নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে আত্মীয়দের সঙ্গে জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে হামলার শিকার হয়েছেন চিত্রনায়িকা পারভীন সুলতানা দিতির কন্যা লামিয়া চৌধুরী। গতকাল শনিবার দুপুরে সোনারগাঁ পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের দিয়াপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় লামিয়া চৌধুরী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লাইভ করেন। সেই লাইভে লামিয়ার গাড়ি ভাঙচুর করতে দেখা যায়। ভিডিওতে লামিয়া বলছিলেন, তার পা ভেঙে ফেলা হয়েছে। তিনি হাঁটতে পারছেন না। তাঁর গাড়িও ভাঙা হয়েছে।
তবে লামিয়ার প্রয়াত ছোট মামার স্ত্রী লায়লা লুৎফুন্নাহার প্রীতি পাল্টা অভিযোগ করেছেন। তাঁর দাবি, জমিসংক্রান্ত বিষয়ে বিচারে লোকজন নিয়ে এসে তাঁর (প্রীতি) ওপর হামলা চালিয়েছেন লামিয়া। স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, চিত্রনায়িকা দিতির পাঁচ ভাই ও তিন বোন। তাঁর ৪ নম্বর ভাই লামিয়ার মামা টিপু সুলতান প্রায় ৯ বছর আগে মারা গেছেন। তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে লামিয়াদের জমিসংক্রান্ত বিরোধ চলছে। এ নিয়ে আদালতে একটি মামলাও চলমান।
ঘটনার দুজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, শনিবার লামিয়ার নানাবাড়িতে জমি নিয়ে বিচার-সালিস বসানো হয়। সালিসে লামিয়ার পক্ষে ঢাকা থেকে আসা কয়েকজন ছিলেন। অপর দিকে লামিয়ার মামির পক্ষে সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেনের লোকজন অংশ নেন। সালিসের এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। একপর্যায়ে দুই পক্ষই হাতাহাতিতে জড়ায়। তখন লামিয়ার গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। লামিয়ার ওপর হামলায় বিএনপি নেতা মোশাররফ হোসেনের লোকজন অংশ নেন।
জানতে চাইলে বিএনপি নেতা মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমার লোকজন কোনো হামলার সঙ্গে জড়িত না। মহিলারা মহিলারা এইটা করছে। আমিও গিয়েছি ঘটনার অনেক পরে। সেখানে গিয়ে শুনেছি, লামিয়া লোকজন নিয়ে তাঁর মামিকে মারধর করেছেন।’
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে লামিয়ার মামি লায়লা লুৎফুন্নাহার বলেন, ‘আমার মৃত স্বামীর নামে ৩৮ শতাংশ জমি আছে। সেখানে আমি আমার দুই সন্তানকে নিয়ে বসবাস করি। আমার একটি ছেলে অটিস্টিক। আমার স্বামীর জমি দখল করতে চায় লামিয়ারা। এ নিয়ে সালিস বসলে লামিয়া ঢাকা থেকে লোকজন নিয়ে এসে আমার ওপর হামলা চালায়। এতে আমি আহত হই। বর্তমানে আমি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন।’
লায়লা লুৎফুন্নাহারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কথা হয় লামিয়া চৌধুরীর সঙ্গে। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় তিনি জানান, তাঁর মামির এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। লামিয়া চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তো আমাদের জায়গার দখলই নিতে পারছি না, সেখানে অন্যের জমি দখল করতে কেন যাব! অদ্ভুত তো। আশ্চর্য। এটা কেমন মিথ্যাচার! আমার ছোট মামি শান্তিমতো থাকেন, তাঁকে কেউই ডিস্টার্ব করে না। আমার মামার মৃত্যুর পর কোথায় শোক প্রকাশ করবেন, তা না করে এই মামি সম্পত্তি নিয়েই উঠেপড়ে লেগেছেন। তিনি তাঁর স্বামীর সম্পত্তি নিয়ে যা ইচ্ছা করুক, তাতে কোনো সমস্যা নেই; কিন্তু আমাকে, আমার পরিবারকে তো এভাবে সবার সামনে অসম্মান করতে পারেন না। লোকজন ডেকে এনে আমার ওপর হামলা করতে পারেন না। আমার গাড়ি ভাঙচুর করতে পারেন না। পা ভেঙে দিতে পারেন না। আমার গায়ে হাত তুলতে পারেন না। ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা আমার গা থেকে ওড়না টেনে ফেলে দিয়েছে! আজকের ঘটনার অনেক ভিডিও ফুটেজ আছে, তাতে আমার সঙ্গে কী কী ঘটেছে, তার স্পষ্ট প্রমাণও আছে। আমার অন্য আত্মীয়স্বজনও সেখানে ছিলেন, সবাই দেখেছেন।’
কথা প্রসঙ্গে লামিয়া এ–ও বলেন, ঢাকা থেকে আমি আমার একজন খালাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। আগেও বলেছি, আম্মুর মৃত্যুর পর সপ্তাহের প্রতি শুক্র অথবা শনিবার আমি সোনারগাঁয়ে যাই। সময় কাটাই আমার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে। খাওয়াদাওয়া করি। এরপর আবার ঢাকায় চলে আসি।’
লামিয়া বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় আমাদের পৈতৃক জায়গা দখল করার চেষ্টা চলছে কিছুদিন ধরেই। সেই টার্গেটে আমি যাওয়ার পর দলবলসহ সন্ত্রাসীরা আসে। ওদের হাতে অস্ত্র ছিল আমাদের মারার জন্য। আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। আমার পা ভেঙে ফেলেছে। আমার ফোনও কেড়ে নিয়েছিল। আমার ওড়না টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে। আমি অনেক ভয় পেয়ে গেছি। এরপর আমি গাড়িতে উঠে গেছি।’
কথা বলার সময় হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন লামিয়া চৌধুরী। কাঁদতে কাঁদতে লামিয়া বললেন, ‘আমার মা-বাবা মরে গেছে। ওরা আমাদের জায়গাজমি দিয়ে গেছে। কিছুই ভোগ করতে পারি না। চারদিক থেকে লোকজন সব দখল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমার ভাই দেশে নেই। আমি সবকিছু একাই হ্যান্ডল করতেছি। এ কারণে সবাই এভাবে আমার পেছনে লেগেছে। কয়েক বছর ধরে আমার জীবনে এসব চলছে, বলে বোঝাতে পারব না। আমার জীবন হুমকির মুখে। আমি একা, সন্ত্রাসীরা এসব বুঝে গেছে।’
লামিয়া বলেন, ‘আমার মা-বাবা মারা গেছেন—এসব তো সবাই জানেন। এই সুযোগ তারা নিতে চায়। ভাবছে, আমি নারী। আমাকে ধমক বা হুমকি দিলে আমি ভয় পেয়ে যাব; কিন্তু না, এসব আমার ও আমার ভাইয়ের সম্পত্তি, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। আমার মা-বাবা দুজনে অনেক কষ্ট করে এসব সম্পত্তি করেছেন। সন্ত্রাসী হামলায় এসব তো ছাড় দেব না। আমাদের আত্মীয়স্বজন ওখানে থাকেন। আজ তো আমি দেখলাম, ঘরের মধ্যে লোকজন থাকা অবস্থায় সন্ত্রাসীরা বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়েছে!’ এদিকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থেকে ঢাকার বাসায় ফিরে লামিয়া চৌধুরী হামলার শিকার প্রসঙ্গে কথা বলেন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের সঙ্গে। সেখানে তিনি তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা তুলে ধরেন। এদিকে রাত পৌনে আটটার দিকে লামিয়া প্রথম আলোকে জানান, তিনি চিকিৎসাসেবা নিতে হাসপাতালে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (খ-সার্কেল) আসিফ ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার বিষয়ে কোনো পক্ষই পুলিশকে জানাননি ফেসবুকের স্ট্যাটাস দেখে আমরা ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়েছিলাম। সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, জমিজমা নিয়ে লামিয়া এবং তাঁর মামার পরিবারের মধ্যে বিরোধ চলছিল। আজ এ নিয়ে স্থানীয় লোকজনের উপস্থিতিতে একটি সালিস ছিল। সেই সালিসে কথা-কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি এবং লামিয়ার গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক। ঘটনার আগে কিংবা পরে এ বিষয়ে লামিয়া পুলিশকে কিছুই জানাননি। এ ঘটনায় অভিযোগ পেলে আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব।
Publisher & Editor