শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫

মেসি বাংলাদেশে কখনো গোল করেননি

প্রকাশিত: ০১:১৯, ১৫ মার্চ ২০২৫ |

মেসির মানচিত্র—এমনটা কেউ বললে কি কোনো ভুল হবে! আর্জেন্টিনার ফুটবল মহাতারকার ক্যারিয়ারটা ভ্রমণ করে এলে দারুণ একটা মানচিত্র তো তৈরি হয়ই। পৃথিবীর সাতটি মহাদেশের ছয়টিতেই ফুটবল খেলেছেন তিনি। ক্যারিয়ার–পরিক্রমায় গত পরশু নতুন করে পা রেখেছেন আরেকটি দেশে, আরেকটি শহরে।

জ্যামাইকায় এর আগে কখনো তিনি খেলেননি। কিংস্টনের ক্লাব ক্যাভালিয়ের এফসির বিপক্ষে ইন্টার মায়ামির হয়ে কনক্যাকাফ চ্যাম্পিয়নস কাপের দ্বিতীয় লেগের ম্যাচ খেলতে জ্যামাইকা গিয়েছিলেন মেসি। এর আগে সেখানে তিনি কখনো খেলেননি। কিংস্টন শহরটিতে ফুটবল মেসির পায়ের ছোঁয়া পাওয়ার পর অনেকেরই হয়তো তাঁর ক্যারিয়ার–পরিক্রমা নিয়ে নতুন করে আগ্রহ জাগতে পারে।

মেসির সেই ক্যারিয়ার–পরিক্রমার মানচিত্র আঁকতে গেলে দারুণ এক বিষয়ই ফুটে ওঠে। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া—পৃথিবীর এই ছয় মহাদেশে মেসি ৪৯টি দেশে ফুটবল খেলেছেন। দেশগুলোর ১৮০টি শহরে ক্লাব ও জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নেমেছেন ১০৮৭টি ম্যাচে, করেছেন ৮৫৩ গোল। সর্বশেষ গোলটি এসেছে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের দেশ জ্যামাইকার কিংস্টনে। ক্যাভালিয়ের এফসির বিপক্ষে, গত পরশু।

ফুটবলের কারণে ৪৯টি দেশ ঘুরে ফেলা মেসি অবশ্য একটা সময়ে বেশ গৃহকাতরই ছিলেন। আর্জেন্টিনার রোজারিও থেকে ১৩ বছর বয়সে স্পেনের বার্সেলোনায় পা রাখেন মেসি, সেই কিশোর বয়সেই বার্সেলোনার সঙ্গে চুক্তি করেন। সেই যে মেসির ফুটবল–ভ্রমণ শুরু হলো, এখনো চলছে পৃথিবীর আনাচকানাচে। রোজারিও থেকে কিংস্টন, বিশ্বজোড়া ফুটবলপ্রেমীদের নিজের পায়ের জাদুতে এখনো মুগ্ধ করে যাচ্ছেন মেসি।

রোজারিও থেকে বার্সেলোনায় নাম লেখানোর পর নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল–ভ্রমণটা অবশ্য মনে রাখার মতো ছিল না। স্পেনের বাইরে নিজের প্রথম সিনিয়র ফুটবল ম্যাচটি হেরেছিলেন ২–০ গোলে, ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে শাখতার দোনেৎস্কের কাছে। আট মাস পর আবার মেসি বার্সেলোনার বাইরে যান, এবার আর্জেন্টিনার হয়ে অভিষেক ম্যাচ খেলতে। বুদাপেস্টে হাঙ্গেরির বিপক্ষে সেই প্রীতি ম্যাচটাও মেসি হয়তো ভুলেই যেতে চাইবেন। ম্যাচটিতে বদলি হিসেবে মাঠে নামার দুই মিনিটের মধ্যেই প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়কে কনুই মেরে লাল কার্ড দেখেন।

মেসি আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলেছেন বাংলাদেশেও। ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের সেই ম্যাচে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ৩–১ ব্যবধানের জয়ে অবশ্য মেসির গোল দেখতে পাননি বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা। মেসির বিশ্বমাতানো ক্যারিয়ার আকাশমুখী হতে শুরু করে ২০০৬ সালে। স্পেনের বাইরে নিজের প্রথম গোলটি পান সে বছরই, আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের বাসেলে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে। সেই গ্রীষ্মে জার্মানির গেলসেনকিরচেনে বিশ্বকাপে গোলের খাতা খোলেন মেসি। কয়েক মাস পর ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে নিজের প্রথম গোলও পেয়ে যান, চ্যাম্পিয়নস লিগে বার্সেলোনার হয়ে ভের্ডার ব্রেমেনের সঙ্গে ১–১ গোলের ড্র ম্যাচে। সেই থেকেই ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে বড় মঞ্চে মেসির আধিপত্যেরও শুরু।

আসলে ইউরোপই মেসির সাফল্যের সবচেয়ে বড় ময়দান। বার্সেলোনার হয়ে ৭৭৮ ম্যাচ খেলেছেন, পিএসজির হয়ে ৭৫টি। এই সময়টাতে তিনি ক্লাবের হয়ে ৭০৪ গোল করেছেন, পেয়েছেন ৫৯১ জয়। একে একে নামের পাশে যোগ করেছেন ১২টি লিগ শিরোপাজয়ী সিলমোহর। জ্বলজ্বলে ক্যারিয়ারে মেসি জিতেছেন চারটি চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা। সেগুলো তিনি এমন দেশে জিতেছেন, যেখানে তাঁর ক্যারিয়ারে জয়ের শতাংশ খুব একটা আহামরি নয়।

চ্যাম্পিয়নস লিগে মেসির প্রথম শিরোপা প্যারিসে ২০০৬ সালে, আর্সেনালকে হারিয়ে। ২০০৯ সালে রোমের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে হারিয়ে জিতেছেন দ্বিতীয়টি। এই ইতালির কথাই ধরুন, সেখানে মেসি ১৫ ম্যাচ খেলে জিতেছেন মাত্র ৫টিতে, ইতালির ক্লাবগুলোর বিপক্ষে তো শুধু তিনটি। অন্য জয় দুটির একটি তো রোমের সেই ফাইনাল, যে ম্যাচে দারুণ এক হেডে তিনি দলের ২–০ ব্যবধানের জয়ে দ্বিতীয় গোলটি করেছিলেন। বাকি জয়টি অ্যাঙ্গোলার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে।

ইংল্যান্ডেও মেসির অভিজ্ঞতা অম্লমধুর। ২০১১ সালে ওয়েম্বলিতে ম্যান ইউনাইটেডকে হারিয়ে ক্যারিয়ারের তৃতীয় চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা জেতেন। বার্সেলোনার ৩–১ ব্যবধানের জয়ে একটি গোল করেন মেসি, যেটা নিয়ে ইংল্যান্ডের মাটিতে তাঁর মোট গোল নয়টি। মধুময় এই সাফল্যের পরও ২০১৯ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগে লিভারপুলের কাছে বার্সেলোনার ৪–০ ব্যবধানে হেরে যাওয়ার রাতটি মেসির ক্যারিয়ারের অন্যতম ‘অম্লরাত’। সেমিফাইনালের প্রথম লেগটি বার্সা জিতেছিল ৩–০ গোলে। কিন্তু অ্যানফিল্ডে কী যে হয়ে যায় মেসিদের! ৪–০ গোলে হেরে ফাইনালে আর যাওয়া হয় না বার্সার।

মেসি চ্যাম্পিয়নস লিগে তাঁর চতুর্থ শিরোপাটি জেতেন বার্লিনে, ২০১৫ সালের সেই ফাইনালে জুভেন্টাসকে ৩–১ গোলে হারিয়েছিল বার্সেলোনা। ক্যারিয়ারে মেসি জার্মানির নয়টি শহরে খেলেছেন—গেলসেনকিরচেন, ফ্রাঙ্কফুর্ট, লাইপজিগ, মিউনিখ, ব্রেমেন, স্টুটগার্ট, লেভারকুসেন, বার্লিন ও ডর্টমুন্ড। জার্মানিকে এত ফুটবল–ভ্রমণের পরও মেসি বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে কোনো অ্যাওয়ে ম্যাচ জেতেননি। এমনকি বায়ার্নই তাঁকে ‘উপহার’ দিয়েছিল ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় হার—লিসবনে ৮–২ গোলের হার। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ২০১৯–২০ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগ হয়েছিল সেখানে।

ইউরোপের ফুটবলে চোখধাঁধানো এত সাফল্য, তবে মেসির ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সফল মুহূর্ত হয়তো আর্জেন্টিনার আকাশি–সাদা জার্সিতে। ২০২২ সালে কাতারে আর্জেন্টিনার হয়ে যে জিতেছেন বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় শিরোপা—বিশ্বকাপ ট্রফি। দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ হয়ে মেসির ফুটবল ক্যারাভান এখন উত্তর আমেরিকায়। এই তিন মহাদেশে তিনি তাঁবু গেড়েছেন, কিন্তু ভ্রমণ তো করেছেন আরও তিন মহাদেশেও—এশিয়া, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া।

মেসির সেই ফুটবল–ভ্রমণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের নামও। অস্ট্রেলিয়া, চীন, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, গুয়াতেমালা, হাঙ্গেরি, ভারত, আয়ারল্যান্ড, ইসরায়েল, ইতালি, জাপান, নরওয়ে, কাতার, রোমানিয়া, রাশিয়া, সৌদি আরব, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত আর যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও মেসি যে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলেছেন বাংলাদেশেও। ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের সেই ম্যাচে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ৩–১ ব্যবধানের জয়ে অবশ্য মেসির গোল দেখতে পাননি বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor