মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫

শীত উৎসব ও উদযাপনের ঋতু

প্রকাশিত: ০০:১৮, ২১ জানুয়ারি ২০২৫ |

আমাদের প্রকৃতিতে শীত ক্ষণস্থায়ী হলেও শীতের আবেদন গভীর এবং হৃদয়স্পর্শী। শীতকে উদযাপনের যাবতীয় আয়োজন ও প্রস্তুতি রীতিমতো উৎসবমুখর। আবহমানকাল ধরে এই জনপদে শীতসঙ্গ ভিন্ন এক আখ্যান রচনা করে চলেছে। উত্তর জনপদে প্রান্তিক মানুষের জীবনে যা কখনো কখনো দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

তখন শীত নয়, বরং সূর্যই যেন পরম কাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে। ‘প্রার্থী’ কবিতায় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য সে কথাই বলেছেন—
‘হে সূর্য। শীতের সূর্য!

হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায়

আমরা থাকি

যেমন প্রতীক্ষা ক’রে থাকে কৃষকদের চঞ্চল চোখ,

ধানকাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলির জন্যে।’

শীতের দিনরাতের মুহূর্তগুলো, মাঠের বিচিত্র ফসলের সমাবেশ, ঝলমলে রোদ, মৌসুমি ফুলের বাগান, পরিযায়ী পাখির কলকাকলি, খাবারের ব্যতিক্রমী আয়োজন—সব মিলিয়ে তুমুল প্রভাববিস্তারী এই ঋতু।

শীতের রং, রূপ, গন্ধ, সৌন্দর্য একেবারেই আলাদা। আর আছে ঘোরলাগা কিছু মুহূর্ত, হিম হিম বাতাসে পরিযায়ী হওয়ার আমন্ত্রণ। আলো-ঝলমল রোদের কণায় থাকে ভ্রমণের উন্মাদনা।       
পৌষালি দিনে ভোরে শিশিরের শব্দ আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়।

আবার বিষণ্ন বিকেলের ছায়া পড়ে নদীর ঘোলা জলে। দূরে ঘাটে বাঁধা নৌকাগুলোয় অন্ধকার জমাট বাঁধতে শুরু করে। তখন নদীর ওপারে সদ্য বোনা নবীন মধুমটরের ফুলগুলো আমাদের মায়াবি ইশারায় ডাকে। সেখানে এখন মুগ, মসুর, সরিষার দানাগুলো দিব্যি বেড়ে উঠছে। আরেকটু দূরে কুলের বাগান, তারপর বিচ্ছিন্ন জনপদ।

দূরে আরেকটি গ্রাম খোলা আকাশের নিচে কুয়াশায় মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে, শান্ত, নিশ্চুপ। গ্রামের মানুষগুলো আবছা আলোয় ফিরে যাচ্ছে আপন ডেরায়। দিগন্ত রেখার কাছে, গ্রামের কিনারায় কুয়াশা আর নাড়া পোড়ানোর ধোঁয়া মায়াবি মেখলা হয়ে উঠেছে। মধুমটরের বেগুনিরঙা ফুলগুলোয় বিন্দু বিন্দু শিশির জমতে শুরু করেছে। এই ভর সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ আলপারে বসতে পারলে মন্দ হয় না।
শীতের পরিযায়ী মন নিরন্তর ছুটে চলে। নিরন্তর ছুটে চলার পথে আমাদের প্রেরণা হয়ে ওঠে বুকের গহনে লুকিয়ে থাকা শস্যের মাঠ; ডাল-কাউন-সরিষা, শীতের অতিথি ফুল, খালপারে তুলে রাখা ভেসাল, লাউয়ের মাচা, তাল-সুপারির বন। এত কিছু দেখেও যেন অতৃপ্ত মন। ফের রামুর নির্জন পাহাড়ি পথ। দুপাশে দুর্মর সবুজ। হঠাৎ একটুকরো ধোপদুরস্ত গর্জন বন। দু-একটি প্রাকৃতিক লেক। আশপাশে কোনো লোকালয় নেই। ভালোভাবে কান পাতলে শুধু পাখির কূজন। তবু মনে হয়, কাছেপিঠে কেউ যেন ফিসফিসিয়ে কথা বলে। হয়তো গাছেরাই কথা বলে নিজেদের সঙ্গে। নির্জনতার এ আখড়াটুকু একসময় হয়তো আর থাকবে না। তখন পাখিরা ফিরে যাবে অন্য কোনো নির্জনতায়।

হেমন্তের সোনালি মাঠগুলো কৃষকের মুখে হাসি ফোটালে অতঃপর কিছুদিন বিরান পড়ে থাকে সেই শস্যভূমি। আবার শস্য-শিশুরা সবুজ পৃথিবীতে চোখ মেলে তাকানোর আগে রেখে যায় অনেক স্মৃতি। বিবর্ণ স্তূপীকৃত ঝরাপাতা মমতার বন্ধনে জড়াতে না জড়াতেই চারপাশে উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে। তখন ক্রমশ মমতার বন্ধন শিথিল হতে থাকে। উদোম বন-প্রান্তরে শুধু শীতার্ত বাতাস ঘুরপাক খায়। ধুলাবালুর সঙ্গী হয়ে উড়ে যায় ঝরাপাতার ছাই, উচ্ছিষ্ট। চারপাশে ঝুলে থাকে সোঁদা গন্ধ। দূরে ফসলের মাঠ থেকে আসে নাড়া পোড়ানো তীব্র ধোঁয়াটে ঘ্রাণ। এই আপন গন্ধ মগজের কোষে কোষে বিবশ কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে থাকে। তখন সৌরভ কিংবা বর্ণিল উচ্ছ্বাসের জন্য রজনীগন্ধা, গ্ল্যাডিওলাসরা ছিল না। অনেক বৈরিতায়ও গোলাপ হাসত। মধ্যদুপুরে ঘুঘুর সুখ ছড়িয়ে পড়ত শিরীষের পত্রহীন ডালে। প্রকৃতির এই অন্তরঙ্গ চিত্র শুধু জীবনানন্দ দাশের কবিতাতেই উপলব্ধি করা যায়—

  ‘ধান কাটা হয়ে গেছে কবে যেন-ক্ষেতে মাঠে পড়ে আছে খড়

পাতা কুটো ভাঙা ডিম-সাপের খোলস নীড় শীত।

এইসব উতরায়ে ওইখানে মাঠের ভিতর

ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ—কেমন নিবিড়।’

শীতের শুষ্কতায় প্রকৃতির সবুজ প্রলেপ খসে পড়লেও আমাদের কল্পনায়, কবির ভাবনায় তার আবেদন ভিন্ন রকম। নজরুলের কবিতায় পাওয়া যায় পৌষের আবাহন গীত। তাতে থাকে বিগত ঋতুর বিদায়-প্রসঙ্গ, ঝরাপাতাদের বেদনাসিক্ত বিলাপ। তিনি লিখেছেন-

‘পউষ এলো গো!

             পউষ এলো অশ্রু-পাথার হিম পারাবার পারায়ে

ঐ যে এলো গো—

কুজ্ঝটিকার ঘোম‌টা-পরা দিগন্ত-রে দাঁড়ায়ে\

সে এলো আর পাতায় পাতায় হায়

বিদায়-ব্যথা যায় গো কেঁদে যায়,

অস্ত-বধূ (আ-হা) মলিন চোখে চায়

পথ-চাওয়া দীপ সন্ধ্যা-তারায় হারায়ে\’

শীতের ভালো লাগা কবিগুরুর মনে দাগ কাটতে না পারলেও বিরহের সুর গেঁথেছেন ‘উদেবাধন’ কবিতায়। তাতে গাছের শুষ্ক শাখা, জীর্ণ পাতা, কুয়াশার ঘন জাল, হিমহিম ভাব-কোনোটাই বাদ যায়নি। শীতের আগমনকে তিনি বসন্তের জয় হিসেবেই দেখেছেন। তাঁর শীতের সংগীতে আছে ভিন্ন এক সুর—

‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আম্লকির এই ডালে ডালে।

পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে\’

অন্যত্র আছে—

‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আ য় আ য় আ য়

ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে,  মরি হা য় হা য় হা য়।’

পৌষালি দিনে প্রকৃতিতে চলে এক অদ্ভুত কুয়াশার খেলা। কুয়াশার রহস্যময় আবরণ মানুষের দৃষ্টিসীমা বেঁধে দেয়। রাতের কুয়াশা ভোরের শিশির হয়ে স্নিগ্ধতা ছড়ায়। নিসর্গ-মুগ্ধ কবি জীবনানন্দের কবিতায় কুয়াশার মাঠে ফিরে যাওয়ার ব্যাকুলতা পরাবাস্তব সংলাপে অনবদ্য হয়ে ধরা দেয়। তাঁর হৃদয়ে শীতের অনুভব বহুমাত্রিক। শীতের রাত আলাদা এক ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়ে ওঠে—

‘এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;

বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,

কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।’

শৈশবের শীতের মুহূর্তগুলো আজকাল যেন অদৃশ্য সুতায় ভর করে পাড়ি জমিয়েছে অন্য কোথাও। এমনকি গত দুই দশকেও উদযাপন করার মতো শীতের দেখা মেলেনি। তবু আমরা শীতের অপেক্ষায় থাকি। যেমন থাকে অগ্রহায়ণ-পৌষের শস্যের মাঠগুলো। আর অপেক্ষায় থাকে ঝলমলে রোদ্দুরের নিচে থাকা সুদর্শন মৌসুমি ফুলের বাগানগুলো। শীতের নিষ্প্রাণ প্রকৃতিকে কিছুটা হলেও প্রাণবন্ত করে তোলে বর্ণিল মৌসুমি ফুল। দিগন্ত বিস্তৃত হলুদ সর্ষেক্ষেত; সত্যিই লোভনীয় দৃশ্য। ফসলের মাঠের এই নান্দনিক শোভা শুধু শীত মৌসুমেই পাওয়া যাবে।

নগরে শীতের প্রকৃতিকে উপভোগ্য করতেই শীতবাগানের সূচনা। শীতের বিবর্ণ প্রকৃতির বিপরীতে মৌসুমি ফুলের বাগানগুলো রঙের ঝরনাধারার মতো। বিচিত্র রঙের ফুলে ফুলে ভরে ওঠে চারপাশের বাগানগুলো। দেশে শীতের এসব ফুলের বেশির ভাগই এসেছে শীতের দেশ থেকে। তবু কয়েক জাতের ফুল আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গেছে দারুণভাবে। রংবেরঙের এসব ফুলের মধ্যে আছে ভার্বেনা, ডায়ানথাস, ডালিয়া, ক্যালেন্ডুলা, পপি, গাঁদা, কসমস, অ্যাস্টার, চন্দ্রমল্লিকা ইত্যাদি। বর্ণবৈচিত্র্যের কারণে অ্যাস্টার সারা পৃথিবীতেই জনপ্রিয় ফুল। এদের অনেক রং—নীল, রক্তলাল, সাদা, গাঢ় লাল, হলুদ ও বাসন্তী। তবে নীল অ্যাস্টার সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন। ডালিয়া মৌসুমি ফুলের মধ্যে সবচেয়ে নজরকাড়া। এই ফুলের বিচিত্র গড়ন আর রঙের শেষ নেই। চন্দ্রমল্লিকার জন্মস্থান চীন, আর সমাদর জাপানে। কারণ চন্দ্রমল্লিকা জাপানের জাতীয় ফুল। গোলাপের মতোই কয়েক হাজার রকমফের চোখে পড়ে। আমাদের দেশে বিক্ষিপ্তভাবে শার্লি পপির চাষ হয়। অনেক রঙের পপি শীতের বাগান মাতিয়ে রাখে। কমলা বা হলুদ রঙের ক্যালেন্ডুলা দেখতে বেশ নজরকাড়া। শীতের বাগানে লাল টুকটুকে রং ছড়ায় সালভিয়া। আবার লুপিনের নীলাভ স্নিগ্ধতা শীতের বাগানকে মাতিয়ে রাখে সারাক্ষণ। শীতের বাগানে আরো আছে স্ট্র-ফ্লাওয়ার, কর্নফ্লাওয়ার, হলিহক, জারবেরা, পিটুনিয়া, ভার্বেনা, ফ্লক্স, কসমস, জিনিয়া ইত্যাদি।

ব্যস্ত নগরে জীবন-জীবিকার প্রাণান্ত দৌড়ে আমাদের একান্ত সময়গুলো বিক্রি হয়ে গেছে। ইচ্ছে করলেই যখন-তখন হারিয়ে ফেলা সেই নির্জন খালপার, বাড়ির পেছনের ধু-ধু মাঠ, মধ্যদুপুরে শালিকের গান, বিষণ্ন বিকেলের মাঠপার, শিশিরভেজা শিমফুল-লাউয়ের ডগা—এসব আর ছুঁয়ে দেখতে পারবে না। প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা একজন মানুষ ফেলে আসা জীবনের এসব টুকরা স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকেন। তিনি মননে ধারণ করেন পদ্মা, রাইন নয়। মাধবকুণ্ড, নায়াগ্রা নয়।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor