মঙ্গলবার, ১১ মার্চ ২০২৫

পাঁচ বছরে ছয় হাজারের বেশি নারী ও শিশু ধর্ষণ

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ০৯ মার্চ ২০২৫ | ২১

দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়েই চলেছে। ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে দেশে অন্তত ছয় হাজার ৩০৫ জন নারী-শিশু  ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে তিন হাজার ৪৭১ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু রয়েছে। 
চলতি বছরের গত দুই মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে কমপক্ষে ১০৭ জন। যাদের মধ্যে ৬৬ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু রয়েছে। এ সময় ২২৪ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটি দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ নিজস্ব অনুসন্ধানে এসব তথ্য সংগ্রহ করে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে ৪০১ জন নারী ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে দেশে নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ১৭ হাজার ৫৭১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে গত জানুয়ারি মাসে মামলা হয়েছে ২৪১টি। মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া আট বছরের শিশুকে গত বুধবার রাতে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। ওই বাড়ির কেউ তাকে ধর্ষণ করেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
গতকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই শিশুর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে। তবে পরিবারের ভাষ্য, ‘শিশুটি বেঁচে আছে।

মেয়ের জন্য আর্তনাদ করতে করতে শিশুটির মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। গতকাল শুক্রবার দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে একটি ওয়ার্ডের সামনে দেখা যায়, ভুক্তভোগী শিশুটির মা বুক চাপড়ে আহাজারি করছিলেন। বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘আমার এত বড় সর্বনাশ ক্যান করলারে। আমার মেয়ের কি হবো গো...। আমার মেয়েকে মেরে ফালাইছে ওরা, ওদের বিচার চাই আমি।’ 

গতকাল আট বছরের এই শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ এনে মাগুরায় থানা ঘেরাও করেছে ওই এলাকার বাসিন্দারা। এ ঘটনায় ক্ষোভে বিক্ষুব্ধ জনতা গতকাল জুমার নামাজের পর শহরের ভায়না মোড় ও চৌরঙ্গি মোড়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। এ সময় থানার গেট ভাঙতে গেলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। মাগুরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিরাজুল ইসলাম বলেন, শিশুটির চিকিৎসা চলছে। ঘটনায় সন্দেহভাজন দুজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এইচআরএসএসের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে এক হাজার ৮৯ জন নারী ও শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২০৭ জনকে। এর মধ্যে শিশু ১১৮ জন।

৫০ জন ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশু আত্মহত্যা করেছে জানিয়ে ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গত পাঁচ বছরে ১১ হাজার ৭৫৮ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। দুই হাজার ৬২৪ জন নারী ও শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৯০ জন, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৫৫ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ২৬ জন নারী। পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন এক হাজার ২৬২ জন, আহত হয়েছেন ৩৮৬ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ৪১৬ জন নারী। এসিড সহিংসতার শিকার হয়েছে ৯৪ জন নারী ও কন্যাশিশু, যার মধ্যে মারা গেছে ৯ জন।

সার্বিক বিষয়ে এইচআরএসএস নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম গতকাল বলেন, এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়, দেশে নারী ও কন্যাশিশু নিয়মিত গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এর ফলে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীর অবদান অপরিসীম। কিন্তু এখনো অনেক ক্ষেত্রে তারা বৈষম্য এবং প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। কর্মক্ষেত্র, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জনপরিসরে নারীরা প্রায়ই বৈষম্য ও নির্যাতনের সম্মুখীন হন। বিশেষ করে নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি, বাল্যবিবাহ, যৌতুকপ্রথা এবং পারিবারিক নির্যাতন আজও আমাদের সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত।

এইচআরএসএসের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বেশ কিছু কারণে বাংলাদেশে নারী নির্যাতন ও নারীর প্রতি বৈষম্য বাড়ছে। সেই সঙ্গে নারীবিদ্বেষমূলক ঘটনাও ঘটছে। তার মধ্যে কুসংস্কার এবং শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে ভ্রান্ত ধর্মীয় ব্যাখ্যা অন্যতম।

সার্বিক বিষয়ে এইচআরএসএসের নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম বলেন, সরকারের প্রতি আহ্বান, সব জায়গায় নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নারীর সাংখ্যিক দিক নয়, বরং কার্যকর ও গুণগত দিক বিবেচনায় নিতে হবে। যেকোনো রাষ্ট্রীয় আয়োজনে নারীদের অংশগ্রহণ এবং অর্থবহ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া সমাজের সব পর্যায়ে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ঘরে-বাইরে নারীর প্রতি সহিংসতার সব বিচার ও আইনি প্রক্রিয়া সহজতর ও দ্রুত করতে হবে।

এক বছরে ৪০১ নারী ধর্ষণ : আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে ৪০১ জন নারী ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪ জন। ধর্ষণের শিকার সাতজন আত্মহত্যা করেছেন। ১০৯ জন ধর্ষণচেষ্টার শিকার ও ধর্ষণচেষ্টার পর একজনকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া ২০২৪ সালে ২১ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনে একজন মারা যান এবং ছয়জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় লিগ্যালএইড উপপরিষদের দেওয়া তথ্য মতে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে ৭২ জন কন্যাশিশু ও ১১৭ জন নারীসহ ১৮৯ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩০ জন কন্যাশিশুসহ ৪৮ জন। আর তিনজন কন্যাসহ ১১ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার এবং একজন কন্যাশিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ধর্ষণ ছাড়াও নারীকে হেনস্তা ও নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। পাশাপাশি গণপরিসরে নারীরা নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। এসব ঘটনা নারীর মর্যাদা, নিরাপত্তা, স্বাধীন চলাচল ও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। যার মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এই প্রেক্ষাপটে আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে। এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন নারী ও কন্যার উন্নয়ন।’ এই স্লোগান সামনে রেখে নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা বন্ধে দিবসটি উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor