বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ফুটবলারদের বিদ্রোহ: স্পেনের বিশ্বকাপজয়ী দলের সঙ্গে যেভাবে মিলল বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০০:৪৭, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ১১

দুই দশকের সম্পর্ক ছিন্ন করে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছেড়ে ধারে অ্যাস্টন ভিলায় নাম লিখিয়েছেন মার্কাস রাশফোর্ড। এটি একটি সাধারণ খবর হলেও এর পেছনের বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। ওল্ড ট্রাফোর্ডকে ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলা এই ইংলিশ ফুটবলারের ‘অপরাধ’ তিনি কোচের মন জয় করতে পারেননি। তা–ও আবার এমন কোচের, যিনি দলে এসেছেন তিন মাস আগে এবং নিজেই এখনো দলে থিতু হতে পারেননি। গত নভেম্বরে দায়িত্ব নেওয়া এই পর্তুগিজ কোচের অধীন ১৯ ম্যাচ খেলে ৮টিতেই হেরেছে ইউনাইটেড। জিতেছে ৮টিতে এবং ড্র করেছে ৩টিতে।

বর্তমানে প্রিমিয়ার লিগের ১৩ নম্বরে থাকা ইউনাইটেডের কোচ হিসেবে আমোরিমের নিজের জায়গাই এখনো নড়বড়ে। ফুটবলে কোচদের ‘দুর্ভাগ্য’কে বিবেচনায় নিলে ব্যর্থতার দায় নিয়ে যেকোনো মুহূর্তে সরে যেতে হতে পারে কোচকে। কিন্তু এরপরও যতক্ষণ দায়িত্বে আছেন, তিনিই দলের সর্বেসর্বা। ফলে কোচ হিসেবে তাঁর সিদ্ধান্তই নিরঙ্কুশ। আর সেই সিদ্ধান্তেরই ‘বলি’ হলেন রাশফোর্ড।

রাশফোর্ড সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত হলেও ফুটবলে কোচের অপছন্দের তালিকায় থাকার কারণে ফুটবলারের ক্যারিয়ারের ভাগ্যবদল হওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। আবার কোচের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণেও ক্যারিয়ারের গতিপথ বদলেছে অনেক খেলোয়াড়ের। এই ইউনাইটেডেরই সাবেক কোচ এরিক টেন হাগের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে একপর্যায়ে ক্লাব ছাড়তে হয় কিংবদন্তি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে। এমনকি নামটা রোনালদো হওয়ার পরও ক্লাবের সমর্থনের নিক্তি হেলে ছিল কোচের দিকেই। যে কারণে বিদ্রোহ করেও সুবিধা করতে পারেননি ‘সিআর সেভেন’। কোচ নয়, বিদায় নিতে হয়েছিল তাঁকেই।

একই ঘটনা ঘটেছিল আর্জেন্টাইন তারকা হুয়ান রিকুয়েলমের ক্ষেত্রেও। লিওনেল মেসির উত্থানের পূর্বে রিকুয়েলমেকে ভাবা হচ্ছিল ডিয়েগো ম্যারাডোনা–পরবর্তী সময়ে আর্জেন্টিনার ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার। মুগ্ধতা ছড়ানোর মতো সবকিছুই মজুত ছিল তাঁর পায়ে।

কিন্তু সেই রিকুয়েলমে ডানা মেলতে পারলেন না কোচ–সংক্রান্ত মন্দ-ভাগ্যের কারণে। প্রথমে মার্সেলো বিয়েলসা এবং পরে ম্যারাডোনার সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারায় অকালেই আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় জানাতে হয় তাঁকে। আর্জেন্টিনা সমর্থকদের কাছে রিকুয়েলমে এখনো আক্ষেপের নাম হয়ে আছেন।

ওপরের যে দৃষ্টান্তগুলো, সবই মূলত কোচের সঙ্গে ফুটবলারের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের ঘটনা, যেখানে শেষ পর্যন্ত ‘জিতেছেন’ কোচই। তবে দলীয়ভাবেও কোচের সঙ্গে খেলোয়াড়দের বিরোধে জড়ানোর উদাহরণ আছে। বর্তমানে যেমনটা ঘটছে বাংলাদেশের ফুটবলে। তবে বাংলাদেশের নারী ফুটবলে দৃশ্যপট বোঝার আগে সাম্প্রতিক সময়ে তেমনই আরেকটি আলোচিত ঘটনা জেনে নেওয়া যাক।

যে ঘটনা ঘটেছিল ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে। সেবার কোনো গোল না খেয়ে টানা ৮ ম্যাচ জিতে বিশ্বকাপ নিশ্চিত করে রীতিমতো উড়ছিল স্পেন নারী দল। কিন্তু এরপরই বাধে বিপত্তি। স্পেন নারী ফুটবল দলের ১৫ ফুটবলার কোচ হোর্হে ভিলদার বিরুদ্ধে কর্তৃত্বমূলক আচরণের অভিযোগ এনে বিদ্রোহ করে বসেন। মাঠে দলকে জয়ের পথে রাখলেও ভিলদা ড্রেসিংরুমের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।

স্প্যানিশ এই কোচ কিন্তু এরপরও হার মেনে পিছিয়ে যাননি। তিনি নিজে যেমন পদত্যাগ করেননি, তেমনি খেলোয়াড়দের ফেরানোর চেষ্টাও করেননি। বরং বিদ্রোহী খেলোয়াড়দের ছাড়াই দলকে এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সে সময় স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনও যথারীতি সমর্থন দেয় ভিলদাকে।

এরপর নানা নাটকীয়তা শেষে বাদ পড়া সেই ১৫ জন থেকে ৩ জন ফিরে এসে অংশ নেন ২০২৩ সালের বিশ্বকাপে। সেই তিন ফুটবলার ছিলেন আইতানা বোনমাতি, মারিওনা কালদেন্তেই ও ওনা বাটলে। যাঁদের মধ্যে স্পেনের বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক বোনমাতি বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হওয়ার পাশাপাশি জিতেছেন ব্যালন ডি’অরও।

স্পেনের মতো কোচের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের উত্তাল সময় পার করছে বাংলাদেশের ফুটবলও। বাংলাদেশকে সাফে টানা দুবার শিরোপা এনে দেওয়া নারী ফুটবল দল বিদ্রোহ করেছে কোচ পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে ১৮ খেলোয়াড় স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন, হয় কোচ থাকবেন, নয়তো তাঁরা থাকবেন। কোনো অবস্থাতেই বাটলারের অধীন খেলবেন না তাঁরা। বাটলারের বিরুদ্ধে কর্তৃত্ববাদী আচরণের পাশাপাশি বর্ণবাদের অভিযোগও এনেছেন সাবিনা-মাসুরারা।

এরই মধ্যে বাটলারের অধীন অনুশীলন করাও বন্ধ করে দিয়েছেন তাঁরা। পুরো বিষয়টা সামাল দিতে গিয়ে এখন বেশ বেগ পেতে হচ্ছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে (বাফুফে)। তাদের অবস্থা এখন ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি’। একদিকে সাফজয়ী নারী দল এবং আরেক দিকে সাফজয়ী ও নিজেদের ‘গুড বুকে’ থাকা কোচ। এমন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া নিশ্চিতভাবেই সহজ নয়।

বাংলাদেশকে সাফে টানা দুবার শিরোপা এনে দেওয়া নারী ফুটবল দল বিদ্রোহ করেছে কোচ পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে।
বিশ্ব ফুটবলের দৃষ্টান্তগুলো পর্যালোচনা করলে অবশ্য বাফুফের অবস্থান বাটলারের দিকেই থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটটা এতটা সরলও নয়। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের সাফল্যের অন্যতম অগ্রদূত নারী ফুটবলাররা। লম্বা সময়, শ্রম ও পুঁজি লগ্নি করেই এই খেলোয়াড়দের তৈরি করা হয়েছে। যার প্রতিদানও খেলোয়াড়েরা দিয়েছেন।

ফলে এই খেলোয়াড়দের হারানো মানে নারী ফুটবলের অগ্রগতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগা। অন্যদিকে দলীয় শৃঙ্খলা ও কাঠামো সমুন্নত রাখাও সমান জরুরি। পুরো বিষয়টা তাই সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলা করা জরুরি। নয়তো দেশের ফুটবলে নেমে আসতে পারে স্থবিরতা, যা নিশ্চিতভাবেই ভালো ফল বয়ে আনবে না।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor