অপহৃত চারজন ইসরায়েলি নারী সৈনিক গত শনিবার ঘরে ফিরেছেন। সেই সঙ্গে পুরো দেশও যেন নিজের মধ্যে ফিরে গেছে। ডুবে গেছে আত্মপ্রেম আর আত্ম–উচ্ছ্বাসের মধ্যে, একই সঙ্গে বিভ্রান্তিকর ঐক্য আর মিথ্যা উদ্যাপনের ভেতর, যেখানে স্বশ্রেষ্ঠতার দাবি, উগ্রজাতীয়তাবাদ আর উসকানিবোধ সুস্পষ্ট।
অপহৃতদের পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের ব্যক্তিগত উচ্ছ্বাস যেন এক লাগামছাড়া জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। আমরা অবশ্য এতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি অনেক দিন ধরে। কিন্তু শনিবারের ঘটনা আমাদের মানে ইসরায়েলিদের ভেতরে অতিমাত্রায় অভব্যতা আর মিথ্যার সঞ্চারণ ঘটিয়েছে।
এক বছরের বেশি এক ভয়াবহ ও অপ্রীতিকর সময় কাটানোর পর উচ্ছ্বসিত হতে পারার প্রয়োজনীয়তাটা বোঝা যায়। হোক না তা অল্প কিছু সময়ের জন্য, এমনকি নিজেরা গর্বিত ও অভিনন্দিত হওয়ার জন্য। কিন্তু শনিবারের উচ্ছ্বাসের ঢেউ যেন সবকিছু ছাপিয়ে গিয়েছিল।
নারী সৈনিকেরা জীবিত ফিরে আসায় স্বাভাবিকভাবে আসা খুশির জোয়ার যেন যথেষ্ট ছিল না। আর তাই আমরা এই খুশিকে মিথ্যার আচরণে ঢেকে দিলাম!
এক সর্বব্যাপী খুশির দিনে অপপ্রচার ও উসকানিমূলক আচরণ এটাই প্রমাণ করল যে কারিনা, ন্যামা, ড্যানিয়েলা ও লিরিদেরকে অশ্রুসিক্তভাবে আলিঙ্গন ও চুম্বনের আড়ালে খারাপ কিছু রয়েছে।
আসলে শনিবার আমরা মিথ্যাচার করেছি। হামাসের ওপর আমাদের পূর্ণ বিজয় অর্জনের মিথ্যা দাবি ধসে পড়েছে। একটি সংগঠিত, সুশৃঙ্খল ও সশস্ত্র হামাসকে আমরা সেদিন দেখেছি, গাজায় যার সার্বভৌমত্ব পরিষ্কার, দেখেছি মুক্তি উদ্যাপনের মঞ্চে। তাই শনিবার যদি কোনো বিজয় অর্জিত হয়ে থাকে, তাহলে তা হয়েছে এই সংগঠনের, যারা ছাই থেকে পুনর্জন্ম লাভ করেছে, ১৬ মাস ধরে চলা বিমান হামলা, হত্যাযজ্ঞ ও তাণ্ডবলীলার মাধ্যমে সৃষ্ট ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। তারা এখনো জীবন্ত এবং প্রায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
আমাদের বলা হয়েছিল যে এই সংগঠন নাৎসিদের মতো, নৃশংস, ও দানবীয়। শুধু রাস্তাঘাটের আলাপচারিতায় নয়, বরং সবচেয়ে বোদ্ধা টেলিভিশন উপস্থাপকেরাও এসব বলেছেন। আর তাঁরাই আবার ইসরায়েলের কণ্ঠস্বর, সত্যি ঘটনার চিত্রকর! অথচ বাস্তবতা তো এসব বিবৃতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়।
টিভি উপস্থাপকদের মধ্যে তো একটা প্রতিযোগিতা লেগেছিল যে তাঁরা হামাসকে কে কতটা হীনভাবে তাঁদের স্টুডিওতে তুলে ধরতে পারেন। কিন্তু জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হওয়া নারীদের মধ্যে ফুটে ওঠা উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনার দৃশ্য তো এসব উপস্থাপকদের এত দিনকার প্রচার করা দাবির বিপরীত। মুক্ত জিম্মিরা সটান হয়ে দাঁড়িয়েছেন, সহজাত হাসি হেসেছেন, অপহরণকারীরা তাঁদের যে স্মারক ব্যাগ দিয়েছে, তা হাতে রেখেছেন। মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনি বন্দীদের সঙ্গে তাঁদের পার্থক্য তো সুস্পষ্ট, অন্তত যাঁরা একেবারে বিপর্যস্ত সেই ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে।
কেউ হয়তো এটা মনেই করতে পারেন যে আমরা হয়তো মুক্ত হওয়া ইসরায়েলি জিম্মিদের দুরবস্থা এখনো দেখিনি। অবশ্যই মুক্ত হওয়া নারী সৈনিকেরা যে ভোগান্তির মধ্য দিয়ে গেছে, তাকে হালকা করে দেখার অবকাশ নেই। কিন্তু নাৎসিদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া মানুষদের এ রকম দেখায় না।
আমরা তো নিজেদের চমৎকার মানুষ মনে করি, যাঁদের জীবন পাপমুক্ত। আমরা আমাদের জিম্মিদের মুক্ত করার জন্য যেকোনো মূল্য দিতেও প্রস্তুত। এই আত্মগরিমার বিপরীতে অপ্রিয় সত্যিটা হলো, শনিবারের এই উদ্যাপন আরও আট মাস আগেই হতে পারত। আর তা সম্ভবত ৭ অক্টোবরের পরপরই যেকোনো দিন। তাঁরা মৃত্যুকে পাপমুক্ত করেছে আর আমরা জীবনকে পাপমুক্ত করেছি বলে যে দাবি তোলা হয়েছে, তা সম্ভবত জঘন্যতম এক মিথ্যাচার।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর কারণে ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, যার বেশির ভাগই নিরীহ। এরপর তো আর এই পাপমুক্তির দাবি চলে না। নিজের সন্তানদের জন্য ইসরায়েল খুব কমই জীবনকে পাপমুক্ত করেছে। রণক্ষেত্রে ৮০০ শতাধিক সৈনিক প্রাণ দিয়েছে বলে দাবি করা হয়, যা সন্দেহযুক্ত। আর এই প্রাণহানি কোনো মানুষের জীবনের পাপমুক্তি ঘটায়নি।
একজন ফিলিস্তিনির জীবনের মতো ইসরায়েলে আর কোনো কিছুই এত সস্তা নয়, তা যুদ্ধক্ষেত্রেই হোক বা নিত্যদিনেই হোক। গাজায় ইসরায়েলি সৈনিক ও পাইলটরা জীবনের প্রতি কী মূল্য দিয়েছে, তা জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে। যারা গাজায় ধারাবাহিকভাবে হাসপাতালগুলো ধ্বংস করেছে, অ্যাম্বুলেন্সগুলোর ওপর গুলি চালিয়েছে এবং জরুরি চিকিৎসাসেবা দেওয়া কয়েক শ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, তারা জীবনকে পাপমুক্ত করেনি, বরং জীবনকে নিংড়ে শেষ করেছে।
শনিবার সংহতিকেও মিথ্যার আচরণে মোড়া হয়েছে। একটি গাড়িতে হলুদ ফিতা আটকে দেওয়ার নাম সংহতি নয়। ইসরায়েলিরা কি একজন আরেকজনকে নিয়ে ভাবে? রাস্তাঘাটে বা মহাসড়কে যান, মানুষজনের দীর্ঘ সারিতে গিয়ে দাঁড়ান কিংবা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে কাগজপত্রে গণহারে জালিয়াতির বিষয়টি চিন্তা করুন।
এটা তো কোনো সংহতি নয়, নয় পরস্পরের প্রতি যত্নশীল হওয়া, বরং এটা হলো ক্ষমতাসীনদের শাসন, যেখানে প্রত্যেকেই নিজেরা নিজেদের জন্য। যত বড় বড় বুলি আওড়ানো হোক না কেন, এই বাস্তব সত্যকে আড়াল করা যাবে না।
শনিবার ইসরায়েল চারজন জিম্মির প্রত্যাবর্তনকে উদ্যাপন করেছে। এই খুশি সত্যিকারের, যা সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু এর রূপসজ্জাটা ছিল নিম্নমানের, সাজসরঞ্জাম ছিল সস্তা দরের আর অভ্যবতা তো বলিউডকে মনে করিয়ে দেয়। আরও কিছু সত্য আর আরও কম মিথ্যার উপস্থিতি থাকলে হয়তোবা এই উদ্যাপন অধিকতর পূর্ণ হতো।
Publisher & Editor