শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ঢাকার কাছেই ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ি, ঘুরে আসুন এক দিনেই

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ২২

শত বছরের ঐতিহাসিক স্থাপনায় সমৃদ্ধ বাংলার জনপদ সাক্ষী হয়ে আছে নানা সময়ের স্থাপত্য শিল্পকর্মের। এমনকি নদীমাতৃক বাংলাদেশ সেই জীবাশ্মগুলোকে বুকে ধারণ করে এখনো শুনিয়ে যায় উত্থান-পতনের কাহিনি। তেমনি একটি পুরাকীর্তি ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ি দুর্গ, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঈশা খাঁর বীরত্বগাথা।

ষোলো শতকের এই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার এখন আর আগের মতো জৌলুস না থাকলেও ইতিহাস উৎসাহীদের কাছে এটি একটি প্রিয় পর্যটন স্থান।

এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটি নিয়েই আজকের ভ্রমণবিষয়ক প্রতিবেদন। চলুন, জেনে নেওয়া যাক, কিভাবে যাবেন ঈশা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত এই স্থানে।
ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ি দুর্গের অবস্থান

ঢাকা বিভাগের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত জেলা কিশোরগঞ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা করিমগঞ্জ। এই করিমগঞ্জের অন্তর্গত কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নের নরসুন্দা নদীবিধৌত একটি গ্রাম জঙ্গলবাড়ি।

এই গ্রামেরই মধ্যমণি বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম নেতা ঈশা খাঁর স্মৃতিবাহী জঙ্গলবাড়ি দুর্গ। মসনদে-আলা-বীর ঈশা খাঁ এখানেই বানিয়েছিলেন তার দ্বিতীয় রাজধানী।

জঙ্গলবাড়ি দুর্গের ইতিহাস

ইংরেজদের ও মুঘলদের স্বৈরাচার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বাংলার জমিদাররা গোপনে সাহায্য চেয়েছিলেন ঈশা খাঁর কাছে। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১ হাজার ৪০০ অশ্বারোহী, ২১টি নৌবিহার এবং গোলাবারুদ নিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যে হাজির হন ঈশা খাঁ।

অতঃপর ১৫৮৫ সালে তৎকালীন কোচ রাজা লক্ষ্মণ হাজরা ও রাম হাজরাকে পরাজিত করে তিনি দখল করে নেন জঙ্গলবাড়ি দুর্গ।
তবে এই দুর্গ সেই কোচ রাজার আমলে তৈরি করা হয়নি। ধারণা করা হয়, এর গোড়াপত্তন হয়েছিল প্রাক-মুসলিম যুগে। তবে দুর্গ দখলের পর ঈশা খাঁ দুর্গটির সংস্কার করার সময় এর ভেতরে আরো কিছু স্থাপনা নির্মাণ করেন। এই দুর্গ থেকেই পরবর্তীতে তিনি ক্রমান্বয়ে সোনারগাঁওসহ ২২টি পরগনা দখল করেছিলেন।

১৬১০-এর ১৬ জুলাই মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সেনাপতি ইসলাম খানের কাছে তার পরাজয়ের পর ঈশা খাঁর বংশধররা সোনারগাঁও ত্যাগ করে আশ্রয় নিয়েছিলেন এই জঙ্গলবাড়ি দুর্গে।

বর্তমানে এই ঐতিহাসিক দুর্গ বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। ২০০৫-এর ১২ জুন স্থানীয় প্রশাসন দুর্গের ভেতরের দরবার কক্ষটি সংস্কার করে স্থাপন করে জাদুঘর ও পাঠাগার। নতুন সংস্কারকৃত কক্ষটিকে ‘ঈশা খাঁ স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার’ নাম দিয়ে উন্মুক্ত করা হয় দর্শনার্থীদের জন্য।

ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ি দুর্গে কী দেখবেন

দুর্গটিকে দুটি চত্বরে ভাগ করেছে এর উত্তর-দক্ষিণে গড়া লম্বা ইটের প্রাচীর। স্থানীয়দের কাছে প্রাচীরটি ‘প্রাসাদ প্রাচীর’ নামে পরিচিত। দক্ষিণের তোরণের সামনের দিকে রয়েছে ‘করাচি’ নামের পূর্বমুখী একটি একতলা ভবন। আর পেছন দিকের দক্ষিণমুখী একতলা ভবনটির নাম ‘অন্দর মহল’। পুরো ইটের দেয়ালটি চুনকামসহ লেপনে আবৃত। দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর দিকে খনন করা গভীর পরিখাটি পূর্ব দিকে মিলিত হয়েছে নরসুন্দা নদীর সঙ্গে। বাড়ির সামনে রয়েছে ঈশা খাঁর আমলে খনন করা একটি দিঘি।

প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত দরবার হলের গায়ে এখনো দেখা যায় সে সময়ের বিভিন্ন নকশা। এ অংশেই করা হয়েছে জাদুঘর ও পাঠাগারটি। এখানে স্থান পেয়েছে ঈশা খাঁর ছবি, তার ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র এবং বংশধরদের তালিকা।

এখানকার সবচেয়ে মনোরম অবকাঠামো হচ্ছে প্রাচীন মসজিদটি। এর নির্মাণ কবে হয়েছে তা নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা হয়, এটি ঈশা খাঁই বানিয়েছিলেন। ৪৪ ফুট লম্বা ও ১৮ ফুট চওড়া এই আয়তকার মসজিদের ছাদে রয়েছে তিনটি বড় বড় গম্বুজ। প্রত্যেক কোণের মিনারগুলো মসজিদের শোভা বাড়াচ্ছে। প্রায় ৪ ফুট মোটা দেয়ালের এই মসজিদের পূর্বে দেখা যায় ১১ ফুট খোলা একটি বারান্দা।

কিভাবে যাবেন

এই দুর্গ দেখতে হলে যেকোনো স্থান থেকে প্রথমে যেতে হবে কিশোরগঞ্জ জেলা সদরে। ঢাকার মহাখালী কিংবা সায়েদাবাদ থেকে কিশোরগঞ্জের গাইটাল পর্যন্ত যাওয়া যাবে বাসে। এ যাত্রায় জনপ্রতি গুনতে হবে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। সেখানে শহরের একরামপুর মোড়ের উদ্দেশে উঠে পড়তে হবে রিকশা বা ইজি বাইকে। ইজি বাইকের খরচ হতে পারে মাথাপিছু ১০ টাকা, আর রিকশায় গেলে ২৫ টাকা।

ট্রেনে ভ্রমণে আগ্রহীরা চাইলে ট্রেনে যেতে পারেন। কমলাপুর বা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠা যাবে। সোম ও বুধবার বাদ দিয়ে যেকোনো দিন সকাল সোয়া ৭টা অথবা সন্ধ্যা পৌনে ৭টার ট্রেন ধরতে হবে। শ্রেণিভেদে এগুলোর সিট ভাড়া পড়তে পারে মাথাপিছু ১৩৫ থেকে ৩৬৮ টাকা। এই যাত্রায় কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশন পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে প্রায় ৪ ঘণ্টার মতো।

তারপর স্টেশনেই পাওয়া যাবে একরামপুর মোড়ে আসার ইজি বাইক, যেগুলোতে ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা। একরামপুর মোড়ে পৌঁছার পর ইজি বাইক বদলে আরেকটি ইজি বাইকে কিংবা সিএনজি অথবা রিকশায় চড়ে সরাসরি চলে যাওয়া যাবে জঙ্গলবাড়ি দুর্গ। স্থানীয় ইজি বাইকগুলো প্রতিজনের জন্য ২০ টাকা বা ৩০ টাকা করে ভাড়া নিতে পারে। আর রিজার্ভ করার ক্ষেত্রে যাওয়া-আসা বাবদ খরচ হতে পারে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।

থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা

জঙ্গলবাড়ি দুর্গের কাছাকাছি থাকার জন্য কোনো আবাসিক হোটেল নেই। তাই রাত্রি যাপনের একমাত্র উপায় কিশোরগঞ্জ সদরে চলে আসা। কারণ সদরের স্টেশন রোড এলাকায় রয়েছে বেশ কিছু ভালো মানের আবাসিক হোটেল। এ ছাড়া আগে থেকে অনুমতি নিয়ে জেলা সদরের সরকারি ডাকবাংলোতে থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

আর খাবারের ক্ষেত্রে দুর্গের নিকটে জঙ্গলবাড়ি বাজার নামক এলাকায় ছোটখাটো কয়েকটি হোটেল আছে। এখানে কম খরচে স্থানীয় কিছু খাবারের পাশাপাশি ভাতের সঙ্গে মাছ-মাংসও পাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে ভালো হবে সদরের রেস্তোরাঁগুলোতে চলে এলে। এ ছাড়া কিশোরগঞ্জের হাওরের মিঠাপানির মাছের সুখ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে।
 
একরামপুরে পাওয়া যাবে কিশোরগঞ্জের বিখ্যাত মিষ্টির দোকানগুলো। ভোজনরসিক ও একই সঙ্গে মিষ্টিপাগলদের জন্য কিশোরগঞ্জ সেরা জায়গা। এখানকার বালিশ মিষ্টি, চালকুমড়ার মোরব্বা, পায়েস, মিডুড়ী, নারকেল চিড়া, গরুর মাংসের সমুচা ও খুঁদের ভাত পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।

আর এখানকার নকশি পিঠা, ভাপা পিঠা, চিতল ও দুধ চিতল পিঠা, কলা পিঠা ও চ্যাপা পিঠা পরখ করতে অবশ্যই আসতে হবে শীতকালে।

আশপাশের দর্শনীয় স্থান

শুধু ডে-ট্যুরের মতো ঝটিকা সফর না দিয়ে হাতে বেশ কিছু সময় নিয়ে জঙ্গলবাড়ি দুর্গ ভ্রমণে যাওয়া যেতে পারে। কেননা এর কাছাকাছি রয়েছে কবি চন্দ্রাবতী মন্দির, মিঠামইন হাওর ও নিকলী হাওর, ঈশা খাঁর এগারসিন্দুর দুর্গ, কিশোরগঞ্জ লেক ওয়াচ টাওয়ার, ও গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ির মতো জনপ্রিয় পর্যটন স্থান।

ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ি দুর্গ ভ্রমণ মানে রীতিমতো বাংলার প্রাচীন ভূখণ্ড থেকে ঘুরে আসা। এই একুশ শতকে এসে শহরের মাঝে এমন পুরাকীর্তির দর্শন বারবার মনে করিয়ে দেবে যে কতটা পথ অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ। কত ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে আছে এই দুর্গ! ঈশা খাঁ জাদুঘর ও পাঠাগারের ভেতর দিয়ে হাঁটার সময় হয়তো সেই যুদ্ধের দামামা প্রতিধ্বনি হয়ে ভয় পাইয়ে দেবে না, কিন্তু দেয়ালের নকশাগুলো অকপটে জানান দেবে তৎকালীন স্থাপত্যশৈলীর কথা। সেই সঙ্গে জঙ্গলবাড়ির দীঘি আর নরসুন্দা নদী অনায়াসেই ভুলিয়ে দেবে কালো ধোঁয়া ও দালানকোঠার শহরের অস্থিরতা।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor