আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক থেকে বেরিয়ে আসা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় ভুল হবে। এটি শুধু আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার নীতিনির্ধারণে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা কমিয়ে দেবে না, বরং তাদের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করার সুযোগও সীমিত করে ফেলবে। তবু ট্রাম্প প্রশাসনের অন্তত কিছু সদস্য এই পথ বেছে নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক ছাড়লে কী হবে, তা নিয়ে লিখেছেন নাইরি উডস
প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে এনেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগামী কয়েক মাসে আরও কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে তিনি দেশটিকে সরিয়ে আনতে পারেন। ইতিমধ্যেই তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের রূপরেখা হিসেবে পরিচিত ‘প্রজেক্ট ২০২৫’ (যা রক্ষণশীল থিঙ্কট্যাংক হেরিটেজ ফাউন্ডেশন তৈরি করেছে) যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক থেকে বেরিয়ে আসতে বলেছে।
তবে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের অন্যান্য সদস্যরাষ্ট্রের উচিত, ট্রাম্পের দাবির সামনে নতি স্বীকার না করা। তাদের বুঝতে হবে, এ সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই বেশি ক্ষতিকর হবে।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প প্রশাসন একটি বড় পরিসরের ১৮০ দিনের পর্যালোচনা চালানোর নির্দেশ দিয়েছে। ওই পর্যালোচনার অধীনে যুক্তরাষ্ট্র যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য ও অর্থায়নকারী, সেসব সংস্থা ও দেশটির অংশ নেওয়া সব আন্তর্জাতিক চুক্তি ও কনভেনশন পরীক্ষা করা হবে।
ট্রাম্প সরকারের এ নির্দেশনা ‘প্রজেক্ট ২০২৫’-এর লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ প্রকল্পে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংককে ‘অপ্রয়োজনীয় মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এই দুই প্রতিষ্ঠান ‘যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ আটকে রাখে’ এবং বিদেশি প্রকল্পগুলোতে সরাসরি পৌঁছাতে (হস্তক্ষেপ করতে) বাধা দেয়।
যদি ট্রাম্প ‘প্রজেক্ট ২০২৫’ নামের এই পরিকল্পনা অনুসরণ করেন, তাহলে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়া শুধু সম্ভাব্য নয়, বরং আসন্ন বলেই মনে হচ্ছে।
কিন্তু আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক কীভাবে পরিচালিত ও অর্থায়ন করা হয়, তা ‘প্রজেক্ট ২০২৫’-এর লেখকেরা স্পষ্টতই বুঝতে পারেননি। যদি যুক্তরাষ্ট্র এই দুটি সংস্থা ছাড়ে, তাহলে তারা বৈশ্বিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হারাবে। এর ফলে মিত্রদেশগুলোকে সহায়তা করার এবং প্রতিপক্ষদের জন্য অর্থায়ন বন্ধ রাখার শক্তিশালী কৌশল থেকেও যুক্তরাষ্ট্র বঞ্চিত হবে।
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাংক থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে না আসে কিন্তু এর অর্থায়ন বন্ধ রাখে, তাহলে বাকি সদস্যদেশগুলো (যাদের সম্মিলিত ভোটিং ক্ষমতা ৭০ শতাংশ) যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাধিকার স্থগিত করতে পারে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র তখন এর আর্থিক দায়বদ্ধতা পূরণে ব্যর্থ হবে।
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের প্রধান কার্যালয় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর, ট্রেজারি বিভাগ এবং কংগ্রেসের এত কাছাকাছি থাকার বিষয়টি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে এবং তাদের নীতি ও নেতৃত্বকে নিজের জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী পরিচালিত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র সব সময় বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করেছে, আইএমএফের নেতৃত্বে ইউরোপের পছন্দকে অনুমোদন দিয়েছে এবং আইএমএফের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টরও নির্বাচিত করেছে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র দেশ যার ক্ষমতা রয়েছে এককভাবে বড় কোনো সিদ্ধান্ত আটকে দেওয়ার; কারণ, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক—উভয় সংস্থার ক্ষেত্রে ৮৫ শতাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন প্রয়োজন হয়।
আইএমএফকে প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্র ‘প্রথম প্রতিক্রিয়া দেওয়া শক্তি’ হিসেবে ব্যবহার করে। অর্থাৎ যখন কোনো দেশ আর্থিক সংকটে পড়ে, তখন দ্রুত ঋণ দিয়ে সেই সংকট সামাল দিতে আইএমএফ সাহায্য করে। তবে এই ঋণ দেওয়াটার পেছনে শুধু মানবিক বা অর্থনৈতিক সহায়তার বিষয় কাজ করে না; বরং যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ জড়িত, সেখানে সে আইএমএফের ক্ষমতাকে কাজে লাগায়।
২০১৮ সালে আর্জেন্টিনার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মরিসিও মাক্রি আইএমএফের কাছ থেকে ৫৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পান। সেটি ছিল আইএমএফের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঋণ কর্মসূচি। ট্রাম্প প্রশাসন এই ঋণ অনুমোদন দিয়েছিল; কারণ, মাক্রির সরকার যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। এই ঋণের অর্থ আইএমএফের সব সদস্যদেশ থেকেই এসেছিল, কিন্তু এতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল যুক্তরাষ্ট্রের।
শুধু আইএমএফ নয়, বিশ্বব্যাংকের ক্ষেত্রেও একই ধরনের প্রভাব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাংককে তার মিত্রদের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে, কৌশলগত অঞ্চলে নিজের আধিপত্য বাড়াতে এবং বিভিন্ন নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যবহার করে।
সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা, নিরাপত্তা জোটকে শক্তিশালী করা, এমনকি যুদ্ধের পর বিধ্বস্ত দেশগুলোর পুনর্গঠনে বিশ্বব্যাংককে কাজে লাগানো হয়েছে। ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের পর এই দেশগুলোর পুনর্গঠনে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নকে ব্যবহার করা হয়, যা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ নিশ্চিত করার একটি উপায় ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য ধরে রাখতে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। তাই এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্র যদি নিজেকে সরিয়ে নেয়, তাহলে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা যুক্তরাষ্ট্রেরই হবে।
আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের খরচ যা হয় বলে অনেকে ধারণা করেন, আসল খরচ তার চেয়ে অনেক কম। প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় (ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট) দেশটির আইএমএফে দেওয়া অর্থের অর্থনৈতিক প্রভাব মূল্যায়ন করে। এর মধ্যে তারা হিসাব করে, এই অর্থের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কতটা লাভ বা ক্ষতি হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের আর্থিক বছরে তারা রিপোর্ট করেছে, ৪০৭ মিলিয়ন ডলার পরিমাণের অপ্রাপ্ত লাভ (আনরিয়ালাইজড গেইন) হয়েছে। এর মানে হলো, আইএমএফে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ থেকে তারা ভবিষ্যতে আরও অনেক লাভ পেতে পারে, তবে তা এখনো সম্পূর্ণভাবে পাওয়া যায়নি।
বিশ্বব্যাংকও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ব্যবহার করার জন্য দেশটিকে একই ধরনের সুবিধা দিয়ে থাকে। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রধান শাখা (যার আরও চারটি অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান রয়েছে) হলো আন্তর্জাতিক পুনর্গঠন ও উন্নয়ন ব্যাংক (আইবিআরডি)। আইবিআরডির পরিচালন খরচ যুক্তরাষ্ট্র বহন করে না। এই খরচ বহন করে ভারত, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, আর্জেন্টিনা এবং ফিলিপাইনের মতো প্রধান ঋণগ্রহণকারী দেশগুলো।
আইবিআরডির পূর্ববর্তী বছরের নিট আয় একসঙ্গে সংস্থাটির সদর দপ্তর, কর্মচারীদের বেতন এবং অন্যান্য পরিচালন খরচের মূল অর্থায়ন করে। এই খরচের বেশির ভাগই সরাসরি ওয়াশিংটন ডিসির অর্থনীতিতে প্রবাহিত হয়।
অন্যান্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের মতো আইবিআরডি সরাসরি দেশগুলোর অনুদানের ওপর নির্ভর করে না। এর পরিবর্তে ব্যাংকটি বন্ড ইস্যু করে মূলধন সংগ্রহ করে এবং সেই অর্থ উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকে ঋণ হিসেবে দিয়ে থাকে। অর্থাৎ আইবিআরডি নিজেই নিজের অর্থায়ন নিশ্চিত করে।
এ প্রসঙ্গে বলা যায়, ২০২৪ সালে ব্যাংকটি ৫২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের বন্ড ইস্যু করেছে। যদিও এর বন্ডগুলো সদস্যদেশগুলোর ‘গ্যারান্টির মাধ্যমে সমর্থিত’, তবু আইবিআরডি কখনোই তার ‘কলেবল ক্যাপিটাল’ (জরুরি প্রয়োজনে সদস্যদেশগুলোর কাছ থেকে নেওয়া অর্থ) ব্যবহার করতে হয়নি।
ফলে, প্রত্যেক শেয়ারহোল্ডার তাঁদের প্রতিশ্রুত মূলধনের একটি ছোট অংশ ‘পরিশোধিত মূলধন’ (পেইড ইন ক্যাপিটাল) হিসেবে দেন। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই অর্থের পরিমাণটি ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার, যা গত ১৫ বছরে ইলন মাস্কের স্পেসএক্সকে ফেডারেল সরকার যে ২০ বিলিয়ন ডলার ভর্তুকি দিয়েছে, তার মাত্র ১৯ শতাংশ।
নিশ্চিতভাবেই যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্নভাবে বিশ্বব্যাংকে অবদান রাখে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম মেয়াদে আইবিআরডির জন্য ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের মূলধন বৃদ্ধি অনুমোদিত হয়। তবে এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো অতিরিক্ত আর্থিক অবদান রাখার প্রয়োজন সৃষ্টি করে না।
কিন্তু এর বদলে যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু সুবিধা পায়। যেমন বিশ্বব্যাংকের স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানকারী শাখা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় (আইডিএ) যুক্তরাষ্ট্রের অবদান স্বেচ্ছাসেবী এবং প্রতি তিন বছর পরপর নতুন করে আলোচনা করা হয়। এর ফলে আইডিএর ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বিশাল প্রভাব বজায় রাখতে পারে।
সরলভাবে বললে, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক থেকে বেরিয়ে আসা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় ভুল হবে। এটি শুধু আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার নীতিনির্ধারণে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা কমিয়ে দেবে না, বরং তাদের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করার সুযোগও সীমিত করে ফেলবে। তবু ট্রাম্প প্রশাসনের অন্তত কিছু সদস্য এই পথ বেছে নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে।
যদি যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাংক থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে না আসে কিন্তু এর অর্থায়ন বন্ধ রাখে, তাহলে বাকি সদস্যদেশগুলো (যাদের সম্মিলিত ভোটিং ক্ষমতা ৭০ শতাংশ) যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাধিকার স্থগিত করতে পারে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র তখন এর আর্থিক দায়বদ্ধতা পূরণে ব্যর্থ হবে।
এতে যুক্তরাষ্ট্র শুধু নিজেকে প্রত্যাহারের কিংবা নিজের সদস্যপদ স্থগিতের অধিকার ছাড়া বিশ্বব্যাংকের সংবিধির অধীনে প্রায় সব অধিকার হারাবে। তবে প্রত্যাহারের পরও তারা আগের সব প্রতিশ্রুতি মানতে বাধ্য থাকবে। যদি এই স্থগিতাদেশ এক বছরের বেশি স্থায়ী হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্বব্যাংকের সদস্যপদ হারাবে; যদি না সেই ৭০ শতাংশ ভোটিং ক্ষমতাসম্পন্ন দেশগুলো আবার তার সদস্যপদ ফিরিয়ে দেওয়ার পক্ষে ভোট দেয়।
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে প্রেসিডেন্ট থিয়োডর রুজভেল্টের একটি বিখ্যাত উক্তি হলো, ‘মুখে রাখো নরম কথা, হাতে রাখো শক্ত লাঠি’। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন উল্টোভাবে কাজ করছে। ট্রাম্প প্রশাসন জোরে কথা বলছে এবং ইলন মাস্ককে সেই শক্তি ব্যবহার করে সব প্রতিষ্ঠানকে গুঁড়িয়ে দিতে দিচ্ছে।
অন্য দেশগুলো এতে বিস্মিত হতে পারে, কিন্তু তারা অসহায় নয়। যদি তারা স্থির থাকে, একসঙ্গে কাজ করে এবং দ্রুত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তারা এখনো বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে পারবে।
Publisher & Editor