শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

কলকাতার সুলুক সন্ধানে

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ১৪

দুই দেশের সম্পর্কের অবনতির কারণে এখন সীমান্ত একেবারে শান্ত, কোনো ভিড় নেই। আগের সময় হলে এতক্ষণ বেনাপোল বন্দর রূপান্তরিত হতো মেলা প্রাঙ্গণে। অফিসের রুটিন কাজে আটকে পড়ে প্রায় হাঁপিয়ে উঠেছি। বহুদিন কোথাও  ঘুরতে যাওয়া হয়নি। বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম মনের ক্লান্তি দূর করতে কোথাও ভ্রমণে যাওয়া দরকার। ভ্রমণ শরীর আর মন দুইয়ের জন্য সেরা দাওয়াই।

ভ্রমণের  স্থান নির্বাচন করেছি ইন্ডিয়ার এমন একটি রাজ্য। যার আশেপাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা বা হিমালয়ের সৌন্দর্য নেই। বরফের গায়ে সোনালি রোদের কিরণ লেগে দ্যোতনা সৃষ্টির দৃশ্য নেই। যাচ্ছি কবিগুরুর শহর, জীবনানন্দের শহর, শীর্ষেন্দু, সুনীল, সমরেশের শহর কলকাতায়। ১০ জানুয়ারি ২০২৫ সাল। রাত ১২ টা ৩০ মিনিট। তল্পিতল্পা বলতে একটা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে ঢাকার থেকে দাদাদের দেশের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছি। ভ্রমণসঙ্গী সহকর্মী লিটু ভাই আর সঞ্জয় দা।

বাসে বসে আছি বাইরে প্রচুর শীত। ধোঁয়ার মতো হয়ে কুয়াশা পুরো দিগন্ত ঢেকে রেখেছে। চোখের পাতা বুঝে আসছে। তবুও পাতাকে এক হতে দিচ্ছি না, যাত্রাপথে স্বপ্নের পদ্মা সেতু দেখব বলে। ঢাকার সাথে এ সেতু দক্ষিণ বঙ্গকে এক সুতায় গেঁথেছে। সন্ধ্যা বেলা অফিস শেষে দিগন্তে বুকে যখন চোখ যখন দেখেছিলাম, তখন আকাশ ছিল অপুষ্টিতে ভোগা অর্ধাকৃতির চাঁদ আর হাজার তারার দখলে। বাসের কাঁচের জানালা দিয়ে মধ্য রাতে তাকিয়ে দেখছি, কুয়াশার কুণ্ডলি চাঁদ-তারাকে ঢেকে রেখেছে। পদ্মা নদীর বুকে ধু ধু অন্ধকার তার চাদর বিছিয়ে রেখেছে।  

সকাল ছ’টায় বেনাপোল নামিয়ে দেওয়া হলো। তীব্র শীতে কেঁপে উঠলাম। চেয়ার বসে ঘণ্টা দেড়েক ঘোড়ার মতো ঘাড় উঁচিয়ে ঘুমিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে নিলাম। যাতে কলকাতা পৌঁছানোর পর ক্লান্তি ঘিরে ধরতে না পারে। নাস্তা সেরে ইমিগ্রেশন এর জন্য প্রবেশ করলাম। কলকাতা দেখার নেশায়  ভাবনার রাজ্যে ভেসে উঠছে  নতুন স্বপ্ন। মনের আয়নায় ভেসে উঠছে শহরের কল্পিত চিত্র। ইমিগ্রেশনে হঠাৎ-ই সাব-ইন্সপেক্টর তুষারের সাথে দেখা। ও ইমিগ্রেশন যতটা সম্ভব সহায়তা করে বললেন, দুই দেশের সম্পর্কের অবনতির কারণে এখন সীমান্ত একেবারে শান্ত, কোনো ভিড় নেই। আগের সময় হলে এতক্ষণ বেনাপোল বন্দর রূপান্তরিত হতো মেলা প্রাঙ্গণে। 

কানের কাছে এসে তুষার বলল, ভাইয়া, এই শীতে কাশ্মীরের বাঁকে বাঁকে শীতল বরফ জমে থাকে। পর্বত চুড়ায় বরফ ঢাকা গুহার মুখ দিয়ে ধূঁয়ার মতো কুয়াশার কুণ্ডলি বের হয়। আপেল গাছ থেকে হাত দিয়ে সতেজ আপেল পেড়ে খাওয়ার মজাই আলাদা। দুই পা দুইদিকে ঝুলিয়ে ঘোড়ায় চড়ে পৃথিবীর ভূস্বর্গ দেখার স্বপ্ন পূরণ করে নিন। প্রস্তুতি থাকলে কলকাতা পৌঁছে কাশ্মীর চলে যান। ভাবছি, পৃথিবীর স্বর্গ যদি কাশীমির হয়, তাহলে অনন্তকালের  অপেক্ষায় না থেকে জীবদ্দশায় কিছু পয়সা খরচ করে একবার পৃথিবীর স্বর্গ ঘুরে আসব। 

ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া শেষ করে যখন পেট্রাপোল সীমান্তে দাঁড়ালাম, তখনও আকাশের বুকে ঝুলে থাকা উদিত সূর্যটা দেখা যাচ্ছে না কুয়াশার কারণে। হরিদাস পুর থেকে অটোতে রওনা হলাম বনগাঁর পথে। বনগাঁয় পৌঁছে পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করলাম। বুকের মাঝটা ভয়ে শিরশির করে উঠছে। ভাবলাম, রাজনৈতিক উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে, আমরা বাংলাদেশি এটা বুঝতে পারলে অতর্কিত আক্রমণের ঘটনা ঘটেই যায় নাকি!  বনগাঁ থেকে ২০ রুপি করে  টিকেট কেটে শিয়ালদহের ট্রেনে বসে পড়েছি। টিকিটের গায়ে লেখা সময় ধরে  ট্রেন ১০টা ২৮ মিনিটে  যাত্রা শুরু করল।  এতক্ষণে সূর্যটা দিগন্তের খানেক ওপরে উঠে এসেছে। কুয়াশার জালের ওপর দিয়ে নীল আকাশ বা সূর্য কোনটাই দেখা যাচ্ছে না। জমিনের ওপর যেন ঘন কুয়াশার সমুদ্র জেগে উঠেছে। 

ট্রেনে  অপ্রত্যাশিত মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকল। চোখে পড়ছে, সবুজ গাছপালা সমতল এলাকাটিকে ঘিরে আছে। কৃষকের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে হলুদ শর্ষে ফুলের অবারিত সৌন্দর্য লুটোপুটি খাচ্ছে। হলুদের গালিচা মোড়ানো বিস্তীর্ণ প্রান্তর দেখে মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। যেদিকে চোখ যায় সেখানেই প্রকৃতি হলুদ চাদর বিছিয়ে রেখেছে। এ যেন আরেক রূপসী বাংলা। ট্রেন যত এগিয়ে যাচ্ছে হকারের আনাগোনা তত বাড়ছে। হকার ঝুড়ি ভর্তি কমলা লেবু, আপেল বিক্রির সময় বলে যাচ্ছে একশ রুপিয়া কেজি। কখনো কাঠির ডগায় পতাকার মতো আমড়া উড়িয়ে হাজির হচ্ছে হকার। কেউ পেয়ারা, আঁচার, শনপাপড়ি। কেউ বলছে, বাদাম, ছোলা, ঝুরি ভাজা খেলে বলবেন। ফেরিওয়ালারা রেশমি চুড়ি , চিরুনি, রুমাল, পুঁতির মালাসহ হরেক রকমের পণ্য বিক্রি করে চলছে। দমদম স্টেশন  ট্রেন থামতেই, জানালার বাইরে এক হকার শিশুতোষ বইয়ের পাতা মেলে ধরছে। তাতে রঙিন জিরাফ গলা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর বানর ঝুলে আছে গাছের ডালে। 

ট্রেন যখন বারাসাত স্টেশনে আসল তখন অগণিত যাত্রীর স্রোত ট্রেনে। তিল পরিমাণ জায়গা ফাঁকা নেই বগিতে। ট্রেনে এতো লোক দেখিনি আমি। গোনা সম্ভব নয়। যাত্রীরা মৌমাছির ঝাঁকের মতো গুনগুন আওয়াজ তুলছে। 
অনেক ঘুরিয়ে-পেচিয়ে বারাসাত স্টেশন, বামন গাছির গোলকধাঁধার পথ পেরিয়ে ট্রেন থামল শিয়ালদহ। আমরা যখন শেষ  স্টেশনে পৌঁছালাম, তখন সূর্যটা মধ্য আকাশের বুকে চলে এসেছে। ট্যাক্সির জন্য যখন হেঁটে পথ চলছি। অপরিচ্ছন্ন নোংরা রাস্তাঘাট দেখে হতাশ হলাম। কলকাতা সম্পর্কে বিরূপ ধারণা বদ্ধমূল হলো। ফুটপাতের দোকানিরা ফলের দাম হাঁকছে আনার ১৫০ রুপিয়া, কমলালেবু ১০০ কেজি। এখানে ফল খুবই সস্তা।  

ট্যাক্সি খুঁজতে খুঁজতে চলতি পথে  চোখে পড়ছে ঐতিহ্যবাহী ট্রাম লাইন।  কিছু লাইন পিচ দিয়ে চাপা দেওয়া হয়েছে, আবার কোথাও বুক উঁচিয়ে আছে লাইন। মনে হচ্ছে ট্রাম গাড়ির ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। ট্রাম লাইনে দুর্ঘটনায় পড়ে কবি জীবনানন্দ দাশ মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আমরা ট্যাক্সিযোগে মারকুইস স্ট্রিটে এসে হোটেল পেয়ে গেলাম। হোটেল ম্যানেজারের জানাল, কয়েক মাস আগেও হোটেলে ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই অবস্থা ছিল। এখন বাংলাদেশিরা না আসায় হোটেল মালিকসহ সব ব্যবসায়ীরাই মাছি তাড়াচ্ছেন।  পাশেই বাংলাদেশের বাস কাউন্টার সোহাগ, শ্যামলী, রয়েল সার্ভিস এবং বিআরটিসির কাউন্টার। তাতে বড় বড় বাংলা অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘কলকাতা-ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ’। কোথাও আবার লেখা ‘কলকাতা-ঢাকা-চট্টগ্রাম’। জায়গাটাকে কলকাতার বুকে ‘এক টুকরো বাংলাদেশ’ মনে হলো। চারটায় আমরা কস্তুরী রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার সেরে নিলাম।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor