেছে। এখানে অনেক সময় অনেক ছোট ঘটনাকেও বড় করে দেখানো হয়। যেমন, মূল্যস্ফীতি ২.৬% থেকে ২.৫ %-এ কমার বিষয়টি সাধারণ পরিবর্তন হলেও এটিকে অনেক সময় বড় সাফল্য হিসেবে তুলে ধরা হয়।
টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগ ব্যক্তিগত ভুলের কারণে হলেও এটি আসলে বড় রাজনৈতিক সমস্যার একটা অংশ। তাঁর ভুলগুলো দুর্নীতির মতো গুরুতর নয়, বরং অসাবধানতা ও অব্যবস্থাপনার ফল। আগে মন্ত্রীরা কেলেঙ্কারির পর টিকে যেতে পারতেন, কিন্তু এখনকার রাজনীতিতে ছোট ভুলেও কড়া শাস্তি আসে।
তাঁর ঘটনা দেখায় যে রাজনীতিবিদদের জন্য এখন পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে গেছে। একই সঙ্গে, এটি প্রমাণ করে যে অনেক আধুনিক রাজনীতিবিদ এমন কঠোর পরিবেশ সামাল দেওয়ার জন্য যথেষ্ট দক্ষ নন।
Publisher & Editor