তখন আমি এই শহরের নামকরা এক বিদ্যালয়ে পড়ি
সময়মতো সব করা চাই নইলে ভীষণ ধমকে ওঠে ঘড়ি
যানবাহনের জট, জন-ভিড়, তদুপরি অনেক দূরে বাসা
দু-তিন গাড়ি পাল্টে তবে কষ্টকর এক নিত্য যাওয়া-আসা!
সকাল দশে ঘণ্টা শুরু, চারটে বাজে বিকেল, তখন ছুটি
যাই বেরিয়ে তড়িঘড়ি, কোচিং ক্লাসও করতে হবে দুটি
আড্ডা দেব? খেলব মাঠে? এসব করার সুযোগ কোথায়, বলো
আমি যে এক আষাঢ়ে শোল, সময় চেপে ধরেছে তার পলো!
ফাঁকি দিতে ইচ্ছা হলেও মেলে না ভাই কায়দামতো ছুতো
বাসে বসেই গল্প, নাটক ছড়া পড়ি, পাঠ্যবহির্ভূত
বাসায় যখন ফিরি, তখন সন্ধ্যা কেটে রাত্রি নেমে আসে
পড়ার ফাঁকে তবু চুপে মন ঢেলে দিই কিশোর উপন্যাসে!
কষ্ট করায় দ্বিধাটি নেই, বিঘ্নে আমি নই যে মোটে ভীত
বিদ্যালয়ে পাঠ পরীক্ষা, সব কিছুতে ভালোই নিয়মিত।
কিন্তু জানো, এই আমিটাই প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি এলে
নিজের নিয়ম ভেঙে নিজে তা সাজাতাম ইচ্ছামতো ঢেলে
সবাই জানো, এই মাসে হয় বইয়ের মেলা একাডেমির মাঠে
আমি তো নই মূর্খ এমন, থাকব ডুবে ক্লাস কোচিংয়ের পাঠে!
মেলায় এলো কী বই নতুন, কী প্রচ্ছদ ও অলংকরণ নিয়ে
এসব আমার চাই দেখাটি, ঘুরে ঘুরে স্বশরীরে গিয়ে
টিফিন করার খরচ বাঁচাই, এক বছরে বেশ জমা হয় টাকা
এই সময়ে আর হতো রোজ মাটিব্যাংকে কয়েন ভরে রাখা
সব মিলিয়ে যা, তা দিয়ে মেলা থেকে বই যে হবে কেনা
কেনার আগে চাই সেগুলো হাতে-চোখে পরখ করে চেনা।
বিকেল বেলা তিনটা থেকে আনন্দময় বইয়ের মেলা শুরু
ক্লাস চলছে, কেটে পড়ি! বুক কিছুটা কাঁপেই দুরু দুরু
ওয়াশরুমে ঢোকার ছলে বিড়াল পায়ে যাই ভবনের পিছে
যেখানটা খুব স্যাঁতসেঁতে আর খেলা করে শামুক কেঁচো বিছে
উর্দিজামা পুরে ব্যাগে দেয়াল ঘেঁষে ওপারে দিই ফেলে
টপকে বেরোই; বিদ্যালয়ের মার্কাবিহীন টি-শার্ট পরা ছেলে!
রিকশা চেপে, পায়ে হেঁটে ছুটে আসি প্রাণের মেলার মাঠে
প্যাভিলিয়ন ঘুরে ঘুরে, বই নেড়ে, নাম টুকে বিকেল কাটে।
মনের মতো, কেনার মতো, বই খোঁজা নয় চাট্টিখানি কথা
সারি সারি প্যাভিলিয়ন, হাজার হাজার বইয়ের নীরবতা!
কেনার জন্য খেটে ঘেঁটে তৈরি করি বইয়ের তালিকাটি
মহৎ কাজের জন্য না হয় ক্লাস ও কোচিং এই মাসে হোক মাটি!
বেছে কেনা বই সাজিয়ে ব্যক্তিগত পাঠাগারের তাকে
বছর ভরে পড়ি, যেমন মৌমাছিরা মগ্ন থাকে চাকে
প্রিয় বড় লেখক যাঁরা, চাঁদের আলো ছড়ান মানসপটে
তাঁদের লেখায় সাঁতার কাটি—এক ধরনের বাহাদুরিই বটে!
চেনা-জানা নেই যদিও, হয় যে সেতু লেখক-পাঠকযোগে
সমাজটা বেশ সুস্থ হতো সবাই যদি ভুগত এমন রোগে!
ক্লাস ফাঁকিটা খুব সোজা নয়, প্রথম প্রথম পড়ে যেতাম ধরা
হেড টিচারের বেতের বাড়ি, বাবা-মায়ের বকাও হজম করা
কৌশলাদি রপ্ত করি, বেত ও বকা না হয় যাতে খেতে
এই ফাঁকিটাও শিল্প! শোনো, শেখার আছে অনেক কিছু এতে!
পাঠ্যসূচির পড়া পড়ে মন ভরে কার? আমার তো নয় মোটে
গল্প ছড়া ভ্রমণকথা উপন্যাসে তৃষিত মন ছোটে
ফেব্রুয়ারির বইয়ের মেলা বিশাল সুযোগ সামনে আনে বয়ে
বাঁচতে আমি চাইনি বাপু বেঞ্চে বসা হুতুম প্যাঁচা হয়ে!
Publisher & Editor