যেন বিশ্বে আরও বেশি রক্তপাত দরকার! বিশ্বব্যবস্থাকে ভেঙেচুরে দেওয়ার জন্য আরেকটি বড় যুদ্ধ দরজায় কড়া নাড়ছে। এ সপ্তাহে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর (ডিআরসি) পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় শহরটিতে বিদ্রোহীরা ভয়াবহ হামলা চালিয়ে দখল করে নিয়েছেন। পাশের প্রতিবেশী রুয়ান্ডার সেনারা বিদ্রোহীদের মদদ দিচ্ছেন। এ ঘটনায় যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, আফ্রিকার বাইরেও তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে।
এ ঘটনা পশ্চিমা সরকারগুলোর আত্মতুষ্টিকেও প্রকাশ করে। কঙ্গোর অনেক লোক এ সংকট সৃষ্টির পেছনে পশ্চিমাদের দায়ী করছেন। এম-২৩ নামে পরিচিত বিদ্রোহীদের কর্মকাণ্ডে গতি পায় ২০২১ সাল থেকে। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় এম-২৩ আগ্নেয়গিরির পাদদেশে অবস্থিত গোমা শহরের চারপাশে বিশাল একটা ভূখণ্ড দখলে নিতে শুরু করে। অঞ্চলটি রুয়ান্ডা সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত।
এ সপ্তাহে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস রুয়ান্ডাকে এম-২৩-কে সমর্থন দেওয়া বন্ধ ও কঙ্গোর ভূমি থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এ সংঘাত জাতিসংঘের সহযোগিতায় টিকে থাকা লাখ লাখ বেসামরিক মানুষের জন্য বিধ্বংসী পরিণতি ডেকে আনবে। ডিআরসির রাজধানী কিনশাসায় ক্ষুব্ধ প্রতিবাদকারীরা আগুন জ্বালিয়ে দেন এবং রুয়ান্ডা, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে আক্রমণ করেন।
তিন দশকের বেশি সময় ধরে রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামের পৃষ্ঠপোষতায় কঙ্গোয় বেশ কয়েকবার বিদ্রোহ হয়েছে। এম-২৩-এর বিদ্রোহটি সর্বশেষ ঘটনা। অনেকগুলো পশ্চিমা দেশের প্রিয়পাত্র কাগামে। ১৯৯৪ সালের গণহত্যার প্রেক্ষাপটে তিনি ক্ষমতায় বসেন। অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের কমান্ডার হিসেবে তিনি লড়াই করেছিলেন।
কাগামে দীর্ঘদিন ধরে যুক্তি দিয়ে আসছেন, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে তাঁর হস্তক্ষেপের কারণ হচ্ছে, তিনি তাঁর জাতিগত তুতসি গোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে চান। কাগামে ক্ষমতায় বসার পর থেকে রুয়ান্ডা ও কঙ্গোর মধ্যে বেশ কয়েকবার যুদ্ধ হয়েছে। এর কারণ, জাতিগত বৈরিতার চেয়েও বেশি কিছু। রুয়ান্ডার মদদপুষ্ঠ বিদ্রোহীরা ১৯৯০-এর দশকে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলের বেশ কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন। সেখান থেকে তারা বিশাল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করতেন।
২০০২ সালে একটি জাতীয় চুক্তি হওয়ার পর কঙ্গোলিজ তুতসি সামরিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো জাতিসংঘের সর্ববৃহৎ শান্তি রক্ষা মিশনের আওতায় আসে। ২০০৪ ও ২০০৮ সালে এদের কিছু অংশ আরও বেশি সামরিক সুবিধা এবং ক্ষমতা ও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের সুযোগ দাবিতে পুনরায় বিদ্রোহ করে।
পশ্চিমা কর্মকর্তাদের এখন তাঁদের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে এম-২৩–কে রাজনৈতিক মীমাংসায় বসতে বাধ্য করতে হবে। সেটা করতে ব্যর্থ হলে কঙ্গোয় ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হতে পারে, যেটা ১৯৯০ সালের মতো অনেকগুলো আঞ্চলিকি খেলোয়াড়কে ডেকে আনতে পারে। মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোয় সামরিক অভ্যুত্থান ও রাশিয়ার হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করতে পারে। ২০১২ সালে বিদ্রোহের পুনরাবৃত্তি হয় এবং বিদ্রোহীরা এম-২৩ গঠন করেন। প্রায় কোনো ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই এবার তাঁরা গোমার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছেন।
এই যে যুদ্ধের চক্র, এর পুরোটা সময় পশ্চিমা কর্মকতারা রুয়ান্ডার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। অথচ এই বিদ্রোহীদের রুয়ান্ডা যে মদদ দিয়ে যাচ্ছে, তার যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে। সহযোগিতা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে কাগামে দাতাদেরকে মুগ্ধ করেছিলেন। গণহত্যা–পরবর্তী রুয়ান্ডা পুনর্গঠনের জন্য পশ্চিমা বন্ধুদের কাছে রুয়ান্ডা একটি সফলতার গল্প।
কেবল ২০১২ সালে যখন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর বিদ্রোহীদের মদদ দেওয়ার ক্ষেত্রে রুয়ান্ডার বাড়াবাড়ি রকম সম্পৃক্ততা আছে, তখনই কেবল সাময়িকভাবে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা বন্ধ রাখে। বর্তমানে রুয়ান্ডার বাজেটের তিন ভাগের এক ভাগ আসে দাতাদেশগুলো থেকে।
২০১৯ সালে ডেমোক্রেটিক অব কঙ্গোর ক্ষমতায় প্রেসিডেন্ট ফেলিক শিসেকেদি ক্ষমতায় আসার পর তিনি তাঁর দেশের পূর্বাঞ্চলে থাকা রুয়ান্ডার বিদ্রোহীদের আক্রমণ করার জন্য রুয়ান্ডার সেনাবাহিনীকে আমন্ত্রণ জানান। হুতি বিদ্রোহীদের কমান্ডারদের মধ্যে এমন কয়েকজন আছেন, যাঁরা ১৯৯৪ সালের গণহত্যায় অংশ নিয়েছিলেন।
এই অস্থিতিশীল পরিস্তিতির সুযোগে এম-২৩ বিদ্রোহীরা কঙ্গোর আগ্নেয়গিরিগুলোর আশপাশে অবস্থান নেন এবং বাইরের সমর্থন খুঁজতে শুরু করেন। ২০২১ সালের পর থেকেই এম-২৩ তাদের তৎপরতা বাড়ায়। সে সময় গোষ্ঠীটির কিছু সদস্যকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় আত্মীকৃত করার ব্যাপারে সংলাপ ভেস্তে যায়।
রুয়ান্ডা তখন পশ্চিমা মিত্রদের কাছে আরও বেশি মূল্যবান হয়ে উঠেছিল। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে মোজাম্বিকের উত্তরাঞ্চলে হাজার হাজার রুয়ান্ডান সেনা মোতায়েন করা হয়। ওই অঞ্চলে সে সময় ইসলামিক স্টেটের সদস্যরা ঘাঁটি গেড়েছিলেন। এর পাশেই ফ্রান্সের জ্বালানি খাতের বিশাল কোম্পানি টোটালএনার্জিসের গ্যাসক্ষেত্রে রয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন রুয়ান্ডাকে তাদের অভিযানের জন্য অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিয়েছিল। রুয়ান্ডার সঙ্গে বেলজিয়ামেরও বড় জ্বালানি চুক্তি রয়েছে। অধিকারকর্মীদের অভিযোগ হলো, পশ্চিমাদের সঙ্গে খনিজ ও জ্বালানি চুক্তির মাধ্যমে রুয়ান্ডা কঙ্গোতে তাদের যুদ্ধের বৈধতা তৈরি করেছে।
গত সপ্তাহের ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওসহ পশ্চিমা সরকারগুলো কাগামেকে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। কিন্তু তাদের আহ্বান শেষ পর্যন্তা কাগামে কতটা শুনবেন, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কেননা, এখন তিনি তুরস্ক ও কাতারের মতো দেশগুলোকে বিকল্প বন্ধু ভাবছেন।
এদিকে কঙ্গো সরকার বিচিত্র ধরনের সামরিক মিত্রতা গড়ে তুলেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, তানজানিয়াতে তাদের সেনা পাঠিয়েছে। রুয়ান্ডার হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে তারা যুদ্ধ করছে। পূর্ব ইউরোপে কঙ্গো সেনাবাহিনীর সমর্থিত শত শত ভাড়াটে সেনা আত্মসমর্পণ করেছেন। পশ্চিমা কিছু কূটনীতিক এখন এই ভয় পাচ্ছেন যে কঙ্গোর সেনাবাহিনী এখন বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য রাশিয়ার সহযোগিতা চাইবে কি না।
পশ্চিমা কর্মকর্তাদের এখন তাঁদের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে এম-২৩–কে রাজনৈতিক মীমাংসায় বসতে বাধ্য করতে হবে। সেটা করতে ব্যর্থ হলে কঙ্গোয় ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হতে পারে, যেটা ১৯৯০ সালের মতো অনেকগুলো আঞ্চলিকি খেলোয়াড়কে ডেকে আনতে পারে। মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোয় সামরিক অভ্যুত্থান ও রাশিয়ার হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করতে পারে।
Publisher & Editor