গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি দেখা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে। এই সাক্ষাৎ ছিল জেলেনস্কির বহুল প্রতীক্ষিত। তিনি আশা নিয়ে এসেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা অব্যাহত রাখতে ট্রাম্পকে রাজি করানো যাবে। এ বৈঠক তাঁর আশা মতো হয়নি।
ট্রাম্প ও যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স ক্যামেরার সামনে জেলেনস্কিকে ভর্ৎসনা করেন। অভিযোগ করেন, জেলেনস্কি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধবিরতির মার্কিন প্রস্তাবকে স্বাগত না জানিয়ে ‘অসম্মানজনক’ আচরণ করেছেন।
রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আক্রমণের আগে ইউক্রেনে জেলেনস্কির জনপ্রিয়তা কমে গিয়েছিল। তখন তাঁর গ্রহণযোগ্যতার হার ছিল মাত্র ২৮ শতাংশ। দলের জনপ্রিয়তা ছিল ১১ শতাংশ। কিন্তু যুদ্ধের সময় তাঁর জনপ্রিয়তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়।
তবে গত দুই বছরে জেলেনস্কির জনপ্রিয়তা ধারাবাহিকভাবে কমেছে। জরিপ অনুযায়ী, ২০২৪ সালের এপ্রিলে তাঁর ওপর আস্থা ছিল ৫৪ শতাংশ ইউক্রেনীয় নাগরিকের। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে তা নেমে আসে ৪৯ শতাংশে। যদিও এটি ট্রাম্পের দাবি করা হার থেকে ভালো, তবে ২০২২ সালের মে মাসে তাঁর ৯০ শতাংশ জনপ্রিয়তার তুলনায় এটি অনেক কম।
জনপ্রিয়তা কমার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তার প্রশাসনের দুর্নীতির অভিযোগ এবং দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের ক্লান্তি এর মধ্যে অন্যতম।
জেলেনস্কি জানেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি দুর্বল অবস্থানে আছেন। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝুঁকি নিতে চান না। কারণ, পুনর্নির্বাচনে পরাজিত হলে তিনি দুর্নীতি মামলায় জড়িয়ে পড়বেন কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতিশোধের মুখে পড়তে পারেন। জরিপ বলছে, এখনই নির্বাচন হলে তিনি হেরে যাবেন।
জেলেনস্কির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছেন চার তারকা জেনারেল ভ্যালেরি জালুঝনি। জালুঝনি ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ছিলেন। জরিপ বলছে, যদি তিনি নির্বাচনে দাঁড়ান, তাহলে জেলেনস্কিকে পরাজিত করবেন। জনগণের মধ্যে তাঁর প্রতি আস্থা ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ৭২ শতাংশে পৌঁছায়।
২০২৩ সালে ব্যর্থ পাল্টা আক্রমণের পর জেনারেল ভ্যালেরি জালুঝনিকে বরখাস্ত করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। অনেকেই মনে করেন, ইউক্রেনে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তাও এর একটি কারণ হতে পারে। তাঁকে যুক্তরাজ্যে ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠানো হয়। তিনি এখনো সেই দায়িত্ব পালন করছেন।
এখন পর্যন্ত জালুঝনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেননি। তবে ভবিষ্যতে তিনি সিদ্ধান্ত বদলাবেন না, এমন নিশ্চয়তা নেই। যদি তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না নামেন, তাহলে সামরিক বাহিনীর অন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যেমন ইউক্রেনের গোয়েন্দাপ্রধান কিরিলো বুদানভ প্রার্থী হতে পারেন।
যুদ্ধকালীন সময়ে হঠাৎ নির্বাচন একটি দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তা বোঝার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মতো স্থিতিশীল দেশে পর্যন্ত নির্বাচনের ফলে সৃষ্ট বিভক্তির দিকে তাকানোেই যথেষ্ট। বুদানভের প্রতি জনগণের আস্থা ৬২ শতাংশ। তিনি এক বছর ধরে মিডিয়ায় বেশ সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি হঠাৎই জনসমক্ষে আসা বন্ধ করে দেন। গুঞ্জন রয়েছে, জেলেনস্কির কার্যালয় তাঁকে অপসারণের পরিকল্পনা করছিল। তাই তিনি অন্তরালে চলে যান। তবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হলে তিনি আবারও প্রকাশ্যে আসতে পারেন।
এ ছাড়া আকস্মিক প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেন বক্সিং তারকা ওলেক্সান্দ্র উসিক। ইউক্রেনে যেখানে একজন কৌতুক অভিনেতা প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছেন, সেখানে একজন সফল ক্রীড়াবিদও অপ্রত্যাশিত প্রার্থী হতে পারেন। তিনি এখনো কোনো রাজনৈতিক পরিকল্পনা জাহির করেননি। তবে জনমত জরিপে তার নাম উঠে আসছে। তাঁর জনপ্রিয়তা ৬০ শতাংশ।
তবে জেলেনস্কির সবচেয়ে পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কো। জনপ্রিয়তা কম হলেও তিনি এখনো শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। ২০১৯ সালের পর থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ১৩০টির বেশি অপরাধমূলক মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ। কারণ, তিনি রাশিয়ার দখলকৃত দনবাস অঞ্চল থেকে কয়লা আমদানির অনুমোদন দিয়েছিলেন।
পোরোশেঙ্কো প্রকাশ্যে জেলেনস্কির সমালোচনা করেন। নিজের রাজনৈতিক উচ্চাশা গোপন করেন না। তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফর করে ট্রাম্পের দলটির সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। তবে ফেব্রুয়ারিতে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে অংশ নিতে গেলে তাঁকে ইউক্রেন থেকে যেতে দেওয়া হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে ‘জাতীয় নিরাপত্তাঝুঁকি’ দেখিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। জারি হয়েছে সম্পদ জব্দের আদেশ। এই নিষেধাজ্ঞার বার্তা স্পষ্ট—প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই পোরোশেঙ্কোকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে সরিয়ে দেওয়া হবে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার এ আবহে অন্য কোনো সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীও নির্বাচনে দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছেন না।
জেলেনস্কি যেভাবে বিরোধীদের দমন করছেন, তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। তবে এখন পর্যন্ত তাঁর পশ্চিমা মিত্ররা প্রকাশ্যে কোনো কঠোর সমালোচনা করেননি। বরং হোয়াইট হাউসের বৈঠকের পর ইউরোপীয় নেতারা তাঁর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। এটি সাময়িকভাবে তাঁকে ঘরোয়া রাজনীতিতে সুবিধা দিয়েছে। তবে এ সমর্থন কত দিন স্থায়ী হবে, তা অনিশ্চিত।
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিহিংসার পাশাপাশি ইউক্রেনের সমাজও এখন বিভক্ত। যুদ্ধের কারণে দেশটি স্পষ্টতই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের রাজনৈতিক অঙ্গন হয়ে উঠেছে খুবই অস্থির। যেকোনো মুহূর্তে জনবিস্ফোরণও ঘটতে পারে।
অতিজাতীয়তাবাদীরা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে। জনগণের একটি অংশের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে তারা। অন্যদিকে ইউক্রেনের একটি অংশ এখনো রাশিয়াপন্থী চিন্তাধারা ধারণ করে। তারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায় না।
এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে যদি বিদেশি চাপের ফলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে তা রাশিয়ার আগ্রাসন বা ইউক্রেনের শিল্পাঞ্চল হারানোর চেয়ে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। একটা বড় আশঙ্কা হলো, জনগণের এক-তৃতীয়াংশ ভোট দিতে পারবেন না এবং নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। কিন্তু আসল বিপদ হলো, এই নির্বাচন শুরুর আগেই ইউক্রেন গৃহযুদ্ধের মুখে পড়তে পারে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট পুনর্নির্বাচনের ভয় পাচ্ছেন। আর বিরোধীরা রাজনৈতিকভাবে আবার শক্তিশালী হতে মরিয়া। এই পরিস্থিতিতে তাঁরা সামাজিক বিভক্তিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। যদি নিরাপত্তা বাহিনী ও সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এ লড়াইয়ে টেনে আনা হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।
যুদ্ধকালীন সময়ে হঠাৎ নির্বাচন একটি দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তা বোঝার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মতো স্থিতিশীল দেশে পর্যন্ত নির্বাচনের ফলে সৃষ্ট বিভক্তির দিকে তাকালেই যথেষ্ট।
ইউক্রেনে তড়িঘড়ি নির্বাচন আয়োজনের পেছনে যদি কোনো বিদেশি শক্তির রাজনৈতিক স্বার্থ কাজ করে, তাহলে তা বিপর্যয় ডেকে আনবে। নির্বাচন তখনই হওয়া উচিত, যখন একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠিত হবে। তাহলে সব ইউক্রেনীয় নাগরিক ভয়ভীতির বাইরে থেকে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবেন। নইলে এই নির্বাচন যুদ্ধক্ষেত্রকে আরও বিস্ফোরণপ্রবণ করে তুলবে।
Publisher & Editor