বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের এই ‘বাড়াবাড়ি’ কেন

প্রকাশিত: ০১:০৮, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ১১

তিতুমীর সরকারি কলেজের আন্দোলনকারী ‘কতিপয়’ শিক্ষার্থী কী শুরু করেছেন? কতিপয় বলার কারণ, এ কলেজের শিক্ষার্থী প্রায় অর্ধলক্ষ। সেই অর্থে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ‘কতিপয়’ই বলতে হয়।

এখন একটা কলেজকে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ করার দাবিতে তাঁরা যা যা করছেন, তা কি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পড়ে না? তাঁরা কি বুঝছেন না শুধু রাজধানীবাসীই নন, গোটা দেশের মানুষ তাঁদের ওপর বিরক্ত হচ্ছেন? তাঁরা কি দেখছেন না, তাঁদের দাবি নিয়ে ফেসবুকে যা যা তাঁরা প্রচার করছেন, সেখানে ‘হা হা’ রিঅ্যাক্টের বন্যা বয়ে যাচ্ছে?

এসব প্রশ্ন শুধু আমার নয়, অসংখ্য মানুষের। যেখানেই যাই তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে প্রসঙ্গ উঠলেই ক্ষোভের সঙ্গে এসব প্রশ্ন চলে আসে। এরপর তাঁদের এ আন্দোলন হাসি–ঠাট্টা–তামাশা, হালের ভাষায় যাকে বলে ‘ট্রল’। বিষয় হচ্ছে, একটি কলেজের শিক্ষার্থী নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দেখতে কেন এতটা ‘বেপরোয়া’ হয়ে উঠেছেন? তাঁরা তো জেনেশুনে বা জেনেবুঝে কলেজেই ভর্তি হয়েছিলেন।

কিছুদিন আগে দেখলাম তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজেরাই কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করে দিয়েছেন। কলেজগেটে কলেজের নামফলক ঢেকে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানারে। এ নিয়ে কী এক তামাশা তৈরি হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কেন তাঁরা এভাবে নিজেদের হাসির পাত্র বানাচ্ছেন?

তাঁদের আন্দোলনের কারণে চরম ভোগান্তির শিকার মানুষের কাছ থেকে এমন প্রতিক্রিয়াও আসছে—চাকরির বাজারে তিতুমীরের শিক্ষার্থীদের সিভি খুলেও দেখবে না কেউ। কতটা ক্ষোভ থেকে এমন প্রতিক্রিয়া আসতে পারে, তা কেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বুঝছেন না? এমন আন্দোলন করে তাঁরা কি ভবিষ্যতের জন্য আরেকটি বিপদ ডেকে আনছেন না?

প্রশ্ন হচ্ছে, হাতের মুঠোয় বিশ্বের এই যুগে পড়াশোনা বা ক্যারিয়ারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়তে হবে কেন? তাঁদের কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই হতে হবে। তাঁরা কি জানেন না, দেশে জেলায় জেলায় গড়ে তোলা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কী অবস্থা এখন? এতেই তো ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী’ বলে পরিচয় জাহির করার যে গর্ব, সেটি লজ্জায়–অপমানে মিশে যাওয়ার কথা।

এরপরও কোনো কলেজকে প্রয়োজনে সরকার বা নীতিনির্ধারকেরা বিশ্ববিদ্যালয় বানাতেই পারেন; কিন্তু শিক্ষার্থীরা কী করে সে দাবি তোলেন?

শিক্ষক নেই, শিক্ষক লাগবে; ল্যাব নেই, ল্যাব লাগবে; হোস্টেল নেই, হোস্টেল বাড়াতে হবে; লাইব্রেরি ছোট, আরও বড় করতে হবে; মিলনায়তন ছোট, আরও বড় করতে হবে, খেলার মাঠ নেই, সেটি লাগবে—এই রকম অসংখ্য দাবি আছে, সেগুলো তুলতে পারেন তাঁরা।

শিক্ষার মান ও শিক্ষার পরিবেশ উন্নত করতে এসব তো ন্যায্য দাবি। আর এসব দাবি তো শিক্ষার্থীরাই তুলবেন। এসব সংকটের সুরাহা না করলে সেই প্রতিষ্ঠান কলেজ হলেই কী, আর বিশ্ববিদ্যালয় হলেই কী!

ফেসবুকে দেখলাম, তিতুমীরের শিক্ষার্থীদের অনেকে তাঁদের আন্দোলনের পক্ষে যুক্তি দিয়ে ভ্লগ বানিয়ে ছাড়ছেন। একজনের বক্তব্য শুনলাম। তাঁদের যুক্তিগুলো কী কী? একটি যুক্তি—‘তিতুমীরে ইন্টারমিডিয়েট নেই, এখানে আছে অনার্স ও মাস্টার্স, তো তিতুমীর কেন কলেজ থাকবে?’ তাঁরা কি জানেন, ইন্টারমিডিয়েট ছাড়া এমন কলেজ বা ডিগ্রি কলেজ এ দেশে অসংখ্য আছে?

গত নভেম্বরে আন্দোলনের সময় মহাখালীতে রেলপথ অবরোধ করতে চলন্ত ট্রেনে পাথর ছুড়ে মেরেছিলেন তিতুমীর কলেজের কয়েকজন আন্দোলনকারী। অনেক যাত্রী রক্তাক্ত হয়েছিলেন। আহত মানুষের মধ্যে ছিল নারী ও শিশু। এটি কিন্তু শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ। এর জন্য কি তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল?
আরেকটি যুক্তি—‘জগন্নাথ কলেজ যখন বিশ্ববিদ্যালয় হয়, তখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম ছিল এবং তাদের জমির পরিমাণ ছিল ১০ একর। তিতুমীরের ১১ একর জমি এবং প্রায় অর্ধলক্ষ শিক্ষার্থী। তাহলে তিতুমীর কেন বিশ্ববিদ্যালয় হবে না?’

তাঁরা কি জানেন, এ যুক্তিতে ঢাকা কলেজ, রাজশাহী কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, রংপুরের কারমাইকেল কলেজ, বগুড়ার আজিজুল হক কলেজ, সিলেটের এমসি কলেজসহ এ রকম অনেক কলেজই তাদের আগে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার দাবিদার?

আরেকটি যুক্তি—ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তাহলে উত্তর সিটিতে কেন একটি বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে না? তাঁদের কে বোঝাবে, দেশের কোন শহরে বিশ্ববিদ্যালয় আছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো প্রতিষ্ঠিতই হয়েছিল সিটি করপোরেশন হওয়ার আগে। আর সিটি করপোরেশন ধরে তো বিশ্ববিদ্যালয় হয় না। কারণ, সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠান থেকেও বড় প্রতিষ্ঠান একটি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়কে বলাই হয় রাষ্ট্রের ভেতরে আরেকটি রাষ্ট্র। আর এখন একটি দাবি অনেকে জোরালোভাবেই তোলেন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঢাকার বাইরে নিয়ে যেতে।

আরও কিছু যুক্তি আছে, যেমন—তিতুমীর কলেজ থেকে অমুক অমুক এমপি, মন্ত্রী বা অভিনেতা–অভিনেত্রী হয়েছেন। এর জন্য কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয় করতে হবে। এটি কেমন মাপকাঠি বুঝে এল না? এখন এমপি–মন্ত্রী–শিল্পী হওয়াকে বড় অর্জন ধরলে প্রতিষ্ঠানটির তো কলেজই থাকা উচিত, কলেজের শিক্ষার্থী হওয়ার কারণে যেহেতু তাদের এ সাফল্য এসেছে। আর এমপি–মন্ত্রী–শিল্পী হওয়ার অজর্নের কারণে যদি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করতে হয়, তাহলে প্রতিটা গ্রামের স্কুলকেই কলেজ বানাতে হবে। স্কুল বলতে তখন আর কিছু থাকবে না।

এমন সব যুক্তি দিয়ে বেশ কয়েকটি ভ্লগ দেখলাম। হাজার হাজার রিয়েকশন, তার বেশির ভাগই—হা, হা। এর মানে এটিও প্রতীয়মান হয় যে তাঁদের এসব দাবি খুব একটা জনসমর্থন পাচ্ছে না।

এরপরও আশার কথা হচ্ছে, তিতুমীর কলেজ তো একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ হচ্ছে। তিতুমীর কলেজসহ সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের এ দাবি দীর্ঘদিনের। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর সেই দাবি আরও জোরালো হয়। দিনের পর দিন সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে অবশেষে সেই দাবি আদায় করে ছেড়েছেন তাঁরা।

তাহলে তো তিতুমীর কলেজ এখন একটি আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েই গেল। এরপরও কেন তাদের আবার আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ই হতে হবে? আর শিক্ষা উপদেষ্টা তো তাঁদের দাবিকে খারিজ করে দিয়েছেন। তার মানে, তাঁদের দাবি মানা হবে না। এরপর আন্দোলনের নামে তাঁরা যা শুরু করেছেন, সেটিকে আর কোনো অর্থেই আন্দোলন বলা যায় না।

গত নভেম্বরে আন্দোলনের সময় মহাখালীতে রেলপথ অবরোধ করতে চলন্ত ট্রেনে পাথর ছুড়ে মেরেছিলেন তিতুমীর কলেজের কয়েকজন আন্দোলনকারী। অনেক যাত্রী রক্তাক্ত হয়েছিলেন। আহত মানুষের মধ্যে ছিল নারী ও শিশু। এটি কিন্তু শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ। এর জন্য কি তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল?

সেই ঘটনা নাগরিক সমাজকে চরমভাবে ক্ষুব্ধ করে। এরপরও তাঁরা কয়েক দিন ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করছেন, আজ আবার রেলপথ অবরোধও করেছেন। এগুলো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিতুমীর কলেজেরই অনেক বুঝদার শিক্ষার্থীই এ আন্দোলনের পক্ষে নেই, এমন বিবৃতিও দিয়েছেন। তাঁদের কেউ কেউ এ–ও দাবি করেছেন, কলেজটির ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীই এ আন্দোলনের সঙ্গে নেই। আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য পরিস্থিতি তৈরি করার উদ্দেশ্যে কতিপয় শিক্ষার্থীর কর্মকাণ্ড এসব, যার সুফল পেতে পারে পতিত স্বৈরাচারী সরকার। সে ব্যাপারে সচেতন থাকারও আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।

এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা আসলে কী করবে, কী করা উচিত। কলেজ কর্তৃপক্ষকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অভিভাবকদের ভূমিকাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কতিপয় শিক্ষার্থী দাবি তুলে আন্দোলনের নামে একটি কলেজকে জিম্মি করে রাখবে, দিনের পর দিন রাজধানী শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অচল করে রাখবে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমরা এর অবসান চাই।      

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor