ওড়না ছাড়া কনের সাজ যেন অপূর্ণ। কেউ কেনা ওড়না কোনো সংযোজন–বিয়োজন না করেই পরেন, কেউ আবার তাতে লেইস–ফিতা বা নকশা বসান নিজের মতো করে।
বিয়ের দিন কনের সাজপোশাকে মুখ্য ভূমিকায় থাকে শাড়ি। শাড়ির জায়গায় অনেকে এখন অবশ্য লেহেঙ্গাও পরছেন। মূল এই পোশাকটিকে বিশেষ করে তোলে আরও কিছু অনুষঙ্গ। ব্লাউজ, গয়না আর ওড়না। গত ৫ বছরের বিয়ের ওড়নার ট্রেন্ড সেট করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে বলিউড অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোনের বিয়ের ওড়না। পুরোনো দিনের জরির পাড়ের সেই ওড়নার বাইরে আরেকটা ট্রেন্ডও দেখা যায়, ওড়নায় কোনো কবিতা বা গানের লাইন বা বিশেষ কোনো লেখা। বর বা কনের নাম লেখা ওড়নার ধারাও চোখে পড়ছে। এ বছরের কনের ওড়নাতেও নতুন কয়েকটি বিষয় চোখে পড়ছে। এই ধারাগুলোও বিদেশ থেকে এসেছে, সন্দেহ নেই, তবে সেগুলোকেই আমাদের মতো করে দেশীয় করে নিচ্ছেন কনেরা।
লম্বা থেকে লম্বাতর
বিয়ের ওড়নায় সব সময় যে বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে, সেটা হলো, মাথার ওপর কিছুটা অংশ ঢেকে কোমর পর্যন্ত নামিয়ে দেওয়া। আর ক্লিপ দিয়ে আটকানো হয় বলে ওড়নাটা যেন হালকা আর বেশি বড় না হয়, সেদিকেও লক্ষ থাকে। ২০২৩–এ শুরু হয়ে ২০২৪–এ এসে লম্বা ওড়নার জনপ্রিয়তা বেড়েছে, যা এখনো চলছে। এই লম্বার শুরু আছে শেষ নেই। ব্রিটিশ রাজবধূদের বিয়ের ভেইলের মতো লম্বা না হলেও মাটি ছুঁয়ে আরও কিছু দূর গড়াচ্ছে দেশি কনেদের ওড়না। আড়াই গজের বদলে কনের ওড়না এখন ১১-১২ গজ পর্যন্তও লম্বা হচ্ছে বলে জানালেন অদ্রিয়ানা এক্সক্লুসিভের স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনার নাজিয়া হাসান। কখনো কখনো সেটা শাড়ির থেকেও লম্বা হয়। ছবি তোলার সময় ওড়না দিয়ে অনেকেই এখন চেহারা ঢেকে দিচ্ছেন স্টাইল করে। সে ক্ষেত্রে ওড়নাটা মসলিন বা নেটের হচ্ছে, না হলে ছবি তোলার সময় চেহারা দেখানো কঠিন হয়ে ওঠে।
দুই–তিন রঙের শেড
বিয়ের ওড়নায় দুই থেকে তিন রঙের শেডও আনা হচ্ছে, জানালেন ডিজাইনার সাফিয়া সাথী। শাড়ি বা লেহেঙ্গার সঙ্গে মিল রেখেই বাছা হচ্ছে শেড। অনেকে হয়তো একই রঙের দুই–তিনটি শেড চাইছেন। আবার কেউ চাইছেন একাধিক রঙের শেড। ওড়নার এই শেডের কারণেই কনের সাজে কিছুটা ভিন্নতা চলে আসছে। বিষয়টি হয়তো ছোট। কিন্তু এই ছোট বিষয়ই কনের ওড়নায় নিয়ে আসছে নতুনত্ব।
মাথার ওড়নাটি শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে একই রঙের নিলে ভালো। তাহলে পুরো সাজে একটি টোন থাকে। অনেক বেশি কিছু করতে গেলে নকশার ভিড়ে কনেই হারিয়ে যেতে পারেন। ওড়নায় একাধিক শেড থাকলে শাড়ি বা লেহেঙ্গার মধ্যে খুব বেশি রং না রাখাই ভালো।
এক, না একাধিক
কনের সাজে এখন ব্যবহার হচ্ছে একাধিক ওড়না। একটি মাথায় থাকছে আরেকটি হাতে বা কাঁধে। লেহেঙ্গার সঙ্গে এই ধারা আগেও অনেকে করেছেন। কিন্তু শাড়ির সঙ্গে দুটি ওড়নার চল এই বছরই দেখা যাচ্ছে। নাজিয়া হাসান জানালেন, এতে পুরো সাজে খুব সহজেই চলে আসছে জমকালো ভাব। ছবি তোলার সময়ও নানা ভঙ্গিতে এই বাড়তি ওড়না ব্যবহার করছেন কনেরা। এ ক্ষেত্রে ওড়না দুটি এক উপকরণের হতে পারে, আবার ভিন্ন উপকরণেরও হতে পারে। পুরো বিষয়টিই নির্ভর করবে কনের পছন্দ আর আরামের ওপর।
উপকরণ আর কাজ
কনের ওড়নায় মসলিন ও নেট কাপড়ের ব্যবহার এখনো জনপ্রিয়। এ দুটি উপকরণে তৈরি ওড়নাই বেশি চলছে। পাশাপাশি আছে আমাদের নিজস্ব জামদানি আর বেনারসির ওড়না। বিডসের কাজ, ট্যাসেল লাগানো, জারদৌসির কাজ, খাড়ির কাজ করা হচ্ছে। মনে হচ্ছে চিকন পাড়ের ওড়নাই চলবে আগামী কয়েক বছর। অনেকে সোজার বদলে উঁচু-নিচু বা ঢেউখেলানো পাড় বেছে নিচ্ছেন। হলুদের জন্য অনেকে ফুলের ওড়নাও বেছে নিচ্ছেন, তবে সেটার সংখ্যা কম। ছোট ছোট কাচ দিয়ে বানানো ওড়নাও একদম ভিন্নধর্মী লুক নিয়ে আসে, এটা অনেকটা ফুলের ওড়নার মতো করেই বানানো যায়। লাল রঙের ওড়নার চাহিদা এখনো বেশি। পাশাপাশি আছে মেরুন, সোনালি রং।
ধারা নাকি ঐতিহ্য
নতুন ধারার বাইরে পুরোনো স্টাইলও চোখে পড়ে। অনেক সময়ই কনে দ্বিধায় ভোগেন চলতি ধারার সঙ্গে থাকবেন, নাকি নিজের পছন্দে থাকবেন। এটা বললাম কারণ, অনেকেই মা বা দাদির বিয়ের ওড়না নতুনভাবে বানিয়ে বিয়ের দিন পরতে চান। কোনো নকশাই কখনো পুরোনো হয় না। অনেকে ঐতিহ্য পছন্দ করেন। পুরোনো ওড়না থেকে ব্যবহারযোগ্য অংশ নিয়ে পুনর্ব্যবহারও করছেন অনেকে। এখন চিকন পাড়ের চল থাকলেও অনেকে মোটা পাড় চাইছেন। কয়েকটি পাড় পাশাপাশি বসিয়ে বানানো হচ্ছে মোটা পাড়।
সাফিয়া সাথী বলেন, কনে যখন নিজের পছন্দে কিছু বানান, সেটা সব সময়ই চলতি ধারা। একটু ভেবে দেখলে, ব্যক্তিগত পছন্দ থেকে সব সময়ই কোনো না কোনো নতুনত্ব চলে আসে কনের সাজে। আপনার ব্যতিক্রমী পছন্দই হয়তো আরেকজনের জন্য প্রেরণা হয়ে উঠবে। তবে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, এমন ওড়নার বাইরে নিজের পছন্দের কিছু বানাতে চাইলে হাতে অন্তত ৩০ দিন সময় নিয়ে ফরমাশ দিন। বিয়ের মৌসুমে এমনিতেই ব্যস্ত থাকেন কারিগরেরা।
মোটিফ কী
মোটিফে নতুনত্ব কী এসেছে? জিজ্ঞাসা করতেই ডিজাইনার নাজিয়া হাসান জানালেন, প্রকৃতিকে বিয়ের ওড়নায় উপস্থাপন করার একটি ধারা এখন চলছে। ওড়নাতে একদম নতুন নকশা আনতে চাইলে হরিণ, বাঘ, হাতি, পাখি, গাছের নকশা ফুটিয়ে তুলতে পারেন। এ ধরনের ওড়না পরেও ব্যবহার করতে পারবেন। হাতে সময় থাকলে জারদৌসি কাজের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে পারেন নকশা। না হলে খাড়ির মাধ্যমেও এ ধরনের মোটিফ তুলে আনতে পারবেন।
বাজারে গিয়ে যা পাওয়া যাচ্ছে, সেটাই কিনে ফেলার চেয়ে ভিন্ন কিছু করাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন কনেরা। ডিজাইনাররা জানালেন, নিজের বিশেষ দিনটাকে আরও বিশেষ করতে বিয়ের দিন নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে চান কনেরা। আর সেই বিশেষ দিনের ওড়নাটা না হয় একটু ভিন্ন রকমই হলো। দীর্ঘদিন পর আলমারি খুলে যে ওড়না হাতে নিতেই মনে পড়বে বিয়ের দিনটার কথা। সেটাকে একটু স্পেশাল করলে ক্ষতি কী!
Publisher & Editor