বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫

‘সাইলেন্ট কিলারের’ বিদায়ও সাইলেন্টে

প্রকাশিত: ০১:৪১, ১৩ মার্চ ২০২৫ | ১০

শিরোনাম দেখে কিছুটা আক্ষেপ হওয়ারই কথা। সাইলেন্টলি কিংবা নীরবে যে বিদায় নেওয়া যায় সেটা দেখিয়ে দিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। কোনো রকম আগাম ঘোষণা ছাড়াই লাল সবুজের জার্সি তুলে রাখলেন দেশের ক্রিকেটের তারকা এই ক্রিকেটার। অথচ, দেশের ক্রিকেট ভক্তদের প্রত্যাশায় ছিল বাকি আরও অনেকের মতো ফেসবুকে বিদায় না হোক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের। সিনিয়র এই ক্রিকেটারের বিদায় হোক তারই পরিচিত কোনো মাঠে।  

গেল ফেব্রুয়ারিতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে জাতীয় দলের হয়ে সর্বশেষ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ব্যাট হাতে এই ম্যাচে পারফর্ম করতে না পারাই অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটারকে নিয়ে কথা হচ্ছিল অনেক, যা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল অবসর প্রশ্নেও। ফলশ্রুতিতে গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টের মাধ্যমে নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার থেকে অবসরের কথা জানান মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। 

সবশেষ জাতীয় দলের হয়ে সময়টা ভালো যাচ্ছিল না রিয়াদের এই কথাটা বলা খুব একটা সমীচিন নয়। কারণ এই বছর মাত্র একটি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন মাহমুদউল্লাহ। ইনজুরির কারণে ছিলেন না চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রথম ম্যাচে। দ্বিতীয় ম্যাচে ফিরে তার ব্যাটে আসে মাত্র ৪ রান। তবে গত বছর ওয়ানডেতে ব্যাটার রিয়াদ ছিলেন দারুণ উজ্জ্বল। ২০২৪ সালে ৯টি ওয়ানডেতে তিনি ৪৮.১৪ গড়ে ৩৩৭ রান করেছেন। এর মধ্যে নভেম্বর-ডিসেম্বরে খেলা শেষ চার ওয়ানডেতে তার রানের চিত্রটা ছিল এমন– ৯৮, ৫০*, ৬২ ও ৮৪। 

অবসরের ঘোষণা দিয়ে যা বললেন মাহমুদউল্লাহ

সামাজিক মাধ্যমে তবুও সমালোচনার তীব্র বিষে পুড়ছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। যে কারণে বিসিবি থেকেও মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে কথা হচ্ছিল অবসর নিয়ে। তবে আচমকা নিজেই দিয়ে দিলেন জার্সি তুলে রাখার ঘোষণা। ঢাকা পোস্টকে বিসিবির এক নির্বাচক জানালেন রিয়াদের সঙ্গে কথা বলছিল বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন্স বিভাগ। নির্বাচকদের সঙ্গে অবসর প্রসঙ্গে হয়নি কথা। 

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন মাহমুদউল্লাহ
ক্রিকেটাররা মাঠে খেলা চালালেও অবসর নিচ্ছেন ফেসবুক থেকে। যে কারণে আফসোস ঝরেছে সাবেক নির্বাচক হাবিবুল বাশার সুমনের। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলছিলেন, ‘মাঠ থেকে নিতে পারলে অবশ্যই ভালো হতো, সেটা ডিসার্ভঁ করে সে। বাংলাদেশ দলের জন্য যা করেছে, মাঠ থেকে নিলে খুব ভালো হতো। পুরো স্টেডিয়ামের সামনে থেকে এসে বিদায় নিলে। আমার মনে হয় সব থেকে  প্রোপারলি হতো বিদায়টা।’ 

‘আমি কেবল রিয়াদকে অভিনন্দন জানাতে চাই। সে সব সময় মিডল অর্ডারের জন্য শক্ত খুঁটি ছিল। তার স্কিল নিয়ে সন্দেহ নেই, তার শুরুতে আমি ছিলাম সঙ্গী। বাংলাদেশের হয়ে অনেক ভালো ইনিংস রয়েছে তার, যে কারণে কোনো ইনিংসকে মেনশন করতে চাই না। আমি আশা করি সে দেশের হয়ে যা কিছু অর্জন করেছে তা নিয়ে গর্বিত।’ 
জেমি সিডন্স, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাবেক কোচ
পরে মাহমুদউল্লাহর অবদানের কথা জানিয়ে বাশার বলছিলেন, ‘সে বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য অনেক কিছু করেছে। তার প্রপার সম্মান সে ডিজার্ভ করে। সে সবসময় দলের জন্যই খেলেছে। দলের কথা চিন্তা করেছে। তবে টেস্ট ক্রিকেটটা আরেকটু লম্বা হতে পারতো, এটা হলে আসলে ভালো হতো। আর যদি উপরের দিকে একটু ব্যাটিং করত তাহলে আরো ভালো হতো।’

ইনজুরিতে মাহমুদউল্লাহ, মাঠের বাইরে কতদিন

রিয়াদের কয়েকজন কাছের বন্ধুর মধ্যে একজন জাতীয় দলের আরেক ক্রিকেটার আরাফাত সানী। বন্ধুর বিদায় বেলায় ঢাকা পোস্টকে তিনি বলছিলেন, ‘অনূর্ধ্ব ১৫ থেকে আমরা ভালো বন্ধু একসাথে শুরু করেছিলাম ক্রিকেট। এরপরে পারফর্ম করতে করতে রিয়াদ অনেক আগেই জাতীয় দলে সুযোগ পাই। আমি তো অনেক পরে পেয়েছিলাম। কিন্তু বন্ডিংটা সব সময় ছিল এখনো আছে। সে বাংলাদেশ দলকে অনেক সার্ভিস দিয়েছে তার জন্য সবসময় শুভকামনা, তার অনেক অবদান।’

ছোটবেলায় রিয়াদের সঙ্গে মজার ঘটনা বলতে গিয়ে সানী জানালেন, ‘রিয়াদ অনেক মজার মানুষ ছিল, এখন যেমন একটু শান্ত আগে কিন্তু ওরকম ছিল না। রিয়াদ অনেক রেসলিং পছন্দ করত। আমরা অনূর্ধ্ব ১৫তে থাকতে একবার মালেয়েশিয়া ট্যুর করেছিলাম। আমাদের আরেক বন্ধু ছিল হিমেল নাম, তার সাথে রেসলিং করতো রিয়াদ রুমের ভিতরে। অনেকটা ডব্লিউ ডব্লিউর মতো করে, তবে সেটা শুধুই মজা। এটা আসলে খুব মনে পড়ে খুব মজার ছিল ওই দিনগুলো।’

১৮ বছরের লম্বা ক্যারিয়ারে বাংলাদেশের ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ জুড়েই ছিলেন মাহমুদউল্লাহ। বিশেষ করে আইসিসি ইভেন্টগুলোতে। যার শুরুটা হয়েছিল ২০০৭ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। তবে নিজের গুরুত্ব জানান দেন ২০১১ সালে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষের ম্যাচ দিয়ে। সেই ম্যাচে শফিউল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ২ উইকেটের জয় তুলে আনেন রিয়াদ। 

এরপর ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের প্রথম শতক তুলে নেন রিয়াদ। একই আসরে নিউজিল্যান্ডের হ্যামিল্টনেও এই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার দেখা পান ম্যাজিক ফিগারের। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডের ওভালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে রিয়াদ আরেকটি সেঞ্চুরি করেন। সবশেষ ভারত বিশ্বকাপেও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে করেন শতক। ২০২৩ সালে দল থেকে বাদ পড়ার পর সেই শতক দিয়েই প্রত্যাবর্তন করেন তিনি।

২০১১ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রধান কোচ ছিলেন জেমি সিডন্স। রিয়াদের বিদায় দিনে অবশ্য জানালেন শুভেচ্ছা। তবে বিশেষ কোনো ইনিংসকে মেনশন করতে চাননি ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে, ‘আমি কেবল রিয়াদকে অভিনন্দন জানাতে চাই। সে সব সময় মিডল অর্ডারের জন্য শক্ত খুঁটি ছিল। তার স্কিল নিয়ে সন্দেহ নেই, তার শুরুতে আমি ছিলাম সঙ্গী। বাংলাদেশের হয়ে অনেক ভালো ইনিংস রয়েছে তার, যে কারণে কোনো ইনিংসকে মেনশন করতে চাই না। আমি আশা করি সে দেশের হয়ে যা কিছু অর্জন করেছে তা নিয়ে গর্বিত।’

এর আগে ২০২৩ সালে মাহমুদউল্লাহ বাদ পড়েছিলেন নাকি বিশ্রামে ছিলেন বিদায় বেলায় আবারো সেই ব্যাখা দিলেন সেই সময়ের নির্বাচক বাশার, ‘তখন এটা নিয়ে অনেক ভুল বুঝাবুঝি হয়েছিল, আমরা তাকে বিশ্রাম দিয়েছিলাম। কিন্তু সব জায়গায় চলে গিয়েছিল যে আমরা তাকে বাদ দিয়েছি। এটা একটা মিস কমিনিউকেশন ছিল, সবাই নিজের মতো বানিয়েছিল আর কি। তখন আমরা কিছু প্লেয়ারকে নতুন করে ট্রাই করছিলাম। মাহমুদউল্লাহকে প্রপার বিশ্রাম দিয়েছিলাম তখন।’

‘আর এটা প্রত্যেকটা দেশ ই করে থাকে, যেটাকে সবাই বলেছিল যে আমরা বাদ দিয়েছি পরে। তাকে আমরা বিশ্রাম দিয়েছিলাম কিন্তু সে কিন্তু বিশ্বকাপ খেলেছিল। সেটা আমাদের মাথায় ছিল। আমরা তখন নতুন নতুন ভাবে সবকিছু চেষ্টা করছিলাম।’

সবমিলিয়ে আইসিসির বড় টুর্নামেন্টে ৪ সেঞ্চুরি আছে রিয়াদের। এছাড়া ম্যাচ জিতিয়ে মাহমুদউল্লাহর ভোঁ দৌড় বাংলাদেশের ক্রিকেটেরও এক পরিচিত দৃশ্য তবে সেসব সোনালি দিন পেরিয়ে রিয়াদ পৌঁছেছেন ক্যারিয়ারের অন্তিম লগ্নে। যেখান থেকে লাল সবুজের জার্সিতে ফেরার সম্ভাবনা আসলে আর নেই। রিয়াদ টেস্ট থেকে অবসরে গিয়েছিলেন অনেক আগেই। টি-টোয়েন্টিতে গেল বছর ভারতের মাটিতে, বাকি ছিল কেবল ওয়ানডে। এবার সেটি থেকেও নীরবে-নিভৃতেই এই অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের প্রস্থান। 

৩৯ বছরে পা রাখা রিয়াদ ঘরোয়াতে কতদিন খেলবেন সেটা সময়ের হাতে তোলা থাক। তবে রিয়াদ থাকবেন চট্টগ্রাম থেকে কার্ডিফ হয়ে হ্যামিল্টনে। থাকবেন ২০১৭-এর নিদাহাস ট্রফির শ্রীলঙ্কা ম্যাচের পরিচিত কিছু দৃশ্যে। যার ব্যাটে একসময় কোটি ভক্তের মুখে ফুটেছিল আনন্দের ঝিলিক। জেমস অ্যান্ডারসন থেকে ট্রেন্ট বোল্ট যিনি সবাইকে দেখিয়েছেন লড়াইয়ের তেজ।

মাহমুদউল্লাহ আর বাংলাদেশ ক্রিকেট এখন যেন কত কাছে, তবুও কত দূরে।

বিদায় কিংবদন্তি..... 

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor