শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫

‘পরাবাস্তবতার পৃথিবী’ ছেড়ে গেলেন লিঞ্চ

প্রকাশিত: ২৩:৪৫, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫ |

সাত বছর ধরে লস অ্যাঞ্জেলেসের এক জায়গায়, একই সময়ে চকলেট মিল্কশেক খেতেন ডেভিড লিঞ্চ। বিশ্বাস করতেন, এটা তাঁর সৃজনশীলতায় ভূমিকা রাখে। এখন অবশ্য এসব নিয়মের অনেক ঊর্ধ্বে চলে গেছেন নির্মাতা, গত বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর মৃত্যুর খবর জানিয়েছে পরিবার। চার দশক ধরে বিশ্ব চলচ্চিত্রে প্রভাব বিস্তারকারী এই নির্মাতার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।

লিঞ্চের সর্বশেষ পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘ইনল্যান্ড এম্পায়ার’ মুক্তি পেয়েছে ২০০৬ সালে; টিভি সিরিজ ‘টুইন পিকস: দ্য রিটার্ন’ বানিয়েছিলেন সেটাও আট বছর হয়ে গেছে। তিনি অবসর নেননি আবার নিয়মিত কাজও করছিলেন না। তবে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র না বানালেও পরে অনেকগুলো স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা বানিয়েছেন লিঞ্চ, সেগুলোও সমালোচকদের কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে পিপল সাময়িকীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজেই জানিয়েছিলেন, সিনেমা পরিচালনার অবস্থায় তিনি আর নেই। আট বছর বয়স থেকে ধূমপান করেছেন, এই বদভ্যাসের কারণে ফুসফুসের জটিল রোগ কাবু করে ফেলেছে। বাড়ির বাইরে যেতে পারেন না, হাঁটতে গেলেও অক্সিজেন লাগে। এবার চলেই গেলেন তিনি।

বৃহস্পতিবার রাতে পরিবারের পক্ষ থেকে ফেসবুকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘পরিবারে তো বটেই, তবে শিল্পীর মৃত্যুতে বিশ্বের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিরাট শূন্যতা তৈরি হলো।’ তাঁর মৃত্যু নিয়ে বিশদ তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। জানানো হয়নি মৃত্যুর তারিখও। অনেক গণমাধ্যম বলছে, লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানলের কারণে বাড়ি ছেড়ে মেয়ের বাড়িতে উঠেছিলেন। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। ১৯৬৭ সালে পেগি লিঞ্চের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ডেভিড লিঞ্চ। পরে আরও তিনবার বিয়ে করেন, কোনো সংসারই টেকেনি। চার সন্তান রেখে গেছেন প্রখ্যাত এই নির্মাতা।

ডেভিড লিঞ্চের মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই শোক বই হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শকেরা স্মরণ করেছেন নির্মাতাকে। মোটে ১০টি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা আর ৪টি সিরিজ বানিয়ে লিঞ্চ কীভাবে এতটা প্রভাব বিস্তারকারী নির্মাতা হয়ে উঠলেন? এর উত্তর লুকিয়ে আছে লিঞ্চের ‘পরাবাস্তবতার পৃথিবীতে’। হলিউডের প্রচলিত ঝাঁ–চকচকে নির্মাণের বদলে সিনেমায় নতুন ভাষা এনে দিয়েছিলেন তিনি, তাঁর সিনেমার পরাবাস্তবতার ঘোর দর্শককে বুঁদ করে রাখে দশকের পর দশক। ফেদেরিকো ফেলিনি, জঁ-লুক গদার, ইঙ্গমার বার্গম্যান, জাক তাতির মতো ইউরোপীয় নির্মাতাদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলেন লিঞ্চ, তাঁর কাজে যার স্পষ্ট ছাপ ছিল। তাই তাঁর নির্মাণে বরং ইউরোপের ছাপ থাকত বেশি।

লিঞ্চের মৃত্যুর খবরে বাংলাদেশের অনেক দর্শকের শুরুতেই মনে পড়েছে ‘টুইন পিকস’-এর কথা। নব্বইয়ের দশকে বিটিভিতে প্রচারিত সিরিজটি পরের কয়েক দশকের নির্মাতাদের প্রেরণা জুগিয়েছে। অনেকে মনে করেন, গত তিন দশকে মুক্তি পাওয়া টিভি ও ওটিটির উল্লেখযোগ্য অনেক প্রকল্পই লিঞ্চের এই সিরিজ থেকে অনুপ্রাণিত। তবে ‘টুইন পিকস’-এর আগে থেকেই লিঞ্চ হয়ে উঠেছিলেন বিশ্ব চলচ্চিত্রে এক সমীহজাগানিয়া নাম। তত দিনে ‘ইরেজারহেড’, ‘দ্য এলিফ্যান্ট ম্যান’, ‘ব্লু ভেলভেট’-এর মতো সিনেমা তিনি বানিয়ে ফেলেছেন।

‘মুলহল্যান্ড ড্রাইভ’কে লিঞ্চের ক্যারিয়ারের সেরা সিনেমা মনে করা হয়। ২০০১ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি পরাবাস্তব নিও-নোয়া মিস্ট্রি ঘরানার। মার্কিন-ফরাসি যৌথ প্রযোজনাটি মূলত টেলিভিশন চলচ্চিত্র হিসেবে নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। লিঞ্চের জমা দেওয়ার পর টেলিভিশন নির্বাহীরা তা বাতিল করে দেন। লিঞ্চ এরপর এতে সমাপ্তি টেনে এটিকে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে রূপদান করেন। লিঞ্চের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসুলভ পরাবাস্তববাদী শৈলীর সঙ্গে নির্মিত ‘মুলহল্যান্ড ড্রাইভ’ আসলে কী বলতে চেয়েছে, সেটা ব্যাখ্যার ভার দর্শকের ওপর ছেড়ে দেন লিঞ্চ। তিনি এ সিনেমার ট্যাগলাইন দেন, ‘স্বপ্নের শহরে ভালোবাসার গল্প’। টিভি কর্তৃপক্ষের ফিরিয়ে দেওয়া ‘মুলহল্যান্ড ড্রাইভ’কে পরে বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা সিনেমার মর্যাদা দেন সমালোচকেরা।

১৯৪৬ সালের ২০ জানুয়ারি মন্টানার ছোট্ট শহর মিসোলায় জন্ম লিঞ্চের। তিনি শুরুতে চারুকলায় পড়াশোনা করেছেন, শিল্পী হিসেবেই ক্যারিয়ার শুরু করেন। ষাটের দশকের শেষের দিকে স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা দিয়ে নির্মাণে হাতেখড়ি।

পরে তিনি যোগ দেন আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটে, এখানেই শুরু করেন প্রথম সিনেমা ‘ইরেজারহেড’-এর কাজ।

চলচ্চিত্র নির্মাণ ছাড়াও তিনটি গানের অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন, লিখেছেন বইও। ১৯৬৭ সালে শুরু করে প্রতিবছরই দুনিয়ার নানা প্রান্তে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়েছে। পর্দায় অভিনয় করতেও দেখা গেছে লিঞ্চকে। ২০২২ সালে স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘দ্য ফ্যাবেলম্যানস’-এ এক নির্মাতার চরিত্রে অভিনয় করেন।

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে কাজের জন্য চারবার অস্কার মনোনয়ন পেয়েছেন লিঞ্চ। ২০১৯ সালে পেয়েছেন সম্মানসূচক অস্কার। প্রখ্যাত এই নির্মাতার প্রয়াণে শোক প্রকাশ করেছেন স্টিভেন স্পিলবার্গ। ভ্যারাইটিকে তিনি বলেন, ‘তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র এক ব্যক্তিত্ব, তার সব সিনেমায় নিজের ছাপ থাকত।’ লিঞ্চের মৃত্যুতে ‘হতভম্ব’ ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা।

সাম্প্রতিক নানা ঘটনায় হতাশ ছিলেন লিঞ্চ। পিপলকে দেওয়া সর্বশেষ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমরা মার্কিনরা এতটা বিভক্ত, ভাবা যায় না। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ঘৃণা করে। এসবের মধ্যে আসলে বাঁচা যায় না।’ সত্যি সত্যিই ৭৯তম জন্মদিনের কয়েক দিন আগেই চলে গেলেন তিনি।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor