একটা সময় ছিল যখন বড় ভাই নাঈম উদ্দিন খেলা শেষ করে বাসায় ফেরার পর ছোট ভাই আবেদ উদ্দিন স্টিকটা নিয়ে জানতে চাইতেন কীভাবে গোল করতে হয়, কীভাবে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বল দখলে নিতে হয়। বেশির ভাগ সময় ছোট ভাইকে হকি নিয়ে ধারণা দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন নাঈমও। তবে মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘তুই এত কিছু বুঝতে চাস কেন! সময় হলেই সব বুঝবি।’
এবার বোধ হয় সেই সময়টাই হয়েছে আবেদের। গত পরশু এশিয়ান হকি ফেডারেশন (এএইচএফ) কাপের জন্য চূড়ান্ত দল ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন। আর এই দল এক করেছে দুই সহোদর নাঈম আর আবেদকে। নাঈমের সঙ্গে এবার আবেদও প্রথমবারের মতো সুযোগ পেয়েছেন জাতীয় দলে।
নাঈম-আবেদদের পুরো পরিবারই হকি পরিবার। মোহামেডানের পাঁড় ভক্ত বাবা মোহাম্মদ মোস্তফার স্কুলজীবন থেকেই হকির প্রতি বাড়তি টান ছিল। নিজের মনের মধ্যে থাকা স্বপ্নটা পরে ছড়িয়ে দিয়েছেন ছেলেদের মধ্যে। বড় ছেলে আফসার উদ্দিনও অনেকটা দূর এগিয়ে শেষমেশ জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়াতে পারেননি। সেই পথ ধরে ২০১৭ সালে প্রথম জাতীয় দলে নাম লেখান আরেক ছেলে নাঈম। তাঁর সাত বছর পর এবার আবেদেরও স্বপ্ন পূরণ হলো। পুরান ঢাকার আরমানিটোলা তারা মসজিদসংলগ্ন এলাকা থেকে উঠে আসা নাঈম-আবেদ এখন মোস্তফা পরিবারের বড় গর্ব।
গতকাল শেষ বিকেলে মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়ামের টার্ফে দাঁড়িয়ে খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন আবেদ। রোমন্থন করেন অতীতের স্মৃতিগুলো। রাতে আর দশজনের মতো ফেসবুক কিংবা নাটক-সিনেমায় মজে না থেকে দুজনই বসতেন হকির গল্পের ঝাঁপি খুলে। সেই দিনগুলো মনে হলে এখন আবেদের হাসি পায়, আবার কখনো মনের অজান্তে চোখে জলও আসে, ‘ভাইয়ের (নাঈম) সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। তাকে দেখেই তো হকিতে আসি। একটা সময় নিজের মধ্যেও জেদ চেপে বসে। বড় ভাইকে (আফসার) অনেক পরিশ্রম করতে দেখেছি। কিন্তু তিনি পারেননি জাতীয় দলে ঢুকতে। তবে নাঈম ভাই দলে জায়গা পাওয়ার পর আমিও স্বপ্ন দেখা শুরু করি। তখন থেকে হকি নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার এত এত কথা হতো যে খেতে গেলে, ঘুমাতে গেলে এমনকি হাঁটতে হাঁটতেও আমরা হকির আলাপ করতাম।’
ক্রিকেট-ফুটবলের জনপ্রিয়তার মধ্যে হকির প্রতি নাঈম-আবেদের আগ্রহটা ব্যতিক্রম। দুজনই ছিলেন বিকেএসপির ছাত্র। তাঁদের হকিপ্রেম দেখে বাবা-মা এমনকি পরিবারের অন্য সদস্যরাও এখন হকিতে বুঁদ হয়েছেন। যেকোনো খেলা শেষে বাসায় যাওয়ার পথে নাঈম ভাবতেন আজ জানি বাবা কী বলবেন! কারণ, বাসায় নিয়মিতই তাঁদের হকি নিয়ে আড্ডা হয়, গল্পের আসর বসে। যেমনটা বলেছেন আবেদ, ‘ভাইয়া খেলে যাওয়ার পর বাবা-মা সবাই মিলে তাকে ধরেন। কোথায় কী ভুল হলো তাঁরা সরাসরি বলেন। একসময় আমিও তাঁর সমালোচনা করেছি। এখন তো আমাকেও তেমন কিছুর মুখোমুখি হতে হবে। এই বিষয়গুলো সত্যি মজার। বাবা-মা কিন্তু হকি তেমন বোঝেন না, তবু তাঁরা হকি নিয়ে ভাইয়াকে বোঝান।’
১৭ থেকে ২৭ এপ্রিল ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় হবে এএইচএফ কাপ, যা একই সঙ্গে এশিয়া কাপ হকিরও বাছাইপর্ব। ১৪ এপ্রিল এই টুর্নামেন্টে অংশ নিতে দেশ ছাড়বে বাংলাদেশ দল। দুই ভাই আবেদ-নাঈমের জন্য যেটা দারুণ রোমাঞ্চকর। এত দিন একাই দেশের জন্য লড়তেন। এবার ভাইকে সঙ্গে নিয়েই লাল-সবুজের জন্য বিজয় ছিনিয়ে আনতে চান নাঈম, ‘আবেদের এই দিনটি দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। খুবই ভালো লাগছে। এত দিন ঘরে তাঁর সঙ্গে হকি নিয়ে কথা বলেছি, এবার মাঠেও হবে। দুই ভাই মিলে দেশকে দারুণ কিছু উপহার দেওয়ার চেষ্টা করব।’
Publisher & Editor