বুধবার, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

পুলিশ কোথাও নরম, কোথাও কেন গরম?

প্রকাশিত: ০০:১৮, ২২ জানুয়ারি ২০২৫ |

এ সপ্তাহে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতির মন্থর প্রবৃদ্ধি নিয়ে পূর্বাভাস দিয়েছে। অর্থনীতির হালচাল জানতে সম্প্রতি পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে, তিনি রাখঢাক ছাড়াই উত্তর দেন, ‘অর্থনীতির অবস্থা যে বেহাল, সেটা বোঝার জন্য বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই। রাস্তাঘাটে ঘুরলে, রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালাদের সঙ্গে কথা বললেই সেটা বোঝা যায়। শুধু গরিব কিংবা নিম্নবিত্ত নয়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল না হওয়ায় ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা—সবার মাঝেই একটা অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।

অর্থনীতির সমান্তরালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও সবার মধে৵ উদ্বেগ আছে। ছিনতাই, অপহরণ ও চাঁদাবাজির মতো অপরাধ গত কয়েক মাসে অনেকটাই বেড়েছে। অর্থনীতির গতিহীনতা বলি আর স্থবিরতা বলি, তার সঙ্গে নিরাপত্তা বোধের সম্পর্ক অস্বীকার করার জো নেই। বিদেশি বিনিয়োগে ভাটার টান রয়েই গেছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ ২০০ কোটি ডলার থেকে ১৫৯ কোটি ডলারে হ্রাস পেয়েছে। এ অবস্থায় অর্থনীতির চাকাটা সচল রাখার জন্য দেশি বিনিয়োগই ভরসা।  চাঁদাবাজি হলে, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা হলে, ব্যবসায়ীরা কোন ভরসায় তাঁদের পকেটের টাকা বিনিয়োগ করবেন?

সম্প্রতি রাজধানীর মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে এক ব্যবসায়ীকে ১৫-২০ জনের সন্ত্রাসী দল কুপিয়ে আহত করার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। বিপণিবিতানটির ৭০০ দোকানের ইন্টারনেট, পানি ও ময়লার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও নগদ চাঁদা চেয়ে না পাওয়ায় তারা হামলাটি চালিয়েছিল। এর পেছনে একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ।  ১৪ জানুয়ারি প্রথম আলোর খবরের শিরোনাম ছিল ‘পেশাদার অপরাধীরা তৎপর, উদ্বেগ’। প্রতিবেদনে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে পেশাদার অপরাধী সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, অভ্যুত্থানের পর যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তার সুযোগ নিয়ে অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে মুক্তি পেয়ে যান। মুক্ত হওয়ার পর তাঁরা আবার বিভিন্ন এলাকার অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। রাজধানীর ধানমন্ডি, এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, কাফরুল, পল্লবী, বাড্ডা, মহাখালী ও মতিঝিল এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়েছে। নিয়মিত চাঁদাবাজি, তুলে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়, হুমকি-ধমকি দেওয়ার মতো অপরাধের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা নিয়ে খোদ পুলিশের নেতৃত্ব উদ্বিগ্ন।

পুলিশ, র‍্যাব ও আনসারের পোশাক বদলের চিন্তা করছে সরকার। এখানে দুটি প্রশ্ন জোরেশোরে উঠছে। পোশাক বদলে গেলেই কি ধরন বা চরিত্র বদলে যাবে? আর টাকার সংস্থানে সরকারকে যখন হন্যে হয়ে ফিরতে হচ্ছে সে সময়ে পোশাক বদলের সিদ্ধান্ত বিলাসিতা হবে কি না।
একসময় ঢাকার অপরাধজগতের ত্রাস ছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। সীমান্ত ভাগ করে তাঁরা অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন। চাঁদাবাজি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় থেকে খুনাখুনি এ রকম অপরাধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছিল। ২০০১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ রকম ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম তালিকাভুক্ত করেছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর নানা সময়ের অভিযানে এ ধরনের অপরাধের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন নাগরিকেরা। ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পরে কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে মুক্তি পান। এরপর তারা এলাকাভিত্তিক অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।

এখানে প্রশ্নটি খুব সরল। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশে যখন পুলিশি ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছিল, তখন কারা, কোন স্বার্থে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মুক্ত করেছিলেন? পাঁচ মাস পর এসে দেখা যাচ্ছে, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা পেশাদার অপরাধীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাহলে কী করছে?

চাঁদাবাজি, অপহরণের সঙ্গে ছিনতাই এখন নগরবাসীর জন্য মূর্তিমান আতঙ্কের নামে পরিণত হয়েছে। ১৫ জানুয়ারি দ্য ডেইলি স্টার–এর প্রতিবেদন বলছে, ‘বিশেষ অভিযানের মধ্যেই ঢাকার রাস্তায় ভীতি তৈরি করছে ছিনতাইকারীরা। ডিসেম্বর মাসে সারা দেশে ১৫৯টি ছিনতাইয়ের ঘটনা পুলিশের নথিভুক্ত হয়েছে, নভেম্বর মাসে এ রকম ঘটনার সংখ্যা ছিল ১৩৩। ২০২৩ সালের তুলনায় ছিনতাইয়ের ঘটনায় হওয়া মামলার সংখ্যা বেড়েছে ১৮৫টি। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে ছিনতাইয়ের অনেক ঘটনার ক্ষেত্রে নাগরিকেরা পুলিশের কাছে যান না।

আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে ৪৩২টি ছিনতাইয়ের স্পট চিহ্নিত করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। গত বছরের শেষ চার মাসে ডিএমপির বিশেষ অভিযানে ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ৮৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সব পরিসংখ্যানই নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ তৈরির জন্য যথেষ্ট।

স্বৈরাচারী সরকারের সময় পুলিশকে চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় দমন-পীড়ন ও হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে পুলিশকে জনরোষের মুখে পড়তে হয়েছিল।  পাঁচ মাস পরে এসেও সেই ধাক্কা পুলিশ এখনো সামলাতে পারেনি। পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যেমন মনোবলের ঘাটতি আছে, একই সঙ্গে পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ও যানবাহনের অভাবে তাদের নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ও অপরাধ দমনে পুলিশ পুরোপুরি সক্ষম না হয়ে ওঠার সুযোগই নিচ্ছে অপরাধীরা।

এ বাস্তবতায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ও অপরাধ বন্ধ সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হওয়ার কথা; কিন্তু সেখানে অগ্রাধিকার ও মনোযোগটা থাকছে কি না, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে সম্প্রতি দুটো ঘটনায় পুলিশকে আমরা আগের বেপরোয়া মারমুখী ভূমিকায় দেখতে পেয়েছি। ৭ জানুয়ারি সচিবালয়ের সামনে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দেওয়ার সময় মাটিতে পরে যাওয়া একজন শিক্ষার্থীকে তিন-চারজন মিলে বুট জুতা দিয়ে লাথি দেওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রাইম এশিয়ার শিক্ষার্থী যে দাবি নিয়ে সচিবালয়ের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করেছিল, সেটা হয়তো বোকামি। সেখানে জমায়েত, সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকায় পুলিশের ব্যবস্থা নেওয়াটা স্বাভাবিক; কিন্তু একটা রোগাপটকা ছেলে ধাওয়া খেয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর বুট জুতা দিয়ে লাথি দেওয়ার পেছনে মনস্বত্ব কী? পুলিশের কারও কারও মধ্যে ছাত্রদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ক্ষোভ বা বিদ্বেষ নেই তো?

এর পরের ঘটনা ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি পরপর দুই দিনের। ১৫ জনুয়ারি পাঠ্যবইয়ের গ্রাফিতিতে আদিবাসী শব্দ থাকায় সেটি বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ কর্মসূচিতে জাতীয় পতাকা লাগানো লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি’ নামের একটি উগ্র জাতিবাদী দক্ষিণপন্থী সংগঠনের নেতা–কর্মীরা। পুলিশের সামনেই তারা আদিবাসী শিক্ষার্থীদের রাস্তায় ফেলে নির্মমভাবে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে। গুরুতর আহতদের কয়েকজন জুলাই অভ্যুত্থানের সামনের কাতারের মুখ। নাগরিক কমিটির আন্দোলনকর্মীও তাঁরা। পরে তাঁদের কেউ কেউ মাথায় ভায়োডিন দেওয়া ব্যান্ডেজ লাগিয়ে মিডিয়ার সামনে বক্তব্য দেন। হামলা কারা করেছে, তার যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ, ছবি ও ভিডিও প্রমাণ রয়েছে। তা সত্বেও মাত্র দুজনকে আটক করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে ঘটনার নিন্দা জানিয়ে দুজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানানো হয়।

১৬ জানুয়ারি এ ঘটনার প্রতিবাদে শিক্ষার্থী ও বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের নেতা–কর্মীরা সংক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ব্যানারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচি দেন। তাঁদের মিছিলটি দোয়েল চত্বর পার হয়ে সচিবালয়ের দিকে যেতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। ছত্রভঙ্গ করতে জলকামান ব্যবহার করে, সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে এবং লাঠিপেটা করে। এ সময় পায়ে আঘাত পাওয়া এক নারী শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার সময় পেছন থেকে পুলিশ এসে উদ্ধারকারী শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে। এ ভিডিও ভাইরাল হলে মানুষের মনে ক্ষোভ ও প্রশ্নের জন্ম হয়।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পুলিশের আচরণের নিন্দা জানানো হয়। সরকারের তরফ থেকে নিন্দা জানানোর এ সংস্কৃতিকে আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখতে চায়। কিন্তু জনমনে এই প্রশ্নও তৈরি হয়েছে, পুলিশ কি কারও কারও ক্ষেত্রে ঠান্ডা, আবার কারও কারও প্রতি গরম আচরণ করছে কি না? ঔপনিবেশিক প্রভুরা পুলিশ গঠন করেছিলেন এ দেশের সাধারণ মানুষকে নিপীড়নের অস্ত্র হিসেবে। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন পর্বেও পুলিশের সেই নিপীড়ক ভূমিকায় আমরা দেখেছি। বাংলাদেশ হওয়ার পর যতগুলো সরকার এসেছে, তারা সবাই রাজনৈতিকভাবে কমবেশি পুলিশকে ব্যবহার করেছে। পুলিশ মানেই সরকারের বাহিনী এই ধারা থেকে বের হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বড় একটা স্পিরিট।

ফলে এখানে শুধু নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি জানানোটাই কি যথেষ্ট? এটা কি কৌশল নাকি সত্যিকারের আন্তরিকতা? অভ্যুত্থান এমন এক বাস্তবতা হাজির করেছে, যেখানে সবকিছুই জবাবদিহি আর স্বচ্ছতার পরীক্ষার দাবি জানাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন আর পুলিশের নির্দয় পিটুনিতে রক্তাক্ত হওয়ার ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাসের সমান বয়সী। সে কারণে কেউই আর পুলিশকে নিপীড়ক চরিত্রে দেখতে চায় না। কেউই চায় না পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হোক। ফলে প্রতিটা ঘটনার ন্যায়বিচার হতে হবে। কৌশল নয়, মানুষ চায় তার উপরে ঘটা অন্যায়ের প্রতিকার। সে ক্ষেত্রে সরকার নিপীড়নকারীর বিরুদ্ধে (তা সে পুলিশ হোক আর সভারেন্টির নেতাকর্মী হোক) কি ব্যবস্থা নিচ্ছে সেটাই মূল বিষয়।

পুলিশ, র‍্যাব ও আনসারের পোশাক বদলের চিন্তা করছে সরকার। এখানে দুটি প্রশ্ন জোরেশোরে উঠছে। পোশাক বদলে গেলেই কি ধরন বা চরিত্র বদলে যাবে? আর টাকার সংস্থানে সরকারকে যখন হন্যে হয়ে ফিরতে হচ্ছে সে সময়ে পোশাক বদলের সিদ্ধান্ত বিলাসিতা হবে কি না।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor