মার্ডার মিস্ট্রি নিয়ে সারা দুনিয়ায় প্রচুর সিনেমা হলেও ঢাকাই ছবিতে কেন যেন এই ঘরানা গরহাজির। সেদিক থেকে শরাফ আহমেদ জীবনের ঈদের সিনেমা ‘চক্কর ৩০২’-কে ব্যতিক্রমই বলতে হবে। কে এবং কেন—এ দুই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে এগিয়েছে সিনেমাটির কাহিনি। রহস্যের জালে চক্কর কাটতে কাটতে সমাধানে পৌঁছানো, এ নিয়ম মেনেই বোনা হয়েছে চিত্রনাট্য।
অভিনয়: মোশাররফ করিম, রিকিতা নন্দিনী শিমু, শাশ্বত দত্ত, রওনক হাসান, মৌসুমী নাগ, সুমন আনোয়ার, ইন্তেখাব দিনার ও ফারজানা বুশরা
সদ্য কৈশোর পেরোনো তিন বন্ধু সাদমান, লিমা ও রায়ান গাড়িতে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। বলা ভালো, নেশা করছিল। এই নেশার জিনিস নিয়ে সাদমান ও রায়ানের মধ্যে ঝামেলা হয়। রাগ করে সাদমান বাসায় চলে যায়, একটু পরেই তাকে শিক্ষা দিতে হাজির হয় রায়ানও। কিন্তু বাসায় ঢুকেই রায়ান আবিষ্কার করে সাদমানের রক্তাক্ত মৃতদেহ!
এই রায়ান আবার জনপ্রিয় চিত্রনায়ক হাসান চৌধুরীর ছেলে। ডিবি অফিসার মঈনুলের ওপর পরে তদন্তের ভার। দায়িত্ব নিয়েই রায়ানকে গ্রেপ্তার করে মঈনুল। কিন্তু রায়ান কি সত্যিই খুনি? নাকি এ খুনের পেছনে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো উদ্দেশ্য?
সরকারি অনুদানে নির্মিত ‘চক্কর’-এর চিত্রনাট্য লিখেছেন সৈয়দ গাউসুল আলম শাওন ও নাহিদ হাসনাত। চিত্রনাট্য পরামর্শক ছিলেন তানিম নূর ও সানিয়াত হোসাইন। বাইরে স্ক্রিপ্ট ডক্টর ধারণাটি জনপ্রিয় হলেও দেশি সিনেমায় তাঁদের ভূমিকা খুব একটা দেখা যায় না। এদিক থেকেও ‘চক্কর’ ব্যতিক্রম। সিনেমার চিত্রনাট্য খারাপ নয়, এতে যদি চিত্রনাট্য পরামর্শকের অবদান থাকে, তাহলে ধারণাটি ভালোই কাজ করেছে বলা যায়।
চিত্রনাট্য আর অভিনয় মিলিয়ে মোটের ওপর উপভোগ্য সিনেমা ‘চক্কর’। পুলিশের তদন্ত নিয়ে সিনেমার সাধারণ নিয়ম মেনেই তৈরি এটি। ধরনটা খুব চেনা হলেও নির্মাতা বাড়তি কিছু করার চেষ্টা না করে বরং যেটা বানাচ্ছেন সেটা মন দিয়ে করার চেষ্টা করেছেন। তদন্তপ্রক্রিয়া শুরুর পর তাই একটা টান টান উত্তেজনার মধ্যে ঢুকে পড়তে হয়, পুরো সিনেমাতে এই রোমাঞ্চ ব্যাপারটা কমবেশি আছে। আর আছে হাস্যরস।
‘জীবনটা নির্ভেজাল করতে চাইলে আগে বউয়ের প্রেমে পড়তে হবে’ কিংবা ‘এত স্ট্রেস নিয়েও তোমরা এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এত স্বাভাবিক থাকো কীভাবে’—এমন সংলাপ হলে হাততালি কুড়িয়েছে। তবে সিনেমায় মেয়েদের পিরিয়ড নিয়ে কৌতুকটা এড়ানো গেলে ভালো হতো। অন্তত এ রকম দুঁদে তদন্ত কর্মকর্তার মুখে এ ধরনের নারী অসংবেদী সংলাপ মানায় না।
সিনেমার প্রাণভোমরা গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তা মঈনুল। চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন মোশাররফ করিম। ব্যস্ত পুলিশি জীবন, বাসায় বউয়ের সঙ্গে ঝামেলা—মার্ডার মিস্ট্রির এই কমন উপাদানও মোশাররফের সহজাত অভিনয়গুণে ক্লিশে লাগে না। বই বা পর্দার বেশির ভাগ গোয়েন্দাই সিগারেটনির্ভর, মঈনুল সেখানে বাদামনির্ভর। পুরো সিনেমা তিনি বলা যায় চিনাবাদামের ওপর দিয়ে চালিয়ে দিয়েছেন। কেবল বাদামই নয়, সেদ্ধ ডিম, শিমুলগাছের শিকড় থেকে জাম্বুরা—চরিত্রটির সঙ্গে স্বাস্থ্যকর খাবারের যোগ আছে। এটি নতুনত্বের সঙ্গে মজাও যোগ করেছে। মোশাররফের সঙ্গে তাঁর সহকারী সজীব চরিত্রে শাশ্বত দত্তর রসায়নও জমাট ছিল। প্রথম সিনেমাতেই নিজের ছাপ রাখতে পেরেছেন এই তরুণ অভিনেতা। লিমা চরিত্রে আরেক তরুণ অভিনেত্রী ফারজানা বুশরাও খারাপ করেননি। মোশাররফ করিমের স্ত্রী শান্তার চরিত্রে যথারীতি ভালো করেছেন রিকিতা নন্দিনী শিমু। জাতীয় পুরস্কারজয়ী এই অভিনেত্রীর কণ্ঠ অন্যকে দিয়ে কেন ডাব করানো হয়েছে, বোঝা গেল না।
সিনেমায় রায়ান আর সাদমানের মায়ের যে রসায়ন দেখানো হয়েছে, সেটাকে জোর কোনো ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারেননি নির্মাতা। কেনই–বা দুজনে এতটা সময় ধরে কথা বলে গেলেন, সে প্রশ্নেরও উত্তর নেই। একইভাবে কিছু জায়গায় পার্শ্বচরিত্রদের অনেক সময় দেওয়া হয়েছে মনে হয়।
মিজানুর চরিত্রে ইন্তেখাব দিনার যথাযথ। খল চরিত্র গন্ডার বাবু হিসেবে সুমন আনোয়ারের উপস্থিতি ছিল সত্যিই ছাপ ফেলার মতো। ইদানীং তিনি খল চরিত্রে প্রচুর কাজ করছেন, বেশির ভাগই মনে রাখার মতো হয় না। তবে ‘চক্কর’ উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
প্রখ্যাত চিত্রনায়ক হিসেবে রওনক হাসানের অভিনয় খারাপ নয়, তবে প্রভাব বিস্তারকারী তারকা হিসেবে তাঁকে খুব মানিয়েছে কি? সিনেমার আবহসংগীত সাধারণ, সিনেমাটোগ্রাফিও গল্পকে এগিয়ে নিতে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারেনি। তবে সম্পাদনা বেশ ভালো ছিল। একসঙ্গে যেভাবে জিজ্ঞাসাবাদ দেখানো হয়েছে, সেটা বিরক্তির উদ্রেক করেনি।
‘চক্কর ৩০২’ শেষ হয়েও যেন হয় না। কে জানত আস্তিনের তলায় চমক লুকিয়ে রেখেছিলেন নির্মাতা। চমকটি সিকুয়েলের ইঙ্গিত দিয়ে যায়। প্রথম সিনেমা নির্মাণেই যেহেতু ছাপ রাখতে পেরেছেন শরাফ আহমেদ জীবন, তাই পরের সিনেমার জন্য অপেক্ষা করাই যায়।
Publisher & Editor