আগামী তিন মাস ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এমন নীতি নেবেন, যেখানে তিনি সিরিয়াকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করবেন।
বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে ইরাক ও সিরিয়ায় অনেক বিদেশি খেলোয়াড় আছেন, তাঁদের কারণে অনেক বেশি অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বাশার আল-আসাদের পতনের পর তুরস্কের সেনাবাহিনী তাদের প্রতিবেশী দেশে কী ভূমিকা পালন করবে, সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বড় প্রশ্ন।
ইসরায়েলের নাজেল কমিশন সম্প্রতি তাদের মূল্যায়নে বলেছে, তুরস্ক ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত খুবই বাস্তব। এই প্রতিবেদনের সূত্র ধরেই ইসরায়েলের নেতৃস্থানীয়দের অনেকে তাদের সরকারকে তুরস্কের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্বায়ত্তশাসিত এলাকাটি রোজাভা নামেও পরিচিত। আসাদের পতনের পর তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইপে এরদোয়ানের সামনে রোজাভা অঞ্চলটিতে মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া কুর্দিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
আসাদের পতনের পর এই কুর্দি যোদ্ধারা তুরস্কের সেনাবাহিনী ও তাদের প্রক্সি সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলার শিকার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কুর্দি মিত্ররা যদি তুরস্কের শর্ত মেনে না নেয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে এরদোয়ান প্রশাসন।
এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে তুরস্কের সম্প্রসারণবাদী আচরণ ন্যাটোর অস্তিত্বের ওপর হুমকি তৈরি করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমরা দেখেছি, সিরিয়ায় কয়েকবার তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র বিপজ্জনকভাবে সরাসরি সংঘাতের মুখোমুখি হয়েছিল।
বাইডেনের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটির ৫০০ মিটারের মধ্যে তুরস্কের ড্রোন উড়ে এলে মার্কিন সেনারা সেটিকে গুলি করে ভূপাতিত করে। সেটা ছিল তুরস্কের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সামরিক পদক্ষেপ।
এ ঘটনার পর ওয়াশিংটনের একটি থিঙ্কট্যাংক হোয়াইট হাউসকে ন্যাটো থেকে তুরস্কের সদস্যপদ স্থগিত করার কথা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে পরামর্শ দেয়।
এই দুটি দৃশ্যপট তুরস্কের জন্য তিনটি সমস্যা নিয়ে আসবে। প্রথমত, বেশির ভাগ ন্যাটো সদস্যরাষ্ট্র সম্ভবত সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী একটি মিত্রের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে যোগ দিতে ইচ্ছুক হবে না। এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হতে পারে যদি ইসরায়েল কোনো প্ররোচনা ছাড়াই আক্রমণ করে। ইসরায়েলে নেতানিয়াহু প্রশাসন একটা বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে। দামেস্কের নতুন ইসলামপন্থী সরকার বলছে, তারা ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চায়। যা–ই হোক সেই শান্তির জন্য ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতির স্বার্থে বড় মূল্য দিতে হতে পারে।
সিরিয়া বিভিন্ন অংশে পশ্চিমাপন্থী উপদলগুলোর প্রতিরোধের শক্তি ভেঙে পড়তে পারে। ইসরায়েলের উত্তর সীমানায় নতুন অটোমান সাম্রাজ্যের প্রভাব প্রতিষ্ঠার ঝুঁকিও আছে। মার্কিন–সমর্থিত সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস এবং ট্রাম্প প্রশাসনও কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক সমর্থন ছাড়া মার্কিন মিত্র কুর্দি বাহিনীর পক্ষে তুরস্কের সেনাবাহিনী এবং তুর্কি-মিত্র সিরিয়ান সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর আক্রমণে টিকে থাকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ট্রাম্প প্রশাসনকে এটাও বিবেচনা করবে, তুরস্কের সশস্ত্র বাহিনী এবং তুরস্কের গোয়েন্দারা ইরাক ও সিরিয়ার মার্কিন সেনাবাহিনী ও তার মিত্রদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করে।
সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস আশা করতে পারে, এসব আচরণকে ট্রাম্প প্রশাসন ‘আমেরিকার সামরিক বাহিনীকে আবার মহান করে তোলার’ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখবে।
সেটা হলে, তুরস্ক যদি মার্কিন মিত্রদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রও পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, একটা কার্যকর নীতি তৈরির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের কয়েক মাস লেগে যেতে পারে। এই ফাঁকে তুরস্কের সেনাবাহিনী রোজাভাতে সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়ে কুর্দি বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে পারে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের পক্ষে ইসরায়েলের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া দ্বিতীয় বিকল্প নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, নেতানিয়াহু প্রশাসন এতে কীভাবে সাড়া দেবে।
ইসরায়েল তখন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসকে যথেষ্ট পরিমাণ রাজনৈতিক, সামরিক ও গোয়েন্দা সমর্থন দিতে পারে, যাতে তারা ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত রোভাজার সীমানা বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়।
এ ধরনের ব্যবস্থা সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস সাদরে গ্রহণ করবে। কেননা সমুদ্রে প্রবেশের সুযোগ ছাড়া কুর্দিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন অধরায় থেকে যাবে।
এ ধরনের পদক্ষেপ ইসরায়েলের জন্য অনেক সুযোগ তৈরি করবে। কেননা এতে তুরস্ক ও দামেস্কের মধ্যে ইসরায়েল তার পক্ষের একটি সামরিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
কিন্তু এখানে সমস্যাটি হলো এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ ইসরায়েল নিলে তুরস্কের সঙ্গে ইসরায়েলে সরাসরি সংঘাত বেধে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। আর সে ধরনের কোনো সংঘাত বেধে গেলে তাতে ন্যাটোর অস্তিত্বের ওপর হুমকি তৈরি করবে।
এখানে দুটি দৃশ্যপট বিবেচনা করার আছে। প্রথমে আমরা ধরি নিই, ইসরায়েলের দিক থেকে প্রথম তুরস্কের সেনাবাহিনীর ওপর হামলা করা হলো। এ ক্ষেত্রে তুরস্ক ন্যাটোর আর্টিকেল-৫-কে পুনর্জীবনের আহ্বান জানাবে। এই আর্টিকেল অনুযায়ী সদস্য কোনো দেশ আক্রান্ত হলে ন্যাটোর অন্য সব সদস্য সেই দেশটিকে রক্ষা করবে।
দ্বিতীয় দৃশ্যপটটা এমন হতে পারে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর ওপর তুরস্ক সরাসরি হামলা করল। সে ক্ষেত্রে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বলবে, তুরস্ককে ন্যাটো থেকে যেন বাদ দেওয়া হয়।
এই দুটি দৃশ্যপট তুরস্কের জন্য তিনটি সমস্যা নিয়ে আসবে। প্রথমত, বেশির ভাগ ন্যাটো সদস্যরাষ্ট্র সম্ভবত সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী একটি মিত্রের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে যোগ দিতে ইচ্ছুক হবে না। এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হতে পারে যদি ইসরায়েল কোনো প্ররোচনা ছাড়াই আক্রমণ করে।
দ্বিতীয়ত, তুরস্ককে ন্যাটোর সদস্যপদে স্থগিতাদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে সদস্যদেশগুলোর শক্তিশালী সমর্থন থাকবে।
তৃতীয়ত, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার প্রশ্নে ওয়াশিংটনের শক্তিশালী সমর্থন থাকবে। যদিও মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো চায় না তুরস্কের সঙ্গে ইসরায়েল সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ুক। সংঘাত বেধে গেলে ইসরায়েলকে বড়ভাবে সমর্থন দেবে যুক্তরাষ্ট্র।
এসব কারণে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ানের উচিত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইসরায়েলের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা কমিয়ে আনার চেষ্টা করা।
Publisher & Editor