সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটি পোস্টে সুদানি বিশ্লেষক তাজ আল-স্যার ওথম্যান ওয়াদ মাদানির মুক্তিকে সিরিয়ার আলেপ্পোর শহরের মুক্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি তাঁর পোস্টে লেখেন, ‘আলেপ্পোর পতন যদি লেভান্তে ইরানি স্বপ্নের পতনের শুরু হয়ে থাকে, তাহলে ওয়াদ মাদানির পতন সুদানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ধ্বংসাত্মক স্বপ্নের পতন।’
ওথম্যানের এ মন্তব্য সুদানের আর্মড ফোর্সেস (এসএএফ) হাতে আল-জাজিরা রাজ্যের রাজধানী ওয়াদ মাদানির মুক্ত হওয়ার প্রসঙ্গটিকে চিহ্নিত করা যায়।
ওয়াদ মাদানি সুদানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) এক বছরের বেশি সময় যে সহিংস দখলদারি চালিয়ে আসছিল, সে প্রেক্ষাপট থেকে এ বিজয় একটা আশার আলো।
ওয়াদ মাদানি মুক্ত হওয়ার ঘটনাটি সুদানের গৃহযুদ্ধের গতিপথে একটি নিষ্পত্তিমূলক পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করে। এ ঘটনা সুদানের ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এ অগ্রগতি খার্তুমের নিকটবর্তী আল-জাজিরায় আরএসএফের আগ্রাসনের আগের অবস্থানে ফ্রন্টলাইনকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্ট থেকে এটা অনুমান করা যায় যে সুদানের সেনাবাহিনী যেকোনো মুহূর্তে খার্তুমে ঝড় তুলবে।
ওয়াদ মাদানি পুনরুদ্ধারের ঘটনা সুদানের সেনাবাহিনীর জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এটি কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ শহর। পোর্ট সুদান বা সুদান বন্দর থেকে বেশ কয়েকটি রুটে যাওয়ার সংযোগস্থল এ শহরটি। অবস্থানের দিক থেকে আবার রাজধানীর কাছাকাছি অবস্থান।
আল-জাজিরা রাজ্যটি সুদানের রুটির ঝুড়ি বলে খ্যাত। হোয়াইট নীল ও ব্লু নীল নদের মধ্যে অবস্থানের কারণে এটা কৃষি উৎপাদনের বড় একটা ক্ষেত্র। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ওয়াদ মাদানির পুনরুদ্ধার এসএএফ ও তাদের সহযোগীদের নৈতিক মনোবল বাড়াবে।
তারা বলছে, আরএসএফের দখল থেকে সব ভূখণ্ড উদ্ধার করার আগ পর্যন্ত তারা লড়াই চালিয়ে যাবে। ওয়াদ মাদানির দক্ষিণে সেন্নার মুক্ত হওয়ার পর থেকে এসএএফ এবং মিত্রবাহিনী উত্তরে ওয়াদ মাদানির দিকে ক্রমেই অগ্রসর হচ্ছিল। এ সপ্তাহের শুরুতে আল-শাবার্গ, হজ আবদুল্লাহ এবং উম আল-কুরা শহরগুলোর পাশাপাশি কিছু ছোট গ্রাম পুনরুদ্ধার করে।
১২ জানুয়ারি এসএএফ তাদের অভিযাত্রার গতি তীব্র করে। মিত্রবাহিনী নীলনদের পূর্ব দিক থেকে হান্টুব সেতু হয়ে ওয়াদ মাদানিতে প্রবেশ করে। আরএসএফ মিলিশিয়াদের শহর থেকে বের করে দেওয়ার পর তাদের নির্মিত অস্থায়ী কারাগারে আটক বন্দীদের মুক্তি দেয়।
ওয়াদ মাদানিতে এসএএফের বিজয় এবং আরএসএফের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনা এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে আধা সামরিক বাহিনী আরএসএফ আর আগের অবস্থানে ফিরে আসতে পারবে না। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র দাগালো এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে আরএসএফ পরিচালিত সাতটি কোম্পানির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এসব বন্দীকে অত্যন্ত বাজে পরিবেশে আটকে রাখা হয়েছিল। বন্দীদের অনাহারে রাখা হয়েছিল। তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছিল। এমনকি তাঁদেরকে চিকিৎসাও দেওয়া হয়নি। সুদান ট্রিবিউনের খবরে বলা হয়েছে, ওয়াদ মাদানির এসএএফের ফিল্ড কমান্ডার বন্দীদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার আগে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার আদেশ দেন।
ওয়াদ মাদানির উত্তর দিকে এসএএফ বাহিনী এখন অগ্রসর হচ্ছে। এসএএফের মিত্র সুদান শিল্ড ফোর্সেস এখন পূর্ব আল-জাজিরা ও এর আশপাশের এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। আরএসএফ এখন খার্তুমের নিকটবর্তী উত্তর আল-জাজিরায় তাদের সেনা অবস্থানে পিছু হটেছে।
বিজয়ের আনন্দের মধ্যেও বেদনা আছে। ওয়াদ মাদানি শহরটি মৌলিক সেবা থেকে বঞ্চিত। পুরো শহরটি বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ থেকে বিচ্ছিন্ন। আরএসএফের সশস্ত্র যোদ্ধারা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস এবং জিনিসপত্র লুটপাট করেছেন।
ওয়াদ মাদানিতে এসএএফের বিজয় এবং আরএসএফের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনা এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে আধা সামরিক বাহিনী আরএসএফ আর আগের অবস্থানে ফিরে আসতে পারবে না। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র দাগালো এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে আরএসএফ পরিচালিত সাতটি কোম্পানির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
কয়েক মাস ধরে জাতিসংঘে তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপনের পর জো বাইডেন প্রশাসন অবশেষে আরএসএফ ও এর প্রক্সিদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিল। আরএসএফকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে মার্কিন প্রশাসন এই স্বীকৃতি দিল যে আরএসএফ গণহত্যা চালিয়েছে।
এ ঘটনার তাৎপর্য হচ্ছে, সুদান নিয়ে যেসব উদ্যোগ চলছিল, সেগুলো অকার্যকর হয়ে গেল। বিশেষ করে সুদান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে তুরস্ক সরকারের উদ্যোগ এখন ভেস্তে গেল। আরব আমিরাতকে সুদান যুদ্ধে ইন্ধন জোগানোর জন্য অভিযুক্ত করা হয়।
এ উদ্যোগে আরএসএফকে বৈধতা দেওয়া, তুরস্ক ও আরব আমিরাতের তত্ত্বাবধানে আরএসএফের সঙ্গে এসএএফের একীভবনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যাহোক, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এ প্রস্তাবটির কার্যকারিতাকে অকেজো করে দেয়। আরএসএফ ও তাদের মিত্ররা রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে বৈধতার অর্জনের যে আশা করেছিল, সেই আশার গুঁড়ে এখন বালি পড়তে দিয়েছে।
তুরস্কের মধ্যস্থতায় এ উদ্যোগে একটি বিধান ছিল বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা ও আবদুল্লাহ হামদোককে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুনর্বহাল করা। ২ জানুয়ারি বার্তা সংস্থা রয়টার্সে প্রকাশিত একটি খবর থেকে জানা যায়, সুদানের তাগাদুম (দ্য সুদানিজ কোঅর্ডিনেশন সিভিল ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস) আরএসএফ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নতুন একটি বেসামরিক সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়। আরএসএফের সঙ্গে তাগাদুম ও হামদোকের জোট একটি রাজনৈতিক অশুভ চক্রে পরিণত হয়েছে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, এ জোটটিকে আর সুদানের ভবিষ্যৎ–সম্পর্কিত আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।
Publisher & Editor